• Uncategorized
  • 0

সাপ্তাহিক ধারাবাহিকে পাপিয়া ভট্টাচার্য (পর্ব – ৪)

আলোধুলোর দিন

আগের দিন রাত্রে লুচি আর সেমাইয়ের পায়েস হয়েছিল , সবার সঙ্গে মাও সেসব খেয়েছিল বলে ভোরে পেটের ব্যথায় ঘুম ভেঙ্গে মা যখন জানাল ব্যথার কথা ,দিদা বলল কাল রাতে হয়তো হজম হয়নি ।একটু পরেই অবশ্য বাড়াবাড়ি রকমের ব্যথা দেখে শৈলেশ ডাক্তারের ডাক পড়ল ।ওই গ্রামে শুধু নয় ,পুরো বারো চোদ্দ খানা গ্রামের ভরসা তখন ওই শৈলেশ ডাক্তার। হেলথ সেন্টার নামেই ছিল একটা ,কম্পাউন্ডার ছাড়া কেউ থাকত না সেখানে । মা তখন নিজের কক্ষপথ থেকে ছিটকে গেছে অনেক দূরে । ব্রাহ্ম গার্লসের সাদা স্কার্ট , লাল টাই , লাল বেল্ট আর দুই বিনুনির কিশোরীটি হঠাৎ তেরো বছরে মাতৃহারা হয়ে ভাইবোন সমেত গিয়ে পড়ল জ্যেঠু জ্যেঠিমার সংসারে । মাত্র পঁয়ত্রিশ বছরে হার্টফেল করে মায়ের মা । মায়ের আদর্শবাদী জ্যেঠু তার অনেক আগেই কলকাতার স্কুলের চাকরি ছেড়ে বিদ্যাসাগরের দৌহিত্রের অনুরোধে বিদ্যাসাগর প্রতিষ্ঠিত প্রথম বিদ্যালয় , বীরসিংহ ভগবতী বিদ্যালয়ের প্রধানশিক্ষক হয়ে গ্রামে গেছলেন এবং ভগ্নপ্রায় স্কুলটিকে প্রাণপাত করে আবার গড়ে তুলেছেন । বিদ্যাসাগরের জন্মভিটের পাশেই আমবাগান ঘেরা তাঁদেরই একটি বাড়ি বরাদ্দ হয়েছিল প্রধান শিক্ষকের জন্যে । সেখানে গরিব ছাত্ররা অপুত্রক দাদু দিদার কাছে বিনাখরচায় থাকত ,পড়ত । দিদা ছিল তাদের মা । আমার জন্মের আগেই দাদু অবসর নিয়েছিলেন, স্কুল ,ছাত্রাবাস সব গুছিয়ে গড়বেতায় নিজের বাড়িতে ফিরতে সময় লাগছিল । একটু বড় হবার পর যখন প্রতিবছর তেরোই শ্রাবণ স্কুল থেকে নিয়ে যাওয়া হত বীরসিংহ , স্কুলের অফিসঘরের দেওয়ালে বিদ্যাসাগর রবীন্দ্রনাথ ইত্যাদি মনীষীদের সংগে আমার ওই দাদুর বড় করে টাঙানো ছবি, তাঁকে উৎসর্গ করে বেরোনো স্মরণিকাগুলি দেখে কী যে গর্ব হত !
মায়ের বাবা ,মা বাপি বলত বলে আমরা যাকে বাপিদাদু বলতাম ,স্ত্রী অন্ত প্রাণ চল্লিশের প্রায় যুবকটি তখন শোকে পাগল হয়ে দেশ ছেড়ে চলে গেছেন সিংগাপুর । ইমপোর্ট এক্সপোর্টের ব্যবসা সূত্রে তাঁর যাতায়াত ছিলই ,কিন্তু দাদা বউদি মাতৃহীন ছেলে মেয়েগুলোকে বুকে করে নিয়ে যাবার পর দাদু নিয়মিত টাকা পাঠানো ছাড়া কয়েক বছর পর আর দেশেই ফেরে নি।
স্নেহভরে আগলে রাখলেও তেরো থেকে চার ,পরপর চারটি কন্যাকে দেখে জ্যেঠির বুকও হিম হয়ে যেত নিশ্চয়ই । ভালবাসা খুবই ছিল ,তবে কারো অসুখ বিসুখ করলে ‘ তোর মা তো আমার ঘাড়ে সব ফেলে রেখে দিব্যি কেটে পড়ল , এখন আমি কী করি’ বলে কান্নাকাটিও করত শুনেছি । ছোটরা অত বুঝত না ,কিন্তু মায়েরা কিশোর তিনভাই বোন একটু সংকুচিত থাকত। জোর করে কিছু বলার মত সাহস পেতো না।
আমার ঠাকুমাও তখন নিজের তরুণ তিনটি পুত্রসন্তান অকালে হারিয়ে পাগলপ্রায় ,সবেধন নীলমণি একটু আড্ডাবাজ ছেলেটিকে সংসারী করে বাঁধতে চাইছে ।ফলে গ্রাম টাম মাথায় থাক ,মিল হল রাজযোটক ।
এই তো আর কিছুদিন ,ফিরে গিয়ে আবার স্কুল ,ক্লাস টেনের পরীক্ষা,বন্ধুরা , সব ভাবনায় ছাই দিয়ে চোদ্দ বছরের মেয়েকে সংসারে ঢুকে পড়তে হল।
সেই ব্যথার সকাল ছিল জগদ্ধাত্রী পুজোর দিন। ডাক্তারের বাড়িতে পুজো হত ,সেই ব্যস্ততার মধ্যেই কর্তব্যপরায়ণ ডাক্তার কল পেয়ে এসে আমাকে পৃথিবীর আলো দেখান । এমন সব ডাক্তারদের এখন বইয়ের পাতাতেই খুঁজে পাই আর ওই জ্যেঠু জ্যেঠিমারাও শরৎ চন্দ্রের উপন্যাসে।
খুব গোলগাল একমাথা চুলের কন্যাটির জন্মের খবর পেয়ে বিদেশ থেকে বাপিদাদু টেলিগ্রামে নামকরন করে পাঠান ,মেরী। এর আগে আমার দাদার নামও তিনিই রেখেছিলেন ,পিটার । আমার ঠাকুমা শুনে বলেছিল ,তোমার বাপি সাহেবসুবোদের দেশে থেকে বাংলা নাম ভুলেছে ।দাদাকে অবশ্য বাপিদাদু ছাড়া আর কেউ ডাকে নি ও ,আমি কিন্তু মেরীতেই রয়ে গেলাম ।
আমার ঠাকুমা এমনিতে ভালো মানুষ ছিল এবং সে সময়ের পক্ষে যথেষ্ট মুক্তমনা। দাদার জন্মের পর যেমন ,তেমনি আমি হবার পরও নাকি গোটা পাড়া মিঠাই বিলিয়েছিল । যদিও একটু বড় হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তাঁর মনোভাব সামান্য হলেও পাল্টে গেল। বাড়িতে কেউ এলে দুঃখ করেই ফেলত, এ মেয়ের কেমন চেহারা দেখো, আর আমার নাতিটা যেন দিন দিন শুকিয়ে যাচ্ছে !
তো এটুকু তফাত তো বংশধরের সঙ্গে পরের বাড়ি যাবার জন্যে আসা মেয়ের থাকবেই । সে আমার মায়েরও ছিল, পিন্টু বাইরে পড়তে যাবার পর সে যা যা ভালোবাসত ,মুখেও তুলত না। তবে এসবের সঙ্গে আর ভালবাসা না বাসার কী সম্পর্ক !
শুধু বাবা ! তাঁকে ভয় পেতাম খুব ,আবার তাঁর আশকারা পেয়েই যে আমি ছেলেদের সংগে পাল্লা দিয়ে সাইকেল চালিয়ে ঘুরি,পাড়ার আর কোনো মেয়ে তো এরকম করে না এবং সাইকেলটি ভাঙলে যে খুবই খুশি হয় মা ,এসব আক্ষেপ কোনওদিন গোপন করে নি । তবে চিঠি পোষ্ট করতে দূরের পোষ্টাফিসে যেতে হলে ‘ চট করে সাইকেল টা নিয়ে একবার যা তো মা ‘ , সেসবও ছিল।
অল্প বয়সে বিধবা ঠাকুমার প্রবল আচার বিচার ,এদিকে বাবা বেশিরভাগ বাইরে , দিনরাত আত্মীয়স্বজনের আসা যাওয়া ,ছোট ছোট ছেলে মেয়ে এতসব মায়ের একার পক্ষে সামলানো কষ্টকর বিবেচনায় একটি ছেলেকে রাখা হল । ষোলো সতেরোর সর্বদা হাসি মুখ কিশোর সত্যদার ভক্ত ছিলাম আমরা সবাই । বাবা তখন গাইদুধের পুষ্টিকারিতা এবং ছেলে মেয়ের স্বাস্থ্য বিষয়ে সচেতন হয়ে একটি জার্সি গরু কিনে এনেছিল ।স্বাস্থ্যবান বিশালাকায় সেই জার্সি গরু সমেত আমাদের চারটি পোষ্যকেই সত্যদা দক্ষতার সঙ্গে আগলাতো ।
সেই প্রাণপণ আগালোনোর কত ঘটনা এখনও মনে পড়ে। দাদা ক্লাস ফোর ,আমি ঐক্য বাক্য মানিক্য,আর বোন এইটুকুটি । দাদা মাঠে খেলে ,সত্যদা আমাদের দু জনকে নিয়ে বেড়াতে যায়।রাস্তায় একবার রিকশার সামান্য ধাক্কায় পড়ে গেলাম আমি ।রিকশাওয়ালার বিশেষ দোষ ছিল না , আমারও হাত পা সামান্য ছড়েছিল মাত্র । তাতেই সত্য দা ধুন্ধুমার কান্ড ঘটালো। আমাকে আর বোনকে এক কোলে চেপে লোকটাকে মারধোর করে রিকশা উল্টে দিয়ে প্রায় ভেঙ্গে ফেলে আর কি !
সেই সত্যদাই একদিন গরমের দুপুরে নিজের ঘরে নিয়ে চার বছরের আমাকে জাঙিয়া খুলে হাত দিতেই আমি কিছু না বুঝেই ভয়ে কেঁদে উঠেছিলাম ।
কিছুদিন পরেই সত্যদা চলে যায় আমাদের বাড়ি থেকে। নিজের পায়ে দাঁড়ানোর জন্যে বাবা তাকে ট্রলি কিনতে কিছু টাকা দিয়েছিল । মাঝে মাঝে স্কুলের পথে দেখা হত , খালি ট্রলি থাকলে সত্যদা ডাকত , ‘ আয় উঠে পড় ,ঘরে দিয়ে আসব।’
অনেকদিন কেটে গেছে তখন ।স্বাভাবিক নিয়মে অত ছোট বয়সের স্মৃতি আবছা হয়ে যায় , সত্যদার মুখের হাসিটাও নির্মল, বয়ঃসন্ধির সত্যদা হয়তো কৌতূহলী হয়ে পড়েছিল , কিন্তু কেমন যেন অস্বস্তিকর একটা ভয় আমার মনে রয়েই গেল । বড় হতে হতে বুঝেছিলাম মেয়ে জন্ম যতই প্রিয় হোক ,কিছু না কিছু মাশুল আমাদের প্রায় প্রত্যেককেই দিয়ে যেতে হবে ।
আরো বেশ কিছু বছর পরে ,আমি স্কুলের শেষ ধাপে ,খবর পেলাম আত্মহত্যা করেছে সত্যদা ।কারণ কিছু জানা যায় নি,শুধু আমাদের বাড়িটা শোকে থমথমে হয়ে গেছল ।
ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।