আমরা সবাই একযোগে নিঃশ্বাস ফেললাম। আর হেলাল ভাই কেমন যেন টেসে গেল। টেসে যাওয়া কন্ঠে বলল: কবে থেকে এই মামলা?
: সুরমা যখন আমার সাথে ক্লাশ নাইনে ছিল তখন থেকে।
এবার আমরা থ’। ডুবে ডুবে জল খাওয়া একেই বলে। চার বছর আগে থেকে সে সুরমাকে পছন্দ করে অথচ আমরা কেউ ঘুণাক্ষরেও কিছু জানি না।
হেলাল ভাই বলল: শুধু ভালবাসিস, নাকি প্রেম করিস?
: প্রেম হয় নাই।
: তুই কি ওকে বলেছিস তোর ভালো লাগার কথা, পছন্দের কথা?
: বলেছি।
: ও কী বলেছে?
: পাত্তা দেয় না।
: কবে বলেছিস?
: যখন আমার সাথে নাইনে পড়তো।
: সে তো অনেক আগে।
: এ পর্যন্ত শতবারেরও বেশি বলেছি। শেষবার বলেছি গত পরশু।
তার মানে গত পরশুও গাব্বু সুরমার সাথে কথা বলেছে। অথচ আমরা কিছুই জানি না। আমাদের কাছে এভাবে লুকানোর কারণ কী? ও কি আমাদেরকে বন্ধু মনে করে না? আমরা কি ওর পথের কাঁটা হয়ে দাঁড়াতাম?
বোকাসোকা ফজা রেগে গেলে নিজেকে নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারে না। বলল: গাব্বু, তোকে আমাদের দল থেকে বের করে দেয়া উচিত।
: কেন?
: তুই আমাদেরকে বন্ধু ভাবতে পারিস নাই।
: কে বলল?
: যদি পারতিই তো সুরমার ব্যাপারটা এভাবে আমাদের কাছে লুকাতে পারতি না। আমরা কি তোকে সাহায্য করতাম না?
: সুরমা আমাকে যেরকম অপমান করে কথা বলে তোরা সেটা সহ্য করতি না, তাই………। ঝামেলা বাঁধিয়ে দিতি। আমি একাই নীরবে সয়ে যেতে চাই ওর দেয়া যত অপমান, যত প্রত্যাখ্যান। প্রেম হল আগুনের হোলি খেলা।
‘প্রেম হল আগুনের হোলি খেলা’-কী অসাধরণ এক কথা বলল গাব্বু। দার্শনিক হেলাল ভাইও এরকম কথা বলতে পারে নাই কখনো।
ফজা বলল: কী রকম অপমান করে কথা বলে?
গত পরশু আমি যখন সুরমার সামনে দাঁড়িয়ে বললাম: সুরমা, আমি কিন্তু তোমার অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে আছি। ও বলল, গাছের মতো দাঁড়িয়ে থাকো আরও কয়েকটা জনম।
: এত নির্মম ব্যবহার!
: বোঝ এবার। আমি ওর জন্য দাঁড়িয়ে থাকতে চাই। দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতে আমার পায়ে শেকড় গজিয়ে গেলেও আমি দাঁড়িয়ে থাকব।
হেলাল ভাই বলল: বুঝেছি, সব বুঝেছি। সুরমা নামের মেয়েটাকে গাব্বু হৃদয় উজার করে ভালবাসে।
তারপর হেলাল ভাই খপ করে গাব্বুর ডান হাতটা চেপে ধরে নিজের বুকের মধ্যে নিয়ে বলল: শোন গাব্বু, ভালবাসার বিনিময়ে ভালবাসা পাওয়াটা আসল কথা নয়। হৃদয় উজার করে ভালবাসতে পারাটাই আসল কথা। তোর ভালবাসার সুরমাকে আমিও প্রেম প্রস্তাব পত্র দিব।
: সব জেনেও………!
: হ্যাঁ, সব জেনেও। এতে তোরই উপকার হওয়ার সম্ভাবনা আছে।
: আমার কী উপকার…?
: যখন এই চোয়াল ভাঙা, ফ্যাঁসফ্যাঁসে গলার দার্শনিক হেলালের কাছ থেকে প্রেম প্রস্তাব যাবে, তখন সুরমা তোর আর আমার মধ্যে পার্থক্য খুঁজতে বসবে। মেয়েরা বেশি বেশি প্রেম প্রস্তাব পেতে ভালোবাসে। আর প্রেম প্রার্থীদের মধ্যে তুলনামূলক চিত্র আঁকতে পছন্দ করে। আর খুঁটি-নাটি সব দিক যাচাই করতে গিয়ে অপেক্ষাকৃত অযোগ্য প্রার্থীর প্রস্তাবে সাড়া দেয়। আমার বিশ্বাস, আমার কাছ থেকে প্রস্তাব যাবার পর সুরমা তোর প্রস্তাবে সাড়া দিবে।
: আমি অপেক্ষাকৃত অযোগ্য?
নয়তো কী? আমি অনার্স ফাইনালে আছি চার বছর। আর তুই ক্লাশ নাইনে আছিস চার বছর। ওয়ান থেকে ক্লাশ নাইন পর্যন্ত তো আমি ক্লাশে ফার্স্ট ছিলাম। ফাইভ আর এইট-এ ট্যালেন্টপুলে স্কলারসীপ পেয়েছিলাম। সুরমা যখন তুলনা করতে বসবে, তখন অনার্স আর ক্লাশ নাইন-এর তুলনা করবে না। তুলনা করবে আমার ভাঙা চোয়াল আর তোর ভরাট গালের। সো তুই জিতে যাবি।
: তাহলে আপনি সুরমাকে চিঠি দিচ্ছেন?
: সিওর।
: স্যাকরিফাইস বলে আপনার ভেতর কিছু নেই। দার্শনিকরা এরকম হয় তা জানতাম না।
: আছে আছে, এক সময় সবই জানতে পারবি।
তারপর হেলাল ভাই আবৃত্তি করলো আবুল হাসানের কবিতা-
ঝিনুক নীরবে সহো
ঝিনুক নীরবে সহো
ঝিনুক নীরবে সহে যাও
ভিতরে বিষের বালি, মুখ বুঁজে মুক্তা ফলাও।
৩
পরদিন ছিল ছুটির দিন। আমরা ছুটোছুটি করে চিঠিগুলো বিলি করলাম। কথাবার্তা তো কিছু বলার নেই। যার চিঠি তার হাতে গুঁজে দিয়ে, সে কিছু বুঝে ওঠার আগেই ছুটে পালানো। কেউ কেউ এক রকম হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে থকে আমাদের দিকে। আবার কেউ কেউ ডেকে বলে: কিসের চিঠি? কার চিঠি? আরে শোন…….।
আমরা আর পেছন ফিরে তাকাই না। কিছু শুনিও না।
বলা যায়, বিনা ঝমেলায়ই আমরা চিঠিগুলো বিলি করে ফেললাম। তবে মফিজটা তা পারল না। ও নামেও মফিজ কাজেও মফিজ।
মফিজ চিঠি দিতে গিয়েছিল ১৫৮ নম্বর বাড়ি সৈয়দ ভিলায় সৈয়দ সাহেবের মেয়ে সৈয়দা নার্গিস জাহানকে। নার্গিস জাহান আই.এ ফার্স্ট ইয়ারে।
দরজায় বেল টিপতেই দরজা খুললেন সৈয়দ সাহেব স্বয়ং। মফিজ কোনো কথাবার্তা না বলেই সৈয়দ সাহেবের হাতে চিঠি গুঁজে দিল।
সৈয়দ সাহেব মফিজের মতোই সহজ-সরল মানুষ। তার মেয়েকে কেউ প্রেম প্রস্তাব জানিয়ে চিঠি দিয়েছেন এমনটি ভাবলেন না। প্রথমে ভাবলেন, এলাকার কোনো অনুষ্ঠানের বিষয়ে চিঠি হয়ত। চিঠি খুলে দেখলেন কবিতা। তিনি সাহিত্যের খোঁজ-খবর রাখেন।