অচিন্ত্য মাঠ থেকে যখন ফিরল সূর্য তখন পশ্চিম দিকে।এ বছর ফাল্গুনে যা খর তাপ!অচিন্ত তামাটে হয়ে গেছে।কেউ বলবেনা মানুষটির গায়ের রঙ দুধে আলতা।যেমন বলিষ্ঠ দেহ তেমন লম্বা।এক কথায় রাজপুত্র বললে অত্যুক্তি হয়না। কিন্তু সেই অপরূপ রূপ সংসার নামক অগ্নি দাহে জ্বলে পুড়ে বিবর্ণ হয়ে গেছে।অচিন্ত্যকে দেখলে পরাজিত সিরাজের কথা মনে উঁকি দেয়। ক্লান্ত অচিন্ত্য ছেলেকে ডাক দেয়,”অনন্ত?এক মগ জল দিয়ে যা —
এখন অনন্ত বাড়িতে থাকলে তবে তো দেবে? আজ রবিবার, পাড়ার নাট মন্দিরে যত ছেলের ভিড়।পাশ দিয়ে গেলে ঠুক ঠাক মার্বেলের শব্দ।অশেষ ও ওইখানে।ওদিকে অচলা খুন্তি দিয়ে কড়াইকে শাসন করে চলেছে। আর নিজের গর্জে বলে চলেছে,”কে দেবে জল?কোন লাট সাহেব এসেছেন সব ছেড়ে ছুড়ে ছুটে গিয়ে জল দিতে হবে? এখানে পিন্ড এর জোগাড় করবে কে?ধিঙ্গি মেয়ে দেখ জেঠিমার কাছে গিয়ে বসে আছে।আর আমি আছি বাড়ির চাকরানী !কি দেখে যে আমি এ সংসারে এসেছিলাম!একটি অপদার্থের গলায় মালা দিয়েছি”। অচিন্ত্য কোন উত্তর না করে উঠে গিয়ে জল গড়িয়ে খেয়ে নিতেই বাঁধল আর এক বিপত্তি।অচলা বাজখাঁই গলায় চেঁচিয়ে উঠে বলল,
“বাইরের থেকে এসে গামছা কাপড় ছাড়া নেই রান্না ঘরে ঢুকে জল খাওয়া হচ্ছে? শিক্ষার অহঙ্কারে মাটিতে পা পড়েনা কিন্তু এইটা জানো না এই অবস্থায় ঘরের ভেতরে ঢুকতে নেই? বাবা মা কি শিখিয়েছে?মুখে শুধুই বড়াই,আমি তখনকার দিনের এম,এ পাশ। অচিন্ত্য মনে মনে বলল, এ আর এক সমস্যা,বললে পাঁচ কথা ,আর না বললে দশ কথা।এম,এ পাশ না ধপাস!ওই কয়েকটি টিউশনি করে ঢের তো পয়সা জোটে।তমোনাশ মন্ডল যাহোক কয়েক বিঘা ধানি জমি রেখে গিয়েছিলেন, না হলে না খেয়ে মরতে হতো। মুদির দোকান তো কবে লাটে উঠেছে!আর নিজের দাদাকে দেখ,কেমন গায়ে গতরে খেটে সংসার চালাচ্ছে? প্রতিদিন বাজার থেকে বড়ো বড়ো মাছ আসছে।মাঝে মাঝে মাংস লেগেই আছে। প্রসঙ্গক্রমে জানিয়ে রাখি বড়ো ছেলে অঘোর বিয়ে পাশ ।বাবা যখন মারা গেল, দোকান যখন আর চলছেনা ,তখন গুজরাটের এক কম্পানিতে কাজ করতে চলে যায়।অচলা ব্যাঙ্গ করে বলল,”তুমি আর তোমার ছেলে মেয়ে হয়েছ হ্যাংলা।বৌদি ডাকলেই ছুটে চলে যাবে”। এতক্ষণ অচিন্ত্য চুপ করে শুনছিল।সেই শোনার মধ্যে মনযোগ ছিল যতটা তার থেকে অবজ্ঞা ছিল ঢের বেশী। আর কথার মর্মার্থ কি তার বলতে হবেনা।বিয়ের পর থেকে তাকে শুনে আস্তে হচ্ছে।এইবার আর এক বিপত্তি ঘটিয়ে ছাড়ল।”ছুটে যাওয়ায় দোষ কোথায়? দাদা বৌদিরা কি পর?আর তোমার হাতের রান্না মুখে তোলার মতো নয়”।যে আগুনে তরকারি টগবগ করে ফুটছিল-সেই আগুন যেন অচলার সমস্ত শরীর জ্বালিয়ে দিল ।”না না বৌদি তো সবচেয়ে বেশী আপন। তারজন্য প্রতিদিন দেখ না কেমন নানান ব্যাঞ্জন চলে আসে। ঠাকুরপো এই নাও তোমার দাদা বাজার থেকে মোচা এনেছিল ,মুগডাল আর মাছের মাথা দিয়ে মোচার ঘন্ট বিনিয়েছি।কতো আদিক্ষেতা,মরে যাই মরে যাই।আর আমি যা রান্না করি মুখে তোলা যায়না। কিন্তু বৌদি?যা রান্না করে সব অমৃত।আমি কি কিছুই বুঝিনা”? শান্ত গলায় অচিন্ত বললে, “সত্যিই তুমি কিছুই বোঝেনা”।অচলা দপ করে জ্বলে উঠে বলল,”আমি বুঝবো কেন?সব তোমার ঐ মাধ্যমিক ফেল বৌদি বোঝে।আসলে কি জানো তোমরা হলে জাত ভিখারী। আমাদের ঘরে ওইসব নেই।থাকবেও বা কেন?বাবার ত্রিশ বিঘা জমি। আমার দাদা ডাক্তার।ধ্রুব খাঁড়া বললে মথুরাপুরের কে না চেনে আমার বাবাকে।করোলা বাগানে এই রোদে কাজ করে এমনিতেই মাথা গরম হয়ে আছে–তার উপর সংসারে এই নিত্য দিনের ঝগড়া–আর সহ্য হয় না। অচিন্ত্য মুখ বিকৃতি করে বলল,”তুমি বৌদির শিক্ষা নিয়ে পড়েছ তোমারই বা শিক্ষা কতদূর”?”কি? আমার শিক্ষা নিয়ে কথা বলা? নেহাত সেই বছর বসন্ত হলো তাই উচ্চ মাধ্যমিক দিতে পারিনি। কিন্তু আমি হলাম সাইন্স এর ছাত্রী। তোমার ওই বৌদি সাইন্স মানে বোঝে”?বলে উনুন থেকে কড়াইখানা দুম করে মেঝেতে রেখে দিল।ওদিকে অর্চনা স্কুল ছুটি বলে জেঠিমার কাছে বসে গল্প করছিল।মায়ের চিৎকারে সে বুঝল বাবা মাঠ থেকে এসেছে তবে।জেঠিমা তাকে খুব করে বলেছিল খেয়ে নিতে। কিন্তু সে খেলনা। তরকারি নিয়ে বসে আছে বাবা এলে নিয়ে গিয়ে এক সাথে খাবে বলে। এমনিতেই জেঠিমার হাতের রান্না অসাধারণ-তার উপর আজ আবার মৌরালা মাছের টমেটো দিয়ে ঝাল।লোভে জিভে জল চলে এলেও সে তার বাবা কে ছেড়ে খেতেই পারেনা। তাছাড়া অশেষ অনন্ত তারাও আছে।মাঝে মাঝে মায়ের ভয়ে অনন্ত খায়না।আসলে ও এখন অনেক ছোট কিনা? ও ক্লাস এইট, অশেষ দেবে মাধ্যমিক আর আমি উচ্চ মাধ্যমিক।এই ঝগড়া নতুন নয়,তবে যত ঝগড়া হচ্ছে ততই অর্চনা তার মায়ের বিরুদ্ধ হয়ে উঠছে।তাই ঝগড়ার শব্দ পেয়ে এতো সময় যে উঠি উঠি করেছিল-এখন আর উঠতে ইচ্ছে করছেনা। ওদিকে একে একে সবার খাওয়া শেষ।তাই না উঠে ও উপায় নেই। মুহুর্তে তার মনে হয়ে উঠলো আজ তরকারি নিয়ে গেলে বেশী করে ঝগড়া বাঁধবে। কিন্তু সেই ভাবনা বেশি সময় স্থাই হল না।সদ্য যৌবনের স্বাধীন চেতনা তাকে প্রতিবাদী করে তুললো।সে তরকারি নিয়ে বাড়ি গেলে অচলার চোখ তার হাতের দিকে যেতেই অচলা বাহ্য জ্ঞান শূন্য হয়ে পড়ে।ছুটে এসে বাটি খানা হাত থেকে কাড়িয়ে নিয়ে মাটিতে আছাড় মেরে ফেলে দিল।আর চুলের মুঠি ধরে কয়েক ঘা চড়িয়ে দিল। ঘটনার আকস্মিকতায় হতভম্ব হয়ে অচিন্ত্য মেয়েকে বুকে টেনে নিল।
অচলার সহিত অচিন্ত্য এর বিবাহ ।সে এক বিরল ঘটনা ,এ স্থলে উল্লেখ না করলে পাঠকগণ এই ঘটনার রসাস্বাদন থেকে চিরকাল দূরে থাকিবেন।
তখন অচিন্ত্য সবে মাস্টার ডিগ্রী পাশ দিয়েছে। চাকরির জন্য আবেদন টাবেদন করছে। অচিন্ত্য’র এই স্কুল মাস্টার হবার বিন্দুমাত্র ইচ্ছে নেই।তার ইচ্ছে কালেক্টর হবে।তাকে দেখে বিশ পঞ্চাশ জন লোক স্যালুট ঠুঁকবে।তার এই গ্রাম্য আদব কায়দা একদম পছন্দ নয়।সবসময় ইস্ত্রি করা জামা প্যান্ট ব্যবহার করে। দামী পারফিউম ব্যবহার করে। অচিন্ত্য,তার গায়ের রঙ নিয়ে বরাবর উন্নাসিক।তাই সে কালো রং একদম পছন্দ করতে পারেনা।বাবা তমোনাশ মন্ডল বাবুপুরের একজন বিশিষ্ট ব্যক্তি।তিনি শুধুই যে শিক্ষক এমন নয়। তাঁর সার্ভের কোর্স করা আছে।তাই বিসয় সম্পত্তির সমস্যা তে তাঁর গ্রামে বিগ্রামে ডাক পড়ে।এক বড়ো মুদির দোকান আছে।সারা কৃষ্ণ নগর ঘুরলে এমন বহু প্রতিভার অধিকারী কম পাওয়া যাবে।তিনি প্রচন্ড রাশভারী মানুষ। সংসারে তাঁর কথাই শেষ কথা।তিনি তাঁর দুই কন্যা কে সম্ভ্রান্ত পরিবারে বিবাহ দিয়েছেন। বড়ো ছেলে অঘোর কে ও বিয়ে করিয়ে এনেছেন সেকালের জমিদার বাড়ির মেয়ে।গায়ের রঙ কালো বলে বড়ো ছেলে আপত্তি করেছিল। কিন্তু সেই আপত্তি অন্দরমহলের মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল। অচিন্ত্য’র যখন মেয়ে দেখা হলো তখন ও সেই একই প্রথা মেনে হলো।এইবার বাধ সাধল সয়ং অচিন্ত্য।মেয়ের পরিবারে অভাব বলে কিছুই নেই। কিন্তু অচিন্ত্য’র যা চাই,তার বিস্তর অভাব ছিল।অচলার গাত্রবর্ণ কুচকুচে কালো, মুখশ্রী ও চোখে লাগার মতো নয়।এক কথায় অচিন্ত্য এর কাছে অচলা চাঁদের গায়ে কলঙ্ক। অচিন্ত্য না বলে বসল। কিন্তু না বললে চলবে কেন?তমোনাশ বাবু যেখানে কথা দেয়, সে কথা খেলাপ হবার জো নেই। অচিন্ত্য অনেক কিছুই করল কিন্ত লাভ কিছু হবার আশা সে নিজেই দেখতে পাচ্ছে না। অগত্যা শাস্তি দেবার উদ্দেশ্যে অচিন্ত্য নেড়া হয়ে গেল।তাও তমোনাশ বাবু করবার পাত্র নন।ওকে নেড়া অবস্থায় বিয়ে করতে হবে। এইবার অচিন্ত্য শেষ চেষ্টা করল।বলল,আমি মা নৌকো তে করে বিয়ে করতে যাব। বিদিশার হয়েছে যত জ্বালা ,এক দিকে ছেলে আর এক দিকে স্বামী।কোনদিক সামলাবে !তমোনাশ বাবুর কানেও কথা যথানিয়মে উঠলে তিনি তাতেই রাজি হয়ে গেলেন।তাঁর কথা রক্ষা করবার জন্য তিনি সবকিছু করতে প্রস্তুত। অচিন্ত্য’র কথা মতো বিয়ে তে মোট বরং যাত্রী ছিল পাঁচজন।বৌদি দুই দিদি আর দুই জামাইবাবু।এ যেন এক শোকের অনুষ্ঠান। কোনোদিকে কোনো আনন্দের আয়োজন নেই। বাড়িতে প্যান্ডেল হলো না।না আছে অতিথি অভ্যাগত, না আছে আত্মিয় পরিজন।এ যেন জেদের বশে মহাকাল দুই মেরু এক করার খেলায় মেতেছে।
অচিন্ত্য একটি কম্পানির কাজ জোগাড় করেছে।মায়ের মৃত্যুর বছর ঘুরতে না ঘুরতেই বাবার মৃত্যু সংসারের বাঁধন আলগা করে দিল।যে মুদির দোকান রমরমিয়ে চলত, অচিন্ত্য আর অঘোর দায়িত্ব নিয়ে ঝাঁপ ফেলার ব্যবস্থা করল। দোকান বন্ধ হতেই অঘোর মাটির মায়া কাটিয়ে ভিন রাজ্যে পাড়ি দিল। অচিন্ত্য তার পুঁথি শিক্ষার অন্তরালে নিজের অহঙ্কারের প্রতিবিম্বকে দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর করে চলল।নিজেকে এমন স্থানে স্থাপন করেছে সেখানে না আছে পৌঁছানোর ক্ষমতা আর না পরছে নীচে নেমে স্বাভাবিক জীবন যাপন করতে।এক কথায় নিজের জালে নিজে ফেঁসেছে। অপরদিকে অচলা যে কেবলি বাবার বাড়ির নামগান করলে সংসার চলবেনা তা আজ ও বোঝা হলোনা।আর মৃত্যুর আগে হবে বলেও আশা নেই।সেই নিত্য ঘটনার পরিসমাপ্তি ঘটবে,পাশাপাশি জ্ঞাতিদের সেই অশান্তি তে ভুগতে হবেনা ভেবেই প্রতিভার আনন্দের সীমা নেই।আনন্দের আরও এক বড়ো কারণ হলো তার দেওর এই দিন রাত ঝগড়া মারামারি থেকে মুক্তি পাবে।এই রকম প্রতিদিন বৌয়ের কাছে লাথি ঝাঁটা গাওয়ার থেকে বিদেশ বিভুঁইয়ে পড়ে মরা ঢের ভালো।তার হয়েছে এক জ্বালা,সব ছেলে মেয়ে ঠিক তার কাছে। তারজন্য প্রতিদিন কতো কথাই শুনতে হয়! কিন্তু ওই নিস্পাপ মুখগুলোর দিকে তাকিয়ে তার মাতৃত্ব কেঁদে ওঠে।সে তার নিজের ছেলেদের সাথে কোনদিন অচিন্ত্যের ছেলে মেয়েদের আলাদা করেনি।প্রতিভা চোখের জল মুছে মনে মনে ভগবানকে বলল, ভগবান তুমিই জানো আমি ঐ ছোট ছোট শিশুদের কেমন ভালোবাসি! অচলা যেভাবে কুইঙ্গিত করে তার জবাব তুমি দিও ভগবান।
এখন অচলার আর এক সমস্যা হলো। স্বামী উপার্জনের জন্য বাড়ি ছাড়া হয়েছে সেটি যেমন ভালো দিক তেমন তার সাঁথে সঙ্গ দেবার কেউ রইলনা। কারণ অচলা দিন রাত স্বামীর সাথে ঝগড়া করতে পারে কিন্তু পাড়া প্রতিবেশীর বাড়িতে কোনদিন পাই ফেলেনি। তার ছেলে মেয়েকে শাসন করে বলে,কার ও মতো আমি কি অশিক্ষিত?নাকি দিন রাত পাড়ায় পাড়ায় গল্প করে বেড়াই?আমি তোদের পড়াশোনার জন্য রাত করে রান্না করতে তাই।কথা গুলো শুনে অর্চনা মনে মনে হাসে।তাদের পড়তে বসিয়ে মা নাক ঠেকে ঘুমায়। ঘুম থেকে ওঠে রাত এগারোটায়।তখন মে তাঁর মতো যেদিকে সেদিকে পড়ে পড়ে ঘুমাচ্ছে।তারপর উনুনে হাঁড়ি চাপে।আর মাঝে মাঝে গর্জন করে বলে কি রে পড়ছিস?তারাও এই নিয়মে অভ্যস্ত। ঘুমাতে ঘুমাতে বলে হুম।কখনো সখনো কুকুর পেটার মত করে শাসন চলে। শিক্ষার থেকে নিজ অর্জিত শিক্ষাধারার গুরুত্ব অনেক বেশি।সেই ধারায় সমস্ত ছেলে মেয়েকে অভ্যস্ত হতেই হবে।অর্চনা অশেষ যদিওবা ভয়ে কিছুটা মেনে নিল কিন্তু অনন্ত হয়েছে জেদী আর বেয়াড়া।তাই অচলার যে সমস্যা তৈরি হয়েছিল সেই সমস্যা দূর হলো।এখন প্রতিদিন অনন্তর সাথে ঝগড়া মারামারি লেগেই আছে। সেদিন তো অনন্তর বন্ধু পাপ্পু বলল,কাকিমা অনন্ত কোথায়?ব্যাস হয়ে গেল,অচলা বলল,তাই পাপ্পু? তোমার বাবা মা কি বাড়িতে নেই? আজকালকার ছেলে, সটান শুনিয়ে দিল,কেন কাকিমা?আছে তো।অচলা ছেলের এই উত্তর শুনে উত্তেজিত হয়ে বলল, তোমার মতো ডেফো ছেলে আমি দেখিনি। তোমরা আমার ছোট ছেলে পেয়ে তার সর্বনাশ করে চলেছ।আর কোনদিন যেন অনন্তর সঙ্গে তোমাদের মিশতে দেখি। সেদিন পাপ্পু চলে গেল।তারপর অনন্ত সব কথা বন্ধুদের কাছে শুনে,এরপর বাড়ি ফিরতে ইচ্ছে করে দেরি করতে শুরু করলো।শাসন চলল আগের থেকে অনেক বেশী।অনন্ত বাবার মতো গায়ের রঙ আর মায়ের মতো শক্ত কাঠামো পেয়েছে।তাই যত শাসন করে তত চোয়াল শক্ত করে সহ্য করে।দিনে দিনে তার জেদ পাহাড় প্রমাণ হয়ে চলেছে সঙ্গে অচলা যেন মরিয়া হয়ে উঠেছে পারলে অনন্তকে নখে টুকরো করে ফেলে। তিনজনের মধ্যে অনন্তর বুদ্ধি সব থেকে বেশী। কিন্তু ফল যা হবার তাই হলো।ক্লাসে বরাবর প্রথম হয় যে ছেলে বাবা একবছর বাইরে যেতে ক্লাস এইটে ফেল!অচলা শিক্ষকদের কাছে গিয়ে ছেলের সামনে তার বেয়াড়াপনার নমুনা তুলে ধরল।তাতে এই বেয়াড়া ছেলেকে বেশী বেশী করে শাসন করে তারজন্য বাড়িয়ে বলতে ছাড়লোনা।এমনিতে শিক্ষকদের সামনে তাকে অপমান করছে তার উপর ঝুড়ি ঝুড়ি মিথ্যা–অনন্ত যেন এই সব নিয়ম কানুন সব শেষ করে দিতে পারলে তবেই তার শান্তি।নিরবে সেদিন সব শুনে নিল। কিন্তু কি করতে হবে তার মনে মনে সে ঠিক করে নিয়েছে।তার সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করে এমন কেউ নেই।এখন তার একমাত্র বাবার কথা মনে পড়ছে।বাবা কোনদিন গায়ে হাত পর্যন্ত তুলেনি। কিন্তু কোনদিন বাবার মুখের উপর একটি কথা বলার সাহস তার ছিলনা।
দীর্ঘ একবছর পর অচিন্ত্য বাড়ি এসেছে অশেষ, অনন্ত ,অর্চনার খুশির সীমা নেই। অচিন্ত্য’র ও শ্রীর পরিবর্তন হয়েছে। বৈবাহিক জীবনের এই প্রথম এতো শান্তি সংসারটিতে। প্রতিভার মনে ভয়ের শঙ্কা। পরক্ষণেই নিজেকে নিজে ধিক্কার দেয়, ছিঃ এ আমার কি মতি গতি? মানুষ কি সবসময় একরকম থাকবে? দূরত্ব মানুষের মর্যাদা ফিরিয়ে দেয়।এখন অচলা হয়তো বুঝেছে। অচিন্ত্য ও বুঝতে পেরেছে মানুষের রূপটাই সব নয়।এমনি কয়েকদিন কাটতে না কাটতেই আবার চিৎকার।অচলার তীক্ষ্ণ গলা শান্ত পাড়ার মর্ম ভেদ করে চলে যাচ্ছে।তোর মুরদ কতো সে আমার জানতে বাকি নেই।পয়সা ইনকাম করে পাহাড় করেছিস না?তোর ছেলে তোর মতোই তো হবে। আমি দিন রাত এক করে দিয়েছি কিন্তু তার শরীরে তোর রক্ত বইছে-
অচিন্ত্য এখন ঝগড়া করতে চাইছেনা। অচিন্ত্য যত চুপ করে আছে অচলার ক্রোধ তত বেড়ে চলেছে। অচিন্ত্য’র ধৈর্য্য একসময় বালির বাঁধের মতো ভেঙে গেল।সে বলল,এই এক বছরে অনন্তর কি এমন হলো ক্লাসে ফেল করে গেল? তুমি তো আর যা তা ছাত্রী নয় সাইন্স বলে কথা!বিদ্রুপে অর্চনা মুচকি হাসছে–দেখে অচলা তেলে বেগুনে জ্বলে উঠলো।তোর লজ্জা করেনা তুই হাসছিস?তোদের জন্য আমি সারা রাত চোখের পাতা এক করতে পারিনা।তোদের পড়ার জন্য আমার জীবনে কোন আনন্দ নেই।তোরা হাসবি না তো কে হাসবে?নিমক হারাম এর রক্ত গায়ে আছে না! অচিন্ত্য ও ব্যাঙ্গ করতে ছাড়ল না,বুঝলি রে মা,তোর মায়ের রক্ত হচ্ছে সাধু সন্তদের রক্ত।অশেষ ও কম যায়না সে বলল,বাবা মামা বাড়ির কেউ তো সাধু নয়!আর যায় কোথায় এ যে লঙ্কা কাণ্ড বাঁধিয়ে ছাড়ল।অচলার সারা মুখ রক্ত শূন্য হয়ে গেল।সে ছেলেকে বলল,কেন তারা কি তোর ডাকাত?কেমন শিক্ষা দিয়েছে বাবা? শয়তানের বাচ্চা শয়তান হবে এতে আর নতুন কি?এমন সময় অনন্ত ঘরে ঢুকতেই অচিন্ত্য’র মাথা ঘুরিয়ে গেল। গম্ভীর হয়ে বলল,এতো সময় কোথায় ছিলি?অনন্ত কিছু বলার আগেই অচলা বলে উঠল,কোথায় আবার? নিশ্চিত কোন গাঁজার ঠেকে ছিল।অনন্ত মায়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে বলল , ঠিকই বলেছ, শুধু গাঁজা নয় মদ ও ছিল।এমন অশ্লীল কথা তোর আজকাল মুখে আটকাচ্ছেনা অনন্ত?বলে চোখ পাকিয়ে তাকালো তার দিকে।অনন্ত চুপ করে মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে থাকল। বাবার উপর কথা বলবে এমন সাহস তার নেই।তবু বলল,মা কেন এমন করে বলল?না বাবা এমন করে গুরুজনদের অপমান করে কথা বলতে নেই। অনেক দিন অনন্ত কাঁদেনি।আজ সে কাঁদল।
মায়ের উপর প্রতিশোধ নিতে অনন্ত যে সঙ্গ ধরেছে সেই সঙ্গ এখন ছাড়তে চাইলে ও পারছেনা।এখন বাবাকে মা বাধ্য করছে তাকে বকাবকি করতে।সে কোনদিন ভাবতে পারেনা বাবা তাকে বকাবকি করবে।এখন সংসার সেই পূর্বের অবস্থায় ফিরে এসেছে।এখন দিন রাত ঝগড়া।এখন কর্মস্থলে যেতে আরও পনেরো দিন বাকি।দূর্গা পূজার পর চলে যাবে।এখন অচিন্ত্য অচলাকে সন্তুষ্ট করতে দিন রাত অনন্তকে মরিয়া হয়ে শাসন করে।কারণ তাকে আর কিছু দিন পর চলে যেতে হবে।তাই সে আর চাইছেনা অচলাকে চটাতে।আর অচলার কথা শুনে শুনে কখন যে অচিন্ত্য নির্মম হয়ে উঠেছে তার সে নিজেই ভুলে গেছে।এখন কথায় কথায় অনন্তকে বকাবকি করে।আর বাবার কাছে বকা খেয়ে অনন্ত নিজেকে সমাজ সংসার থেকে বিচ্ছিন্ন করে নিয়েছে।এমন করে করে সবকিছু যখন সহ্য হয়ে গেছে তখন ঠিক সপ্তমী পূজোর দিন অচিন্ত্য ও অচলার তুমুল ঝগড়া। কারণ কাল রাতে অনন্ত বন্ধুদের সাথে রাত বারোটা পর্যন্ত বেড়িয়ে বাড়ি ফিরতে অচিন্ত্য দরজা খুলে অনন্ত কে ঢুকিয়েছে।সেই ঝগড়া এমন আকার নিল রান্না বান্না সব বন্ধ।তখন একটা বাজে।অনন্ত ক্যারাম খেলে বাড়ি ফিরেছে।ওকে দেখে অচিন্ত্য ক্ষিপ্র নেকড়ে হয়ে উঠে বলল,বাড়ি থেকে দূর হয়ে যা।তোর জন্য আমার কোন শান্তি নেই।এমন কুলাঙ্গার সন্তান থাকার থেকে না থাকাই ভালো।তারপর আর কি কি বলছে অচিন্ত্য,অনন্তর কানে ঢুকলনা।সে ঘরে গিয়ে শুয়ে গেল। অচিন্ত্য হোটেল থেকে খাবার কিনে এনে অনন্তকে জোর করে ধরে এনে খাওয়াতে চেষ্টা করল। কিন্তু সেই চেষ্টা বিফল হল। রাগে দুঃখে ঘৃণায় অচিন্ত্য কিছু না খেয়ে বেরিয়ে গেল।রাত তখন দশটা হবে,মন্ডপে মন্ডপে মানুষের ঢল।শীতল বাতাসে বসে মন একটু হালকা হতে বাড়ি ফিরে দেখে উঠোনে লোকের জমায়েত।ভয়ে শঙ্কায় তার পা মাটি স্পর্শ করছেনা।ভিড় ঠেলে যখন সামনে এল–অনন্ত অনন্ত সজ্জায় শায়িত–চোখ দুটি এখনও কিছু বলতে চায়–বুকের জন্ত্রনা মুখের কোণায় কোণায় লেগে আছে। অচিন্ত্য এতোদিন তার ছেলের মুখের দিকে ভালো করে তাকায়নি–এতো জন্ত্রনা—হু হু করে কেঁদে উঠলো অচিন্ত্য।অচলার চোখ খোলার মতো জ্বলছে।সাপের মতো গর্জন করতে করতে বলে উঠলো তুমি আমার অনন্তকে মেরে ফেললে?