সাপ্তাহিক ধারাবাহিক কথা সাগরে কৌশিক চক্রবর্ত্তী (ইতিহাস কথা পর্ব – ২২)
by
·
Published
· Updated
শ্রীরামপুরের কথা
লালবাজারে পুলিশদের গলায় মেডেল পরিয়ে দেবার সময় কলকাতার পুলিশ কমিশনার চার্লস টেগার্ডকে প্রথম চাক্ষুষ করে গোপীনাথ। আগে সে নাম শুনেছে অনেক। শুনেছে স্বাধীনতা আন্দোলনকারীদের ওপর তার ভয়ানক অত্যাচার আর নিপীড়নের কথা। এরপর থেকে বিভিন্ন জায়গায় জায়গায় বারবার টেগার্ড সাহেবকে সামনে পেয়েছে শ্রীরামপুরের শান্ত কিশোর গোপী। কখনক নিউ মার্কেটে, কখনো ইডেন গার্ডেনে, আবার কখনো প্রকাশ্য রাজপথে। প্রতিবার সঙ্গে রাখাও ছিল পিস্তল। কিন্তু কাজের কাজটা করে ওঠা হয় নি তার। নিরাপত্তার ঘেরাটোপ পেরিয়ে যাওয়া হয় নি সাহেবের কাছাকাছি। একটা বন্দুকের গুলিতে একেবারে শেষ করে দেবার আগে নিজের সাথেই দ্বন্দ্বে ভুগতো গোপীনাথ। কিন্তু স্বস্তিও নেই। যতদিন না অত্যাচারী টেগার্ড পৃথিবী থেকে নিকেশ হয়, ততদিন খাওয়া ঘুম সব বন্ধ হবার জোগাড় তার। অনেক অপেক্ষার পর দিনটা এসেই গেল। জায়গাটা চৌরঙ্গী, ১৩ই জানুয়ারি, ১৮২৪, লুকিয়ে থাকা গোপী টেগার্ড সাহেব ভ্রমে পিস্তল থেকে সবকটা গুলি ছুঁড়ে দিল কিলবার্ন কোম্পানির অধিকর্তা আর্নস্ট ডে সাহেবের বুকে। একবারের জন্যও মুখের দিকে ফিরে দেখেনি সে। সব গুলি খালি করে প্রকাশ্য জনতার মধ্যে দিয়ে রাজপথে দৌড় শুরু করে গোপীনাথ। সে দৌড় পালানোর দৌড় না। সে দৌড় ধরা না দেবার দৌড়। চিৎকার করে বলতে থাকে, ‘আমি দেশের কাজ করিয়াছি, বেশ ভালো কাজ করিয়াছি। ইহাতে আমার কিছুমাত্র অন্যায় হয় নাই।’
এই সমস্ত তথ্য জানা যায় গোপীনাথ সাহারই নিজস্ব জবানবন্দীর বয়ান থেকে। গ্রেপ্তার হবার পর সে জানতে পারে যে টেগার্ড নয়, তার গুলিতে প্রাণ হারিয়েছেন ডে সাহেব। বন্দী গোপীনাথের সামনে সশরীরে হাজির হয় টেগার্ড। আক্ষেপের সাথে সাহেবের সামনেই সে স্বীকার করে যে তার আসল লক্ষ্য ছিল স্বয়ং টেগার্ড সাহেবই। এমনই ছিল শ্রীরামপুর ক্ষেত্রমোহন স্ট্রিটের বীর কিশোর গোপীনাথ সাহা।
১৯০৫ সালের ৫ই ফেব্রুয়ারী কলকাতায় বিজয়কৃষ্ণ সাহা ও সুরবালা দেবীর ঘর আলো করে জন্ম নেয় গোপীনাথ। বাবার অকালমৃত্যুর পরে মায়ের সাথে পৈত্রিক ভিটে শ্রীরামপুরে ফিরে এসে হুগলী বিদ্যামন্দিরে পড়াকালীন মাস্টারমশাই ও বিপ্লবী জ্যোতিষচন্দ্র ঘোষের সান্নিধ্যে আসে সে। সেখানেই দেশসেবার হাতেখড়ি। কলকাতার কমিশনার চার্লস টেগার্ডের নির্দেশে একে একে তখন ধরা পড়ে বহু বিপ্লবী। বাদ যান নি মাস্টারমশাইও। তখন থেকেই তার টেগার্ড হত্যার সংকল্প গ্রহণ। পরিকল্পনাও শুরু তখন থেকেই। কিন্তু নিরাপত্তা বলয়ে থাকা অফিসার টেগার্ডকে হত্যা সহজ কাজ নয়। তাই সর্বক্ষণ টেগার্ডের ওপর চলত তাদের নজরদারি। অবশেষে কমিশনার হত্যার দায়িত্ব পেয়েই গেলেন গোপীনাথ। পেলেন চরম নির্দেশও। প্রাতঃভ্রমণে বেরোনো সাহেব ঘটনাচক্রে একেবারে সামনে এসে পড়ে তার। সুযোগ পেয়ে শক্ত করে বন্দুকটা ধরে পরপর সবকটা গুলি খালি করে দেয় গোপীও। কিন্তু শীতের সকালে ভুলবশত গুলিগুলো ঠাঁই নেয় ডে সাহেবের বুকে। নির্দোষ সাহেবকে খুন করবার আক্ষেপ মৃত্যুর দিন পর্যন্ত যায় নি গোপীনাথের। ১লা মার্চ ১৯২৪, প্রেসিডেন্সি জেলে হাসিমুখে ফাঁসির দড়ি বরণ করে গোপীনাথ। শোনা যায় মৃত্যুর পরে তাঁর গায়ের চাদর মাথায় তুলে কলকাতার হরিশ পার্কে মিছিল করেন নেতাজী সুভাষ চন্দ্র বসু। এরজন্য পরের দিন ব্রিটিশ জেলে বন্দীও হতে হয় নেতাজীকে।
গোপীনাথ সাহা শ্রীরামপুরের বুকে একটি স্ফুলিঙ্গের নাম। আজও শ্রীরামপুর শহর বুকে করে ধরে রেখেছে শহীদ গোপীনাথের স্মৃতি। মিশনারীর শহর চোখ চেয়ে দেখেছে দেশের জন্য ১৯ বছরের দামাল ছেলেটার এই স্মরণীয় আত্মত্যাগ।