বিতান বলল, ‘আমার ভাগ্নি পান্তি এবার বাড়ির সরস্বতী পুজোটা বড়ো করে করবে। ওর কলেজের বন্ধু বান্ধবীরা আসবে। ওর আরও অনেক বান্ধবী যারা সিরিয়ালে সিনেমাতে অভিনয় করে, তারাও সবাই আসবে।’
বললাম, ‘ভালো তো। এবার তাহলে তোর দিদির বাড়ির পুজোটা বেশ জমজমাটি হবে। তুই যাচ্ছিস?’
‘হ্যাঁ। যেতে তো হবেই। তা না হলে পান্তি ছাড়বে? বার বার বলে দিয়েছে। বাড়ির সবাইকে নিয়ে দিদির বাড়ি যেতে হবে।’
‘তোর বাড়ির পুজো কি খুব সকালে হবে?’
‘এবার আমার বাড়ির পুজো হবে না। আমাদের আগের দিন রাতেই যেতে বলেছে।’
গুলেদা বলল, ‘গতবার পূজায় করোনার ঠেলায় পূজাই করলি না। এই বছর দিদির বাড়ি যাবি। তর মতলবডা কি? তোগো বাড়িতে সরস্বতী পূজায় খিচুড়ি, বেগুন ভাজা, বান্ধাকপি, পায়েস হেইয়া কি আর আমাগো খাওয়ন হইবো না?’
বিতান বলল, ‘পান্তি বলে দিয়েছে সবাইকে পুজোর দিন সকাল সকাল যেতে। গুলেদার জন্য তো স্পেশাল একটা চিঠি দিতে চাইছিল। আমিই না বললাম। গেলে দেবে।’
‘আনলে পারতি চিঠিহান।হাতের ল্যাহাডা সেই কাকের ঠ্যাংই আছে না একটু শুধরাইছে। দ্যাখতাম।’গুলেদা বলল।
বললাম, ‘তাহলে তো চিন্তা নেই। গুলেদার মনের মতো আইটেমগুলিই হবে।’
কথাটা শুনে বিতান মাথা চুলকে বলল, ‘ওটাই তো সমস্যা। আইটেম সব বদলে ফেলেছে।’
‘বদলে ফেলেছে মানে?’ আমি বললাম।
বিতান গুলেদার দিকে একবার তাকিয়ে বলল, ‘এবার ফ্রায়েড রাইস,মটর পনির,চাটনি আর আইসক্রীম খাওয়াবে। শেষে হজমের গুলি।’
গুলেদা বলল, ‘তরা যা। আমি যামু না।’
‘তুমি না গেলে সবাই দুঃখ পাবে। তোমার কথা সবাই শুনেছে। তোমার সঙ্গে আলাপ করবে। তুমি না গেলে হয়।’ বিতান বলল, ‘আমার জন্মদিনে তোমাকে খিচুড়ি বেগুন ভাজা খাইয়ে দেব।’
‘কথার ছিরি দেহ।’ আমাদের সবার দিকে তাকিয়ে গুলেদা বলল, ‘তরা ওর জন্মদিনে খিচুড়ি, বেগুন ভাজা খাবি?’
সবাই আপত্তি করলাম।
বিতান ঘাবড়ে গিয়ে বলল, ‘অন্য সবই হবে সঙ্গে গুলেদার অনারে খিচুড়ি থাকবে।’
গুলেদা বলল, ‘সরস্বতী পূজায় খিচুড়ির মাহাত্ম্যই আলাদা। সেই ছোটোবেলা থিকা দ্যাখতাছি।’ বিতানের দিকে তাকিয়ে বলল, ‘যামু হানে। মাইয়াডারে দুক্কু দিয়া লাভ নাই।’
বেশ বড়ো প্রতিমা আনা হয়েছে। ফলে ফুলে সুন্দর সাজানো হয়েছে। পুরুত ঠাকুরের অপেক্ষায় সবাই। ঘন্টা দু’য়েক হয়ে গেল আসছে না। সবাই আলাপ করে যাচ্ছে গুলেদার সঙ্গে। বেশি কথা বলছে না গুলেদা। বলছে, ‘আগে পূজা হউক। অঞ্জলি হইয়া গেলে তহন কথা হইবো।’
পুরুত ঠাকুর এল হন্তদন্ত হয়ে। তার পিছনে দু’জন। এখানে পুজো হলেই নিজেদের বাড়িতে নিয়ে যাবে। পাছে অন্য কোথাও চলে যায় এই ভয়ে সঙ্গে সঙ্গেই আছে।
পুজোর একটা মন্ত্রও বোঝা যাচ্ছে না। যেন মেলট্রেন ছুটেছে। মাঝে মাঝেই একটা মন্ত্র শেষ করে অন্য মন্ত্রে যাওয়ার আগে হুইশেল বাজার মতো উ উ শব্দ।
গুলেদা বলল, ‘পূজা করতে গিয়া অমন উ উ কইরা কাতরায় ক্যান? পুরোহিত ভাতার লিস্টে কি নাম ওডে নাই?’
আমরা এই কথার কোনো উত্তর দিলাম না।
অঞ্জলি দেবার জন্য ডাকা হল। সবাই বলল গুলেদাকে অঞ্জলি দেবার জন্য।
গুলেদা বলল, ‘আমার অঞ্জলি দিয়া আর কোনো উপকার হইবো না। তোমাগো সামনে বিশাল দিন পইড়া আছে দ্যাহ অঞ্জলি দিয়া যদি উপকার হয়।’
সবাই ফুল হাতে ভক্তি নিয়ে দাঁড়াল। গুলেদা গেল না দেখে আমরাও গেলাম না।
গুলেদা বলল, ‘দ্যাখ তো আমি কি ভুল শোনতাছি? কি মন্ত্র কইতাছে।’
শুনলাম পুরুতঠাকুর বলছে, ‘কুচু কুচু ভুসোতো পুস্তক ভস্তে। তারপর তারপর বল দেবী নমুস্তে। পুস্তক রঞ্জিত হস্তে।’
আমাদের চোখ মুখের অবস্থা দেখে গুলেদা বলল, ‘তাইলে আমি ভুল শুনি নাই। পোড়া কপাল। ভাতা নেবার জন্যই কি পূজায় নাম লেহাইছে? এই মন্ত্রে অঞ্জলি দিয়া পোলা মাইয়াগুলার যে কি গতি হইবো।’
বললাম, ‘কি করবে বল। তাড়া আছে।’
গুলেদা বলল, ‘তাড়া তো আছেই। আইজ পর্যন্ত হয়ত চাকরি বইল্যা কিছু জোটে নাই। যাক এইভাবে যদ্দিন চলে।’
পুজো শেষ। পুরুতঠাকুরকে ডাকল গুলেদা।
‘না না আপনার বাড়ি আমি পুজো করতে পারব না। এখনও দশ জায়গায় বাকি আছে।’ কথাটা বলতেই সঙ্গে যে দু’জন এসেছিল তারা প্রায় ছিনিয়ে নিয়ে চলে গেল।
আমাদের ফল প্রসাদ দিয়ে সবাই ঘিরে বসল। রান্না হতে দেরি হবে।
পান্তি বলল, ‘গুলেমামা তুমি এসেছ আমরা সবাই খুব আনন্দ পেয়েছি।’
বিতান বলল, ‘সরস্বতী পুজোর দিন গুলেদা আমার বাড়িতে খিচুড়ি ভোগ খায়। এবার আর সেটা হল না।’
একটি ছেলে বলল, ‘সবসময় একইরকম হবে তার কি মানে আছে।’ ছেলেটি পরিচিত মুখ। মাঝে মাঝে সিরিয়ালে দেখা যায়। বলল, ‘আমার এক কাকা সরস্বতী পুজোর দিন বিদেশে ছিল। সেখানে বাইসন খেয়েছিল।’
সবাই হৈ হৈ করে উঠল। একজন বলল, ‘ও মা তাই ! খেতে কেমন লাগল? কিছু বলেছে?’
‘নিশয়ই ভালো লেগেছে। কত দেশে কত রকম খাওয়া হয় জানিস।’
মুখের উপর থেকে ঝুলে থাকা চুল সরিয়ে একটি মেয়ে বলল, ‘এই বল না কি খাবার খায়।’
যেখানে যে খাবার নিষেধ নেই সবই খায়।
‘বল না কি খাবার। আমার খুব জানতে ইচ্ছে করছে।’
‘অক্টোপাস,হাঙ্গর,কুমির, শুয়োর এইরকম আরও অনেক কিছু। আমার খুব মাংস খেতে ভালো লাগে।’
‘জানিস আমি খুব ভালো মাংস রান্না করতে পারি। তোর বাড়িতে খাসি বা গরুর মাংস আনলে আমাকে ডাকিস আমি গিয়ে রান্না করে দিয়ে আসব।’
গুলেদা এতক্ষণ চুপ করে শুনছিল। বলল, ‘হাতের ফল প্রসাদ গুলান তো এহনও ফুরায় নাই। আইজ সরস্বতী পূজার দিন তোমার কি এই কথাগুলান না কইলেই না। লেহাপড়া শেখতে আছো কোথায় কহন কী কইতে হয় হেই মাত্রা জ্ঞানডাই তো নাই। তুমি গিয়া অর বাড়িতে খাসির মাংস,গরুর মাংস রান্না কইরা দিবা? ক্যান? তুমি কি রান্নারমাসি।