সত্যি কী তাড়াতাড়ি নেমে এলাম পাহাড় ছেড়ে সমতলে। অথচ কত নয়নাভিরাম দৃশ্য দেখতে দেখতে পাহাড়ে চড়া। আজ মনে হয়, উপরে উঠতে যতটা সময় লাগে, নিচে নামতে গেলে এখনও ভাবি কত তাড়াতাড়ি সেটা হয়ে যায়। তোমাদের বয়স কম তোমরাও জীবনের প্রতিটি বাঁকে দেখবে সাফল্য কিন্তু সহজে আসবে না, তার জন্য অনেক পরিশ্রম অনেক সময় লাগে। তো আমরা নিচে গাড়িধূরা- তে এসে সামান্য জিরিয়ে নিলাম। গরম সিঙ্গাড়া আর গরম চা খেয়েছিলাম। তারপরেও অনেক অনেকবার খেয়েছি, মুখে অর্থাৎ জিভের স্বাদ কোরকে এখনও লেগে আছে সেদিনের সেই প্রথম খাওয়া। প্রথম দেখা পাহাড়ের সেই পাঁকদন্ডী পথ, সেই আলোর রহস্য, সেই ভয়ংকর সুন্দর আজও ভুলতে পারিনা।
(ফটো সৌজন্য: গৌতম বাড়ই)
আমাদের চিন্তা- ভাবনার জন্য উন্মুক্ত আকাশ। খোলা মাঠঘাট, আমরা তরাইয়ের শাল- সেগুনের গন্ধ গায়েমাখা লোকজন। আমাদের নদীদের নাম ছিল ফুলেশ্বরী, জোড়াপাণি, সাহু, করতোয়া, লসকা, মহানন্দা বালাসন তো আছেই। তখনও দেখতাম এখনও দেখি পর্যটক সে হাতে গোনা । অধিকাংশ কেনাকাটা আর আমোদ প্রমোদে ব্যস্ত। একটা দিন থেকে শিলিগুড়িকে আর তার চারপাশে অনেককিছু দেখে নেওয়া যায়। শিলিগুড়িকে সবাই ভাবে উত্তরবঙ্গের বাণিজ্যিক রাজধানী। দোকানপাট বড় বড় শপিংমল বাজারের শহর।দেখার মতন কী আছে? আছে- আছে। পাহাড় ঝোরা বন জঙ্গল আছে একে ঘিরে চারপাশে। গাড়ি নিয়ে হুসহাস উঠে গেলে হাজার পায়ের দঙ্গলে পা মেলালে তার কী আর দেখা পাওয়া যাবে?
আমাদের ছোটোবেলায় সে আমাদের পাড়া ছেড়ে প্রথম চড়ুইভাতি। ট্রাকে করে ত্রিপল বিছিয়ে সকাল সকাল বেরিয়ে পড়া। সেবক পাহাড়ের গভীর খাদ। চোখ নামালেই সবুজ জলের ধারা ঐ অতো নিচে। দার্জিলিং- র রাস্তা একরকম, আর এই সেবক হয়ে তিস্তাবাজার, রম্ভী, কালিঝোরা, কালিম্পং, গ্যাংটকের রাস্তা আর একরকম। প্রকৃতির সৌন্দর্য স্থানবিশেষে কী এক অপরূপ ভাবে পাল্টে যায়। সেখানকার মানুষ প্রকৃতি বাড়িঘর স্থানীয় মানুষের চলন বলন কথনেও। প্রতিটি জেলায় গেলেও একটু হলেও এ পার্থক্য চোখে পড়বেই পড়বে। বীরভূমের গ্রাম আর দার্জিলিং জেলার শিলিগুড়ি মহকুমার তরাইয়ের গ্রাম তো এক নয়! যে যার মতন সুন্দর। ওখানে লালমাটির রাস্তা, এখানে বালি নুড়ি বিছানো। একসময় তিস্তার ওপরে এ পথে শিলিগুড়ি থেকে রেলিগোলা পর্যন্ত টয়ট্রেন- ও চলত। তার লাইন এখনও কোথাও কোথাও পাতা আছে। দশমাইলের জঙ্গলে আগে দেখাও যেত। তোমরা অনেকেই হয়ত তা জাননা।
(ফটো সৌজন্য: গৌতম বাড়ই)
এবারে বলি, আমরা সেই শীত সকালে চললাম পিকনিক করতে। মাঝে খাড়াই নিচে তিস্তা নদী। সবাই হৈ চৈ করছে আনন্দে। বড়রা ধমক দিচ্ছে চুপ! চুপ! পাহাড়ি পথে বেশি কথা বলতে নেই।
এভাবে একসময় এলো করোনেশন ব্রীজ। বাঘপুল স্থানীয়রা বলে। অনেক অনেক বছর আগে সন্ধে নামলেই নাকি পাহাড়ি চিতারা ঘুরে বেড়াত এখানে। তাই বাঘপুল। এর স্থাপত্য দেখবার মতন। ছবির মতন দু- পাড়ের দুটো পাহাড়কে জোড়া লাগিয়েছে। বাঘপুলধরে ডানহাতে গেলে আমরা ডুয়ার্সে প্রবেশ করব। আর সোজারাস্তা সিকিম চলে গিয়েছে। গ্যাংটকের দিকে। আমরা সেই রাস্তা ধরে কিছুদূর গিয়ে কালিঝোরা বলে এক অপরূপ সুন্দর জায়গা রয়েছে, চারিদিকে পাহাড় মাঝে তিস্তার ওপর বিস্তীর্ণ বালির চরের ওপর হবে পিকনিক। লরি থেকে নামতেই মুগ্ধ হয়ে গেলাম প্রকৃতি দেখে। ওপরে পাহাড়ের মাথার ওপর কাঠের এক সুদৃশ্য বনবাংলো বাড়ি। পরে জেনেছিলাম ঐ বাংলোতেই শুটিং হয়েছিল ‘অনুসন্ধান’ বলে একটি সুপারহিট বাংলা ফিল্মের। অমিতাভ বচ্চন ছিলেন মুখ্য চরিত্রে।
(ফটো সৌজন্য: গৌতম বাড়ই)
সময়ের সাথে কত কী বদলায়- ও। সেই পুরানো বাংলো আজ আর নেই। রাজনৈতিক ডামাডোলে কবেই পুড়ে ছাই হয়েছে। সেখানে নতুন একটি বাংলো। আর কালিঝোরার ঐ অপরূপ সৌন্দর্য আজ মৃত কারণ বড় হাইডেল প্রোজেক্টের কল্যাণে।
স্মৃতি বেঁচে থাকে পুরানো কিছু নিয়ে। স্থান বেঁচে থাকে নতুন কিছু নিয়ে। থাকুক।
এর পরের সপ্তাহে নদীর পারের পিকনিক। তোমরা জানিও কেমন লাগছে? এ পুরানো কথা শুনতে।