কালিঝোরা জায়গাটি কেমন জান? এই সেবক থেকে পাহাড়ে পাঁক খেয়ে খেয়ে অনেক উঁচুতে উঠলাম তারপর বাঘপুলের পরে পাহাড়ী পথ ধীরে- ধীরে একদম সমতলের মতন উচ্চতায় নেমে এলো। চারিদিকে পাহাড় দূরে সবুজ পাহাড়ের কোলঘেঁষে তিস্তানদী নীচে বয়ে যাচ্ছে। যে ছোট্ট একটা সেতু পেরিয়ে বনভোজনের বা পিকনিক দলের লরীগুলো তিস্তার বিস্তীর্ণ বালি পাথর নুড়ির চরে আসত, সেই সেতুটি কালিঝোরা বা কালিনদীর ওপরে। এই জন্যই নাম কালিঝোরা। ঝোরা মানে পাহাড়ী ঝর্ণা। বর্ষার ভরা জলে এরা খুব ভয়ংকর। তখন কালিনদী আর তিস্তা মিলেমিশে ভয়াল ভয়ংকর, আওয়াজে উত্তাল স্রোতের শব্দে, যারা দেখেছে তারা জানে। তিস্তার সেই রুদ্র রূপের সাক্ষী ১৯৬৮ সালের সমতলের জলপাইগুড়ি শহর। একরাতে তিস্তার বাঁধ ভেঙ্গে শহরটি বিধ্বস্ত হয়ে পড়েছিল। দশহাজার লোকের প্রাণহানি ঘটেছিল। আমরা শীতের পিকনিক দলে গভীর সবুজ জলের ধীরলয়ে বয়ে যাওয়া তিস্তার পাড়ে একদিনের আমোদ- প্রমোদে ব্যাস্ত।
সকালে নেমেই ডিম পাঁওরুটি কমলালেবু এইসবে ব্রেকফাস্ট করেছি। ব্যাডমিন্টনের সরঞ্জাম নিয়ে হাজির। এখানে ওখানে সতরঞ্জি পেতে বড়রা গল্পে মশগুল। আর থেকে থেকে মায়েদের নিষেধ– জলের ধারে যাবিনা, পা পিছলে নদীতে পড়বি। কিন্তু মন যে পড়ে থাকে নদীর পাড়ে জলের ধারেই। আমরা অঢেল বিভিন্ন রঙের নুড়ি পাথর থেকে চ্যাপ্টা প্রায় লুচি আকারের পাথর বেছে তিস্তার জলের ওপর চাকতির মতন ছুঁড়ে ব্যাঙ নাচানো বা গোল- গোল লুচি কিংবা বৃত্ত বানাচ্ছিলাম জলের ওপর, দেখি বেশি গোল কে বানাতে পারে? অদ্ভূত সে আনন্দ আর অদ্ভূত সেই খেলা! তোমরা কখনও খেলেছ পুকুরে বিলে? খেলা ভালোই চলছিল বাদ সাধলো নিরঞ্জন বলে একটি ছেলে তিস্তার জলে শীতের জামা সোয়েটার প্যান্ট ভিজিয়ে একসা। বড়দের ধাওয়া আর চেল্লানীতে তারপর নদীর ধার থেকে দূরে বালি পাথরের চরে ব্যাডমিন্টন খেলায় মাতলাম। একটু বড় ছেলে-মেয়েরা খেলছিল পিট্টু। ওখানেও হৈ চৈ হচ্ছিল। আমরা ছোটো তাই নো এন্ট্রি ওখানে। বাবা এবং বাবার মতন বয়সীদের গুরুগম্ভীর ভাব ছেড়ে হাসি হুল্লোড় তাসখেলায় মত্ত। বাড়ির চেনা ছকের বাইরে এইভাবে দঙ্গল বেঁধে জীবনে বেরিয়ে পড়া সত্যি ভাল। মনটা তরতাজা হয়ে ওঠে একঘেয়েমী থেকে।
(শিলিগুড়ি থেকে তোলা কাঞ্চনজঙ্ঘা, ফটো সৌজন্য : গৌতম বাড়ই)
পাথর কুড়োচ্ছিলাম। পাথরে পাথরে ঠোকাঠুকি করে আগুনের ফুলকি তৈরী করছিলাম। সাদা পাথর দিয়ে। তারপর নাকে শুঁকে সেই পোড়াগন্ধ নিচ্ছিলাম। এখনও টের পাই। পুরানো স্মৃতির গন্ধ কী আর হারায়! বারূদের গন্ধের মতন। তারপর চারিদিকটা মাংস রান্নার গন্ধে ভরে উঠল। আমাদের সবার খুব খিদে পেতে শুরু করল। ছোটরা সব বড়রা ডাকবার আগেই রান্নার কাছাকাছি চলে এলাম। বড়রা বলছে– এবার তোদের খাবারের ব্যাবস্থা করছি। একটু অপেক্ষা কর।
এখনকার মতন চেয়ার টেবিল নয়, স্রেফ সতরঞ্জি ভাঁজ করে শালপাতা আর মাটির খুড়িতে খাবারদাবারের আয়োজন শুরু হল। আমরা হৈ চৈ করে ছোটরা খেতে শুরু করলাম। মনে আছে সেদিনের মেনু– ডাল, আলুভাজা, আলু-ফুলকপির ডালনা, খাসির মাংস আর টমাটোর চাটনি। শেষ পাতে মিষ্টি ছিলনা। খাসির মাংসের সাথে গন্ধরাজ লেবু ছিল। খেলাম তারপর আবার একপ্রস্থ খেলা। এমন সুন্দর জায়গায় না খেললে হয়। আর বড়রাও খাওয়াদাওয়াতে ব্যাস্ত। সবুজ পাহাড় চারিদিকে। কলাগাছ পাহাড়ের গায়। একপাল বাঁদরকেও দেখলাম। হঠাৎ আমাদের শীত করতে লাগল, পাহাড়ের হিমেল হাওয়া বইছে। আলোটাও বুঝি কমে এল। বড়দের দিকে তাকিয়ে বুঝলাম, যা হুটোপুটি চলছে এবারে আমাদের ঘরে ফেরার পালা। আশপাশে অনেক পিকনিকের দল, লরী- জিপ আর একটা ছোটোবাসও দেখলাম। এবারে পাহাড়ে উঠতে জ্যাম লেগে যাবে সন্ধের আগেই সেবক পাহাড় থেকে নেমে যাব আমরা, তোমরা সবাই গাড়িতে ওঠো– বড়রা বলছে।
(ঘনজঙ্গলে গুলটি হাতে বনবসতির মেয়ে। ফটো সৌজন্য পাপুন ভট্টাচার্য্য)
সবাই যে যার নিজের লোকজন নিয়ে লরীতে বা ট্রাকে চেপে বসল। গাড়িগুলোর হেডলাইট জ্বলে উঠলো। চারিদিকে গাড়ি আর লোকজনের কর্কশ আওয়াজে সারাদিনের মজাটি মারা গেল । বড়রা কী যে করে!
নদীর চর বেয়ে গাড়িগুলি যেন পাহাড়ের রাস্তায় পৌঁছাতেই পারছে না। গঁ গঁ আওয়াজ। ইধার যাও উধার যাও হেঁইয়ো রুককে বায়া চলো ডাইনা চলো– এইসব আওয়াজ ভেসে আসতে লাগল। সন্ধের আগে! কালিঝোরার রাস্তা ধরতেই যেন রাত গড়িয়ে এলো। পাহাড়ের অন্ধকার ঝুপ করেই পড়ে।
শুনতে পেলাম আমাদের সামনে দুটি গাড়ি আগে একটি গাড়ি খারাপ হয়ে পড়েছে। তাতেই যত বিপত্তি। তবে আর ভালো লাগছিল না গাড়ির ধোঁয়া হৈ চৈ- এ। ভাবছি কখন গিয়ে বাড়িতে পৌঁছাবো। অন্ধকারে পাহাড় অদৃশ্য। কাঁহাতক আর ভালো লাগে? ভালো লাগবার আর উপকরণ কোথায়?