বুটাই বলল, ‘মান্তু মাসিকো তো আভি ঢুননা পরেগা।’
বুটাই আমার সঙ্গে বাংলাতেই কথা বলে। খুব উত্তেজিত হয়ে পড়লে ওর মুখ থেকে হিন্দি বেরুতে থাকে।
আমরা পশ্চিমবঙ্গের বাইরে থাকি। ওখানে আমরা যে যার বাড়িতে বাংলাতে কথা বললেও বাইরে বাধ্য হয়ে হিন্দিতেই বলতে হয়।
আমার বাবা মেসোমশাই সবসময় বলে যদি কোনোদিন পশ্চিমবঙ্গে কাজের পরিস্থিতি তৈরি হয় তবে আবার এখানে চল আসবে। এখন এখানে এলে মান্তুমাসি আমাদের সবাইকে বহিরাগত বলে। শুনলে সবারই খুব মন খারাপ হয়।
কলকাতায় এলে বুটাই আর আমি সারাক্ষণ বাংলাতে কথা বলে খুব আনন্দ পাই। এখানে দাদু আমাদের জন্য জমি কিনে বাড়ি তৈরি করে রাখছে। মান্তুমাসির হাতে টাকা দিয়ে সেই দায়িত্ব দিয়েছে। সেই বাড়ি অর্ধেক হয়ে মুখ থুবড়ে পড়ে আছে। এই নিয়ে হিসেব চাইবার জন্য ও অন্যান্য বিষয় নিয়ে কথা বলতে দাদু এসেছে।
আমাদের দেখলেই মান্তুমাসির মাথা গরম হয়ে যায়।
একদিন দাদু বাড়ি তৈরির টাকার হিসেব চাইতেই মান্তুমাসি বলল, ‘তুই সব টাকা দিয়েছিস? যে হিসেব চাইছিস?’
দাদু এমন তুই তোকারি শুনে গম্ভীর হয়ে গেল।
মা আর ছোটোমাসি শুনে বলল, ‘ইস দিদিটার বারোটা বেজে গেছে। বাবাকে তুই বলে দিল!’
শুনে মান্তুমাসি বলল, ‘এই নো ফুসুর ফাসুর। এইরকম করেগা তো হাম গুষ্টিশুদ্ধ সবকো হটাকে ভাগাকে পাঠাকে দেগা।
এখন আমরা সবাই বাজারে এসে উত্তেজিত। বুটাই ওর নাক মুছবার জন্য পকেট থেকে লাল রুমাল বের করতেই একটা ষাঁড় যেভাবে তেড়ে এসেছিল আর একটু হলেই ওর খব খারাপ অবস্থা হত। সেই সময় মান্তুমাসি ভয়ে পায়ে প্লাস্টার নিয়েই হুইলচেয়ারের তোয়াক্কা না করে যে কী করে এক ছুটে হাওয়া হয়ে গেল তাই নিয়ে সবাই চিন্তিত হয়ে পড়লাম।
দাদু বঙ্কা আর শঙ্কামামাকে ডেকে বলল, ‘তোরা ঠিক করে বলত ডাক্তার সত্যি সত্যি কি বলেছে? মান্তুর পায়ে কি সত্যিই কিছু হয়েছে। না ও ডাক্তারকে টাকা দিয়ে ম্যানেজ করেছে।’
বঙ্কামামা রেগে গেল। বলল, ‘তুমি বাবা হয়ে এইরকম কথা বলতে পারলে? টাকা দিয়ে ম্যানেজ করার কথা বলতে তোমার খারাপ লাগল না? দিদি তো তোমারই ঘরের মেয়ে। তুমি দিদিকে চেন না? তোমার কি এটা বলা ঠিক হল?’
দাদু বলল, ‘ওকে তোর আগে থেকেই আমি চিনি। তাই বলছি। আগেও তো দেখছি ওর অনেক কাণ্ড। তাই ওর রকম-সকম দেখলে সন্দেহ হয়।’
বঙ্কা আর শঙ্কামামা একসঙ্গে বলে উঠল, ‘আমরা কি তাহলে এমনি এমনি হুইলচেয়ার ঠেলে বেড়াচ্ছি?’
অঙ্কামামা বলল, ‘তোদের রোজ কত করে দেয় রে?’
বঙ্কামামা বলল, ‘তোমার সঙ্গে কথা বলছি না। ইচ্ছেও নেই। তোমার কথার জবাব দেব না।’
‘রেগে যাচ্ছিস কেন? দু’টো কর্মসংস্থান হল। তাই বলছি। এটা কি কম কথা?’
দাদু বলল, ‘এখন ঝগড়া করার সময় নয়। হুইলচেয়ারটা নিয়ে চল। মেয়েটাকে খুঁজে বের করি।’
মা আর ছোটোমাসি দু’জনেই একসঙ্গে বলল, ‘কী জ্বালা।’
বঙ্কা আর শঙ্কা মামা হুইলচেয়ারটা ঠেলে নিয়ে আমাদের সঙ্গে চলল।
দেখি একটা দোকানের সামনে বসে মান্তুমাসি ঠোঙা থেকে কিছু খাচ্ছে। বুটাই এগিয়ে গিয়ে বলল, ‘মৌসি মিল গয়া।’
মান্তুমাসি আমাদের দেখে বলল, ‘খাবি?’
বুটাই বলল, ‘কি?’
‘মুড়ি আর চপ। এখানকার শ্রেষ্ঠ শিল্প। মুম্বাইতে যেমন পাওভাজি। আমি সবজান্তা হায়।’
দাদু এসে দাঁড়াতেই মান্তুমাসির মুখের ভাব বদলে গেল। কাঁদো কাঁদো মুখ করে বলল, ‘একটা ষাঁড় আমাকে ধাক্কা দেকে এখানে ফেলকে গিয়া হায়।’
‘একটা ষাঁড় তোকে ধাক্কা দিয়ে এখানে ফেলে গেছে! বাজে কথা বাদ দিয়ে বাড়ি চল। কি হয়েছে আমরা সবাই দেখেছি।’
‘আমি কি মিথ্যা কথা বলছি?’
আমার মা বলল, ‘দিদি ওঠ বাড়ি চল।’
‘চারিদিকে কেমন নদীর জল। আমি যেতে পারব না।’ মান্তুমাসি বলল।
ছোটোমাসি বলল, ‘নদীর জল মানে?’
‘দেখ না ষাঁড়টা ধাক্কা দিয়ে আমাকে এনে এই সবজে নদীতে এনে ফেলল। দেখলাম নদীর জলে আমার মাথা ফেটে যাওয়ার রক্তের দাগ লেগে আছে। কি রক্ত কি রক্ত! মাথা ঘুরে যাবে।’
বুটাই বলল, ‘নদীমে পানি থা, না পত্থর থা? পানিমে দাগ! তাজ্জব বাত!’
মান্তুমাসি বুটাইয়ের কথায় কান দিল না। বলল, ‘আমি দেখলাম ওই নদীর মধ্যে অনেকে মরে পড়ে আছে। ওরা আমাকে ডাকছিল। আমার সঙ্গে কথা বলতে চায়। সবাই কাঁদছে। ওদের দুঃখের কথা জানাতে চাইছে।ওই ষাঁড়টা সবাইকে মেরেছে। এখনও আমি ওদের কান্নার শব্দ শুনতে পাচ্ছি। ওরা আমার কাছে বিচার চায়। ষাঁড়টাকে যে করে হোক আমাকে শাস্তি দিতে হবে। দেখছিস না সবাই কেমন আমার চারপাশে দাঁড়িয়ে আছে। কারও মাথা নেই। অনেকের হাত পা নেই। আমাকেও ষাঁড়টা ওইরকম করতে চেয়েছিল। এটা কেউ ষড়যন্ত্র করে করেছে আমার সঙ্গে। আমি তাকে ছাড়ব না। সুস্থ হই। তারপর ইঞ্চিতে ইঞ্চিতে দেখে নেব।’ মান্তুমাসি অঙ্কামামার দিকে তাকাল।
ছোটোমাসি হাত বাড়িয়ে বলল, ‘দিদি বাড়ি চল। তুই বাজারে না এলেই ভালো করতি। এবার তোর মাথাটাও খারাপ হয়ে যাবে।’
মান্তুমাসি ছোটোমাসিকে কাছে টেনে বলল, ‘জানিস ওই ছায়া ছায়া দুঃখী লোকগুলো আমাকে মর্গে যাবার কথা বলছিল। আমি গুটি গুটি পায়ে ওদের পিছনে চলেও গিয়েছিলাম।’
ছোটোমাসি বলল, ‘সর্বনাশ। দিদি তুই মর্গে গেলি?’
‘গেলাম। কিন্তু মর্গে ঢোকার আগে কে যেন আমাকে ধাক্কা দিয়ে থামিয়ে দিল।’
‘উফ্। কেমন গা ছমছম ব্যাপার। খুব বেঁচে গেছিস।’
‘তুই তো জানিস আমার হাতে একটা বিশ্বকর্মা মাইকির বাটালিমুখি কবচ আছে। তার জন্য আমাকে কেউ কিস্সু করতে পারবে না।’
দাদু ইশারা করতেই বঙ্কা আর শঙ্কামামা মান্তুমাসিকে জোর করে হুইলচেয়ারে বসাল। অঙ্কামামাকে বলল, ‘দাদা তুইও হাত লাগা। একটু ঠেল।’
অঙ্কামামা বলল, ‘আমি পারব না। অনেক সহ্য করেছি। আর নয়। তোরাও ঠেলিস না। দিদি এমনিই যেতে পারবে। হুইলচেয়ারে বসে সিমপ্যাথি আদায় করার চেষ্টা করছে। এখন আবার বলছে সবজে নদীর জলে রক্তের দাগ। এখানে নদী কোথায়? থাকলেও জলে রক্তের দাগ থাকে? জল তো বয়ে যায়। সব চালাকি হচ্ছে? সবার মনটা অন্যদিকে ঘুরিয়ে দেওয়া হচ্ছে? আজব কথা, বিশ্বকর্মা মাইকি। শুনলেও হাসি পায়। আমি কালই খবরের কাগজে বিজ্ঞাপন দেব। সেকেন্ডহ্যান্ড হুইলচেয়ার বিক্রি আছে।’
মান্তুমাসি বলল, ‘বঙ্কা শঙ্কা তোরা আমার হয়ে কথা বলবি। কোনো গদ্দারের সঙ্গে কথা হবে না। আমি এতদিন দুধকলা দিয়ে কালসাপ পুষেছি। আমি বাবাকে ম্যানেজ করে আবার সংসার চালাবার দায়িত্বটা হাতে পাই তারপর এইসব গদ্দারকে তাড়িয়ে দেব। আমার আশীর্বাদের কথা ভুলে গিয়ে এখন বাবা বাবা করে ন্যাকামি করছে। আমি সব বুঝি। আমার হাতে কবচ আছে। আমি মন্ত্র পাঠ করতে জানি।’
মান্তুমাসি মন্ত্রপাঠ করতে যাওয়ার আগেই বঙ্কা আর শঙ্কামামা হুইল চেয়ার ঠেলতে শুরু করল।
মা বাবা আর মেসোকে বলেছিল,আমাদের সঙ্গে বাজারে আসার জন্য।
বাবা বলল, ‘দেখ কতবছর বাদে কলকাতায় এলাম। আকাদেমিতে দু’টো দুর্দান্ত নাটক আছে। আমরা কোনো বাজে নাটক দেখতে চাই না।
মা বলল, ‘দিদি নাটক করে?’
‘তোমার দিদির নাটকের কথা কখন বললাম? তবে কদিন ধরে যা চলছে বাড়িতে। ছিল তিল হচ্ছে তাল।’
ভাবছিলাম বাবা আর মেসো এলে খুব মজা হত।
রাস্তা দিয়ে হুইলচেয়ার চলছে। দেখি আমাদের সঙ্গে অনেক লোকজন যারা মান্তুমাসিকে ছুটতে দেখেছিল তারাও সঙ্গে সঙ্গে আসছে।
বুটাই আবার ওর লাল রুমাল বের করে নাক মুছতে যাচ্ছিল।
আমি বললাম, ‘এই তাড়াতাড়ি রুমালটা পকেটে ঢোকা।’
‘কিউ?’ বলেই ও দেখল ষাঁড়টা আবার এসে ঘোলাটে চোখে বুটাইয়ের দিকে তাকাচ্ছে। রুমালটা চট করে পকেটে ঢুকিয়ে রেখে ও আতঙ্কে চিৎকার করে উঠল, ‘ভোলেবাবা।’
আমাদের সঙ্গে যারা আসছিল সবাই একসঙ্গে চিৎকার করে উঠল। বলল, ‘পার করেগা।’