• Uncategorized
  • 0

সাপ্তাহিক ধারাবাহিক কথা সাগরে শম্পা রায় বোস (পর্ব – ১৬)

আমার মেয়েবেলা

দুর্গা পুজো 

দুর্গা পুজোর ষষ্ঠীর দিন বাবা বেশ অস্থির হয়ে উঠত। মা এর উপোস। মার কী খাওয়া উচিত আর অনুচিত এই নিয়ে একটা সার্ভে করে বাড়ি ফিরত। লুচি আর সাদা আলুর তরকারি হতই। মা বেলে দিত আর বাবা ভাজত। ভাল লাগত বেশ একটা টোনাটুনির সংসার দেখতে। আর এই রকম একটা সংসার দেখতে দেখতে বড়ো হওয়া আমি বিয়ের পর পড়লাম কিনা প্রায় ১৭|১৮ জন সদস্যের এক যৌথ পরিবারে । যেখানে বাড়ির বৌ ঝি রা তাদের স্বামীর সঙ্গে, শ্বশুড়ের সঙ্গে বসে খাওয়ার কথা ভাবতেই পারে না। বাড়ির পুরুষ মানুষেরা লুচি ভাজবে কী!!! রান্না ঘরটাই বছরে কদিন দেখে তা গুনে বলে দিতে পারবে। সে কথা না হয় পরে একদিন,,,,,,

ষষ্ঠীর দিন সকাল সকাল স্নান সেরে নতুন জামা প্যান্ট পরে চলে যেতাম মন্ডপে। ঠাকুর মশাই দের পুজো করা দেখতাম।
একজন ঠাকুর মশাই এর কাছ থেকে জেনেছিলাম ষষ্ঠীর দিন প্রথমে
গণেশ কে পুজো করা হয় তারপর শিব, সূর্য, বিষ্ণু ও শেষে মা দুর্গার পুজো আরম্ভ হয়। প্রথমে
কল্পারম্ভ পুজো, তারপর বোধন, তারপর আমন্ত্রণ, শেষে অধিবাস। এই হল পুজোর নিয়ম। কেন এত জানার ইচ্ছে ছিল জানিনা। হয়তো পরবর্তী তে ঠাকুর পরিবারে বিয়ে হবে বলেই। ভগবান তো আগে থেকেই সব ঠিক করে রাখেন।
মৃত্যুঃ সর্বহসর্বহরশ্চাহমুদ্ভশ্চ ভবিষ্যতাম্ ।
————অর্থাৎ আমি সর্ব সংহারকর্তা মৃত্যু এবং ভবিষ্যতে যা কিছু ঘটবে আমি তাদের উৎপত্তির কারণ।
তাই আমি শেষ পর্যন্ত কোথায় গিয়ে পড়ব সেটাও ঠিক করা ছিল। আর সে গল্পই বলব এখন,,,,,,
আমাদের সংসারে অত বেশি স্বাচ্ছন্দ্য ছিল না। কিন্তু আনন্দ ছিল। আমার ভাইও খুব ভাল গান গাইত। নাটক লিখত। সেই নাটক আবার পরিচালনাও করত। গানের আসর বসতো বাড়িতে।
আমাদের কিন্তু অনেক জামা ছিল না, বড়ো রেস্তারাঁ ছিল না, ফুচকা ছিল না,,বড়সড় প্যান্ডেল ছিল না,,আলোর রোশনাই ছিল না,, অনেক ঠাকুর দেখা ছিল না,
সারাদিনের ক্লান্তি তে কোনও কোনও দিন সন্ধ্যায় মন্ডপে যাওয়াই হোতো না। তবু যেন কত কী ছিল যা আজও ভুলতে পারি না।
একদিন এক অষ্টমীর রাতে আমরা সবাই বাড়িতে । মা বলেছিল “এবার পূজোয় তো নতুন কিছু পরলিই না,, আমার একটা শাড়ি পর।” তখন আমার বয়স তের কি চোদ্দ। সেই বছর থেকেই পুজোতে নতুন জামা পরা বন্ধ করেছিলাম। আমাদের ওখানে আশেপাশের গ্রামের অনেক গরীব লোক আসত পুজো দেখতে। ওদের দেখেই মনে হয়ে ছিল- আর নয়। পুরনো জামা পরেই ঠাকুর দেখব।
তো যাই হোক। সেদিন আমি মায়ের লাল রঙের, সবুজ পাড়ের একটা তাঁতের শাড়ি পরেছিলাম । সাধারণ ভাবে শাড়িটা পরে আলতো ঘোমটাও দিয়ে ছিলাম ।
আমার শাড়ি পরা দেখে ওরা খুব অবাক হয়ে গিয়েছিল। ওই ভাবে কী করে যে আমি শাড়িটা পরলাম ভেবেই পাচ্ছিল না। কেউ তো আমায় শিখিয়ে দেয় নি।
ভাই তো হেসে লুটোপুটি খাচ্ছে, মাও অবাক চোখে মুচকি মুচকি হাসছে। ভাই হেসে বলেছিল মা দিদি কেমন ঠাকুমার মতো শাড়ি পরেছে দেখ, ওর বিয়ে দিয়ে দাও। বাবা চোখ ভর্তি জল নিয়ে অনেকক্ষণ আমার দিকে তাকিয়ে ছিল। বুকের মধ্যে হয়তো মেয়ে বিদায়ের করুণ সুর বেজে উঠেছিল!
সেদিন ঘোমটাটা টেনে আত্মবিশ্বাসের সুরে বলেছিলাম ” আজ হাসছো তো? একদিন আমার এমনই একটা জায়গায় বিয়ে হবে যেখানে আমি এইভাবে ঘোমটা দেব। বাড়িতে দুর্গাপুজো হবে। বাইরে বেড়োনোর সময়ই পাব না আর তোমাদের কাছে পুজোতে আসতেও পারব না।
আজ আমি এমনই এক পরিবারের গৃহবধূ। নিজের বাড়ির পুজো নিয়েই মেতে থাকি। সেই সাধারণ ভাবেই শাড়ি পরি। আসলে আমি খুব ছোট বেলায় আমার ঠাকুমা কে দেখেছিলাম ঐ ভাবে শাড়ি পরতে। তাই হয়তো পরতে পেরেছিলাম ঐ ভাবে (কুচি না দিয়ে সাধারণ ভাবে)।
পিছনের কথা মনে করলে যন্ত্রণার কাঁটা গুলো বড্ড কষ্ট দেয়। আচমকা বলা কথা যে এভাবে ফলে যাবে বুঝতে পারিনি। বিয়ের পর আমি পুজোতে কোনও দিন আর বাপের বাড়ি যেতে পারিনি।
পুজোর সময় আমার ননদেরা, আমার পিসি শাশুড়িরা আসতেন।
ওরা কত আনন্দ করতেন, সারা বাড়িতে একটা যেন পুজো পুজো গন্ধ বেরোত। আমারও খুব আনন্দ হত।
কথা বলার আনন্দে আমিও মিশে যেতাম ওদের সঙ্গে। ওদের বাবা মা ডাকে বাড়িটা কেমন গমগম করত। আমার ভাল লাগত এই ভেবে যে আমার শান্ত বাড়িটা কেমন আনন্দে ভরে উঠেছে। আবার খুব কষ্টও হত। ওদের হাসি গল্পে আমার তো কোনও ভূমিকা ছিল না। ওদের ছোট বেলার গল্পে আমি কোথায়? চুপ করে শুনতাম। কোন কোন সময় চলে যেতাম আমার মেয়ে বেলার পুজোয়। বুকের ভেতর একটা কেমন জ্বালা জ্বালা যন্ত্রণা হত। আমি ওদের হিংসে করতাম না। কিন্তু ওদের গল্পের সময় ওখানে থাকতে পারতাম না। ঐ আসরে আমার পরিবার কে খুঁজতাম। ফাঁকা ফাঁকা লাগত। মনে হত এই আনন্দের সময় যদি বাবা মা ভাই থাকত!
শ্বশুড় বাড়ির ওরা সবাই আমাকে ভালবাসত, তবুও যেন ওদের আচার আচরণে আমি যে অন্য পরিবারের সেটাও প্রকাশ পেত। ওদের কথাবার্তায় কিসের যেন একটা খোঁচা থাকত। সব সময় একটা যেন নিচু করার চেষ্টা। আমি বুঝেও না বোঝার ভান করতাম। একটা সুসম্পর্ক গড়ে তোলার চেষ্টায় আমিও চাইতাম ওদের বলতে, আমার মেয়েবেলার পুজো।
কিন্তু আমার মেয়েবেলার পুজো তো ছিল অতি সাধারণ। সেখানে তো কোনও বনেদি গন্ধ ছিল না। তাই তেমন আকর্ষণীয় ছিল না ওদের কাছে। তবে আমি ওদের দোষ দিই না। কলকাতার পুজোর কাছে আমাদের ঐ ত্রিপলের প্যান্ডেলওলা পুজো পাত্তা পাবে কেন?
কোনও দিন একান্নবর্তি পরিবারে থাকিনি। তাই ওদের ব্যবহারে মাঝে মাঝে আমাকে ভাবতে বাধ্য করত বলা যায় মনে করাতে বাধ্য করত আমার বাড়ির সংস্কৃতি ওদের থেকে আলাদা। এবং ওদের টাই শ্রেষ্ঠ। উত্তর কলকাতার বনেদিয়ানার এটা একটা দিক।
তবে হ্যাঁ এটা বুঝতে পারতাম ওদের মানসিকতার সঙ্গে আমার মানসিকতার কোনও মিল নেই। আমি কলকাতার হোস্টেলে অনেক বছর কাটানোর ফলে আমার মানসিকতার কিছু পরিবর্তন হয়েছিল। আমি অপ্রিয় সত্য কথা, বলা যায় অত্যন্ত স্পষ্টভাষী, স্ত্রী স্বাধীনতায় বিশ্বাসী, কুসংস্কারহীন, সাহসী, অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদী এবং অবশ্যই ব্যক্তিত্বময়ী ছিলাম যা আমার পরিবারে কখনও গ্রহণযোগ্য ছিল না। আমি সোনার গয়নার থেকে শিক্ষাকে বেশি গুরুত্ব দিতাম। বাপ ঠাকুরদার অর্জিত সম্মানে সম্মানিত বোধ করে অপরকে অসম্মান করার পক্ষপাতী কখনও ছিলাম না। সব সময় নিজের অর্জিত সম্মানেই সম্মানিত হতে চাইতাম।
বেশিরভাগ সময়েই আমি ভিজে চোখে চলে আসতাম নিজের ঘরে। আসলে একান্নবর্তি পরিবারে আসার আগে একটি মেয়েকে যে, রাজনীতির পাঠ যাকে বলে জয়েন্ট ফ্যামিলির নোংরা পলিটিক্স
শেখানো যে অত্যন্ত জরুরি,,, সেই পাঠ আমার বাবা মা আমাকে দেওয়ার কথা ভাবেই নি। অবশ্য ওরা জানতও না। ফলে আমার ভেতরের যে ছটফটে মেয়েটা সারাদিন হাজিবিজি কথা বলত, নেচে নেচে বেড়াত,,
সেটা আসতে আসতে শুকিয়ে যেতে লাগল বনেদি পরিবারের সূক্ষ্ম, অতি সূক্ষ্ম রাজনীতির খেলায়। একটু একটু করে, আমি আমার সেই আমিটাকে হারিয়েই ফেললাম। নিজের মধ্যেই একটা জগত তৈরি করে গুটোতে শুরু করলাম।আর
এইভাবে গুটিয়ে যেতে যেতে প্রথমে হারালাম আমার কথা। তারপর আমার গলার স্বর। যে গলার স্বর শুনে সেই সময় অনেকেই বলেছিল আমি নাকি এই গান গেয়েই অনেক বড় হব। আর যে আমি প্রতিদিন স্কুলে কথা বলার জন্য শাস্তি পেতাম সেই আমি এখন কথা না বলতে বলতে আর কথা বলতেই পারি না। কথা বলার সময় গলা ব্যথা করে।
ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।