‘আমাকে আমার মতো থাকতে দাও’-রিংটোনটা কিছুতেই অনিরুদ্ধকে ওর মতো থাকতে দিলো না।বেশ মটকা মেরেই শুয়েছিল অনিরুদ্ধ।সারা সপ্তাহ কাজ করে এই রবিবারটা একটু ল্যাদ খায় ও। বালিশে মুখ গুঁজে ফোনের ডিসপ্লেতে নজর দিলো।
রাতুল ফোন করেছে। ‘জানোয়ার’.. অস্ফুট স্বরে মুখ থেকে শব্দটা বেরিয়ে এলো বিরক্তিতে। ধরবো কি ধরবো না ভাবতে ভাবতে রিসিভ করেই ফেললো অনিরুদ্ধ।
“হ্যালো…গান্ডু, সাত সকালে হঠাৎ কেন আমার ঘুম ভাঙালি রে ?”
“শালা, ফেসবুকটা খোল।ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট কে পাঠিয়েছে একবার দেখ।
ওমকেও পাঠিয়েছে ও।”
“কে পাঠিয়েছে বল না শা….” মুখটা সামলে নিলো অনিরুদ্ধ।
ফোনটা কেটে দিলো রাতুল।
বাঁ পাশ ফিরে শুলো অনিরুদ্ধ।আদর করে ফোনের ডিসপ্লে টা মুছলো ও।ডান চোখে পিছুটি মুছে ফেসবুকটা অন করলো । বন্ধু অনুরোধের তালিকাটায় চোখ পড়তেই ধড়মড় করে উঠে পড়লো ও।
‘কনিস্ক সেন… ব্র্যাকেটে দেড়েল!’ঠিক নীচেই লেখা ‘স্বপ্ন দেখা এক অলীক মানুষ’। রিকোয়েস্ট কনফার্ম করে কনিস্কর প্রোফাইলটা ঘাঁটতে শুরু করলো অনিরুদ্ধ। কল্যানিতে থাকে। তবে কি করে তা স্পষ্ট নয়। মিউচুয়াল ফ্রেন্ড দুজন-‘রাতুল’ আর ‘ওম’। কিন্তু কনিস্কর বিখ্যাত দাড়িটা কই? দেখা হলেই মজা করে ওম ঝাঁপিয়ে পরে উকুন বাছতো যে দাড়িটায় …! মনে পড়ে যায় অনিরুদ্ধর।
বছর দশেক আগে স্মৃতির সরণি বেয়ে হাঁটতে শুরু করে ও। অনিরুদ্ধ, রাতুল, কনিস্ক আর ওম।চারজন চন্দননগরে ডুপ্লে কলেজে একসঙ্গেই ভর্তি হয়েছিল।ওরা ফিজিক্সে অনার্স নেওয়ায় ডিপার্টমেন্টেই বন্ধুত্ব হয়েছিল পড়ার সূত্রে।সুখ আর দুঃখ ছাড়া অন্য কোনো ঋতুই অনুভব করতো না ওরা। বৃষ্টি হলেই অনিরুদ্ধ আর ওম ভিজতে বেরিয়ে পড়তো রাস্তায়,রাতুল কলেজ ক্যান্টিনের এক কোনে চুপ করে বসে সিগারেটে সুখ টান দিতো আর কনিস্ক ভেজা মাটির সোঁদা গন্ধ নিতো মন ভরে।
ডিপার্টমেন্টের অলোক স্যার ওদের একদিন ডেকে বললেন , “তোদের চার মূর্তির একটা খাসা নাম দিয়েছি, জানিস।”
“কি স্যার?” ওম প্রশ্ন করতেই স্যার বলেছিলেন, “অর্ক।”
“অর্ক?” রাতুল অবাক হতেই উনি বললেন, “শোন,অর্ক হলো চারটে ইংরেজি অক্ষরের সমাহার। A-R-K-O। তোদের নামের আদ্যক্ষরগুলো নে; তাহলেই পেয়ে যাবি।”
“বুঝেছি স্যার, আমি, রাতুল,কনিস্ক আর ওম মিলে অর্ক, তাইতো? দারুন স্যার!”
অনিরুদ্ধ উত্তেজনায় চেয়ার ছেড়ে উঠে পড়লো।
সেদিন থেকে কলেজে ওদের চারজনের নাম হয়ে গেলো ‘অর্ক’।সত্যি, যেখানেই ওরা যেতো,সকালে গাছের পাতায় পরা প্রথম আলোর মতোই আলোকিত হতো সবাই।
এরই মধ্যে সেকেন্ড ইয়ারে মৃত্তিকার প্রেমে পড়লো কনিস্ক। ভূগোলের ছাত্রী মৃত্তিকাকে সবাই মাটি বলে ডাকতো।সবার বড় আদরের ছিল ও।
মনে আছে অনিরুদ্ধর, মৃত্তিকার প্রেমে হাবুডুবু খাওয়া আনমনা কনিস্ককে দেখে ওম বলেছিল, “কি রে, কাটমুন্ডু, (কনিস্ককে এই নামেই বাকী তিনজন ডাকতো) মুন্ডুটাকে কোথায় বন্ধক রাখলি রে?”
“মাটিতে পুঁতে দিয়েছি, এবার গাছ হওয়ার অপেক্ষায়…”হেঁয়ালি করে বলতো কনিস্ক।
এভাবেই বর্ণময় দিনগুলো চলে যেতে লাগলো শরতের নীল আকাশে উড়ো মেঘের মতো।
মনে পড়ে অনিরুদ্ধর- জগদ্ধাত্রী পূজোর দশমীর দিন গঙ্গার ঘাটে বসে ছিল ওরা চার বন্ধু। হটাৎ রাতুল কনিস্কের গাল ভরা দাড়ি দেখে বলেছিল, “কি ব্যাপার,এত বড় দাড়ি রেখেছিস যে খুব, মাটি কাটতে বারণ করেছে বুঝি?”
শুনেই চুপ করে গেছিল ও। শীতের দুপুরে মেঘলা আকাশের মতো গম্ভীর হয়ে বললো, “দাড়িটা কাটবো না ভাবছি।”
“কেন?” ওম কনিস্কের দাড়িতে হাত বুলিয়ে বললো।
“কেন জানি না..মৃত্তিকা কিছুতেই আমার সঙ্গে সম্পর্ক রাখতে রাজী নয়।”
“সমস্যা থাকলে বল, আমরা মাটির কাছে যাবো..” অনিরুদ্ধ একথা বলতেই কনিস্ক হটাৎ উত্তেজনায় সবার মুখের দিকে চেয়ে বলেছিল, “না, না, ওকে একদম বলিস না।হয়তো আমার কাছ থেকে আরো দূরে সরে যাবে ও।”
“শোন দেড়েল…”. ওম সেদিন হটাৎ এই নামে কনিস্ককে ডাকতেই রাতুল বলে উঠেছিল, “আরে গুরু, খাসা নাম দিলি তো ওর…দেড়েল !”
“আমার বাবার একমুখ দাড়িতে হাত বুলিয়ে মাঝে মাঝেই ঠাকুমা আদর করে বলে, ওরে আমার দেড়েল রে !হটাৎ মনে পড়ে গেলো,তাই….”
“ওঃ ফাটাফাটি ওম.. আজ থেকে কাটমুন্ডু নয়, ওকে আমরা দেড়েল বলেই ডাকবো।”
রাতুল অট্টহাসি জুড়ে দিলো।
কনিস্ক কষ্ট করেই হেসেছিল সেদিন।
পরের দুবছর ওর দাড়ি আরো বেড়েছিল।
কনিস্কের বড় মুখে দাড়ি দেখে ওম বলতো, ‘যৌবনের ডারউইন’।
অনিরুদ্ধরা বুঝতে পারতো, রাশি রাশি দুঃখ ওর দাড়িতে লুকিয়ে আছে। মৃত্তিকার রাজী না হওয়াটা ওদের সবার কাছে শেষ দিন পর্যন্ত অমীমাংসিত রহস্যই থেকে গেলো।
অবশেষে কালের নিয়মে এসেই গেল কলেজের অন্তিম মুহূর্তটা। অর্ক অর্থাৎ ওরা চারজন কলেজ ক্যান্টিনে বিকেল পাঁচটা অব্দি আড্ডা মেরেছিলো সেদিন।
চায়ের শেষ অফিসিয়াল চুমুকটা মেরে ওম কনিস্ককে বলেছিল, “দাড়িটা সত্যি তুই কাটবি না?”
“মৃত্তিকা রাজী হলেই কাটবো রে…” কনিস্কর দীর্ঘশ্বাস পড়লো ।
অনিরুদ্ধ, রাতুল আর ওম তিনজনেই জড়িয়ে ধরে কনিস্ককে বলেছিল, “মাটি রাজী হলে খবর দিস কিন্তু…”
“কি রে,অনি ওঠ.. আর কতক্ষন শুয়ে থাকবি ? স্কুল যেতে হবে না?” মায়ের ডাকে সংবিৎ ফিরে পায় অনিরুদ্ধ।
“যাই মা..” রিমোটে এসি’র সুইচটা অফ করে বিছানা থেকে নেমে আসে ও।
কনট্যাক্ট লিস্টে ওমকে খুঁজে ডায়াল করে ওকে।
“হ্যালো, ওম.. আমি অনি বলছি।”
“বল….” অপরপ্রান্তে ওমের হাই ওঠা শুনতে পায় অনি।
“দেড়েলের ক্লিন সেভ করা প্রোফাইল পিকচারটা দেখলি ফেসবুকে ওম ? মাটি তাহলে রাজী হলো শেষ পর্যন্ত….”
“তাই তো রে…দারুন খুশীর খবর!
তুই, আমি আর রাতুল কল্যানীতে একদিন চল..ঘুরে আসি। মাটির সঙ্গেও দেখা হবে।অনেকদিন পর জমিয়ে আড্ডা… আঃ.. দারুন মজা হবে।”
“ভালো প্রস্তাব। আমি রাতুলের সঙ্গে কথা বলে ডেটটা ফাইনাল করি। তবে এই রবিবার হবে না।কলেজে পি.এস.সি পরীক্ষার সিট পড়েছে।দুজনেই ব্যস্ত থাকবো।নেক্সট সানডে দেখছি।”
“দেখ তাহলে….” ফোনটা কেটে দিলো অনিরুদ্ধ।
ওরা তিন বন্ধু কল্যাণী স্টেশনে যখন নামলো,তখন বিকাল সদ্য বিদায় নিয়েছে সেদিনের মতো। কাল রাতে যে হালকা বৃষ্টি হয়েছে বাংলা জুড়ে , তার ছাপ থেকে গেছে গোটা স্টেশন চত্বর জুড়ে। ঝরা পাতার দল রাস্তার ধূলোর উপর হুমড়ি খেয়ে পড়ে আছে। আকাশে মেঘেদের খুনসুটি খেলা তখনো চলছে।
“কি রে ওম, দেড়েলের বাড়ি চিনিস তো?” রাতুল ওভারব্রিজের শেষ সিঁড়িতে পা ফেলে বললো।
“পরশু রাতে ওকে ফোন করেছিলাম। সব জেনে নিয়েছি। কল্যাণী কালী বাড়ির কাছে দু নম্বর জল ট্যাংকে গিয়ে ফোন করলেই পেয়ে যাবো।” ওম আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে বলে।
“সঙ্গে গুগুলবাবা থাকতে চিন্তা কিসের রে?” একটা বিস্কুটের বিজ্ঞাপনকে নকল করলো অনিরুদ্ধ।
মিনিট পনেরোর মধ্যেই কনিস্কের বাড়ি পৌঁছে যায় তিন বন্ধু। ওর বাড়িটাকে গাছের বাড়ি বললে অত্যুক্তি হয় না। নারকেল আর সুপারি গাছগুলো বাড়িটাকে অন্য মাত্রা দিয়েছে।অনিরুদ্ধ কলিং বেল বাজাতেই দরজা খুলে গেলো আপনা আপনি। দরজা খোলার শব্দটা শুনে শিউরে উঠলো ওম। একটা পুরোনো গেট খোলার আওয়াজ। এই নিঝুম সন্ধ্যায় শব্দটা কানের মধ্য দিয়ে হৃদয়ে আঘাত করলো ওদের।
“আরে তোরা ..? আয় ,আয়।দরজা খোলার সিস্টেমটা এমনই করেছি।কলিং বেল বাজলেই…”
কনিস্কের কথায় সম্বিৎ ফিরলো ওদের।
“আরে গুরু..! সেই কলেজ জীবনের বোহেমিয়ান টাইপের ইনোসেন্ট থোবড়াটা এখনো রেখে দিয়েছিস..! কোনো পরিবর্তন নেই..?”
অনিরুদ্ধ বিস্ময়ে ওর দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করতেই কনিস্ক হেসে উঠলো কাঁধ ঝাঁকিয়ে। ঘরটাও যেন ওর হাসিতে সায় দিয়ে গমগম করে উঠলো।একটু হলেও চমকে উঠলো রাতুল।
“তোরা বোস..। আমি এখুনি আসছি…”
কনিস্ক যেতেই ওরা তিনজনেই ডাইনিং রুমে সোফার উপর বসে গা এলিয়ে দিলো।
“বুঝলি ওম, মাটি বাড়িটাকে কি সুন্দর গুছিয়ে রেখেছে বল?”
“ঠিক..। তবে রাতুল একটা জিনিস খেয়াল করেছিস ?” ওম প্রশ্ন করে।
“কি বলতো?” অনিরুদ্ধ, রাতুল দুজনেই একসঙ্গে বলে ওঠে।
“রুমটায় খেয়াল করে দেখ, প্রায় সমস্ত উপকরনেই মাটির প্রাধান্য!” ওমের কথা শেষ হতেই ঘরে হাজির হয় কনিস্ক। চেহারাটা প্রায় সত্যিই একইরকম রেখে দিয়েছে ও। শুধু মাথার চুলের ঘনত্ব একটু কমেছে ,এই যা।তবে ক্লিন সেভে ওকে আগের থেকে অনেকটাই আলাদা লাগছে।
“কি রে.. দাড়ি কাটছিস কতদিন হলো? তোকে তো চিনতেই পারছি না রে।”
রাতুল হেসে ওঠে।
“সে কথা পরে হবে। তবে যাই বলিস,আচ্ছা সারপ্রাইস দিলি কিন্তু তোরা !” কনিস্ক টেবিল থেকে চশমাটা তুলে নেয়।
“হ্যাঁ রে, মাটিকে দেখছি না.. কোথাও গেছে নাকি?” অনিরুদ্ধর প্রশ্নে আনমনা হয়ে পড়ে কনিস্ক।
“আরে…. আগে কিছু খেয়ে নে, তারপর মৃত্তিকাকে দেখাবো তোদের।” হেসে বলে
ও।
“আর অপেক্ষা করতে পারছি না রে দেড়েল…” ওম বলতেই ওকে মাথা নেড়ে সম্মতি জানায় বাকী দুই বন্ধু।
“মৃত্তিকা উপরের ঘরে আছে।চলে আয় তোরা..”কনিস্কের ডাকে সাড়া দেয় ওরা তিন বন্ধু।
বহু বছরের অপেক্ষার অবসান ঘটতে চলেছে আজ। কনিস্কের কঠোর তপস্যার কাছে হার মেনেছে মৃত্তিকা।বন্ধুর জন্য সত্যি গর্ব হচ্ছে ওদের।
সিঁড়ি দিয়ে উঠেই প্রথম ঘরটার সামনে দাঁড়ালো কনিস্ক। ইশারায় ডেকে নিলো ওর তিন পরমাত্মীয়কে।
ঘরটার দরজা খুলে কনিস্ক বললো, “এটাই মৃত্তিকার ঘর।”
ঘরের ভিতরে ঢুকে হতভম্বের মতো দাঁড়িয়ে পড়লো ওম,রাতুল আর অনিরুদ্ধ। এতটা অবাক জীবনে হয়নি ওরা। সারা ঘর জুড়ে মৃত্তিকার ছবি। দেওয়াল জুড়ে প্রতিকৃতি ছাড়াও মৃত্তিকার ব্যবহার করা সমস্ত জিনিস অত্যন্ত যত্ন করে সাজানো। ডাইনিং টেবিলে থালা থেকে কাঁটা চামচ সুসজ্জিত । খাটে শোভা পাচ্ছে বহুদিনের টাঙানো মশারি। ড্রেসিং টেবিলের পাশেই বেনারসী শাড়ী পরা মৃত্তিকার মর্মর মূর্তি। সারা ঘর জুড়ে একটা আবেশ,একটা মায়াময় পরিবেশ যেখানে শুধুই মৃত্তিকার উপস্থিতি।
“কনিস্ক…তার মানে মৃত্তিকা…?” ওমের বিস্ময়ের ঘোর কাটছে না। অনিরুদ্ধ, রাতুলও স্থবিরের মতো দাঁড়িয়ে।
“কি রে? মৃত্তিকাকে দেখলি তোরা? কত যত্ন করি ওকে.. বললি না তো ?” কনিস্কের কথায় ওরা সংবিৎ ফিরে পায়।
“আমরা সবাই নিজের কেরিয়ার তৈরীতে এত ব্যস্ত হয়ে পড়েছিলাম এই কটা বছর…তোর খোঁজ আর নেওয়া হয় নি।” রাতুলের কথার মধ্যে যেন অপরাধবোধ জেগে ওঠে।
“ভাগ্যিস আমি ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট পাঠিয়েছিলাম তোদের, নাহলে তো..”
“দেখ দেড়েল, আর লজ্জা দিস না ভাই।এবার আমরা তোর মাটির গল্প শুনবো…”
একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে শুরু করলো কনিস্ক ।
“আমাদের দেখা হওয়ার শেষ দিনটা মনে পড়ে তোদের?”
“কেন নয়? এক মুখ দাড়ি ছিল তোর.. আমরা জিজ্ঞাসা করতেই বলেছিলি, মৃত্তিকা রাজি হলে তবেই দাড়ি কাটবি..”
ওম সপ্রতিভ হয়ে উত্তর দেয়।
“সেদিনের পর আমার জিদ আরো বেড়ে গিয়েছিল, বুঝলি? পরের দিন সকালে ওকে কলেজ ক্যান্টিনে দেখে আমি মাথার ঠিক রাখতে পারি নি।”
“মাথায় বন্দুক ধরলি নাকি ওর?” রাতুল হেসে ওঠে।
“ধুর… তা কেন? সাহস করে এতদিন যা করতে পারিনি, তাই করলাম বুঝলি?”
“মৃত্তিকার সামনে সাহস করে দাঁড়ালাম।ওকে জিজ্ঞাসা করলাম, ‘তোর মনে কি আমার জন্যে একটুও জায়গা নেই?”
“ওরে হারামজাদা, একতরফা কি প্রেম হয়? ও তো অন্য কাউকেও…” অনিরুদ্ধ উত্তেজিত হয়ে ওঠে।
“না অনি, আমি ওর চোখের ভাষা অনেকদিন আগেই বুঝেছিলাম। ওর মনের কোণে কোথাও আমার জন্য একটা আসন পাতা আছে এটা আমি অনুভব করেছি মর্মে, মর্মে প্রতিনিয়ত।”
“আরেব্বাস ! এতো জহুরির চোখ..!”
ওম চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ায়।
“মৃত্তিকা কি বললো তোকে?” এবার প্রশ্নটা ধেয়ে আসে রাতুলের কাছ থেকে।
“ও হেসে বললো,জায়গা থাকবে না কেন? অনেকদিন ধরেই আছে। তবে বন্ধু হিসেবে…!”
“তার মানে…! তোর সঙ্গে মৃত্তিকার…?” ওম বিস্ময়ে বলে ওঠে।
“আরে বাবা..! আমিও তো ছাড়বার পাত্র নই। ওর বাড়ির সামনে একটা মেসে থাকতে শুরু করলাম। আর হ্যাঁ..! তোরা হয়তো জানিসনা,মাটি খ্রিষ্টান ছিল..।”
“তাই..? সত্যি আমরা জানতাম না..!” রাতুল বিস্ফারিত চোখে বলে ওঠে।
“আমি মাটির জন্য খ্রীষ্ট ধর্ম গ্রহন করলাম,জানিস..!”
“কিন্তু কেন ভাই..? ও তো তোকে সম্মতিই জানায় নি। তাও তুই..!”
“ভবিষ্যতে ওর পরিবার থেকে যাতে কোনো সমস্যা না আসে,এই সাত পাঁচ ভেবে …” অনিরুদ্ধকে জবাব দেয় কনিস্ক।
“ওঃ..! তুই পারিস বটে..! তারপর বল..! আর তর সইছে না যে…!” কনিস্কের জবাবে আবার একবার অবাক হয় ওম।
“তারপর আর কি..! বছর চারেক এভাবেই কাটলো বুঝলি। দাড়িও বেড়ে বুক ছুঁই ছুঁই। এরই মাঝে হঠাৎ একদিন আশ্চর্য ঘটনার সম্মুখীন হলাম। সেদিন রাত সাড়ে বারোটা হবে। মেসের সবাই ঘুমিয়ে কাদা।ঝিঁ ঝিঁ পোকার ডাক অনবরত কানে আসছে।
হঠাৎ দেখি, মৃত্তিকা দরজার সামনে দাঁড়িয়ে।আমি তো অবাক।আনন্দে কাঁদবো না হাসবো বুঝতে পারছি না। ওর কাছে যেতেই আমাকে জড়িয়ে ধরে অনবরত কেঁদে চললো ও। ওর চোখ মুছিয়ে দিলাম অপার স্নেহে। আমার চোখের জলও সেদিন বাঁধ মানে নি জানিস। দীর্ঘ প্রতীক্ষার অবসান যে এমন মধুর পরিসমাপ্তি ঘটবে,বুঝতেই পারি নি আমি। কতক্ষন এমনভাবে লতার মতো একে অপরকে জড়িয়ে আছি জানি না, হঠাৎ ছিটকে দু হাত দূরে গিয়ে দাঁড়ালো মৃত্তিকা। চোখ মুছতে মুছতে বললো,’দাড়িটা কেটো কনিস্ক…!চললাম।’
বুঝলি..! মুহূর্তের মধ্যে অদৃশ্য হয়ে গেল ও।
আমি ওর যাওয়ার পথের দিকে চেয়ে রইলাম।”
“অবশেষে রাজী হলো মাটি..! বাঃ! একদম মধ্য রাতে সম্মতি। চরম ব্যাপার গুরু..!” রাতুল আনন্দে লাফিয়ে উঠে।
“দাঁড়া বন্ধুরা,গল্পের তো সবে শুরু। পরের দিন কান্নার আওয়াজে ঘুম ভাঙলো আমার। ধড়মড় করে বিছানা ছেড়ে হাওয়াই চটি পায়ে গলিয়ে এক ছুটে মেস থেকে বের হতেই খবরটা দিলো পাশের বাড়ির অতীনদা।”
“কি খবর..?” অনিরূদ্ধের অস্ফুট কণ্ঠের প্রশ্নে নীরবতা ভাঙে।
“মৃত্তিকা নেই..! খবর নিয়ে জানলাম,কাল রাত বারোটা নাগাদ সবাইকে ছেড়ে বিদায় নিয়েছে মাটি..!”
“আগের দিন রাতে তাহলে কে এসেছিল তোর মেসে?” কাঁপা কাঁপা কণ্ঠে বলে ওঠে ওম।
“মৃত্তিকার অতৃপ্ত আত্মা..! আবার কে? পরে শুনেছিলাম,দীর্ঘ আট বছর ধরে ও ব্রেন ক্যানসারে ভুগছিল।আর সেজন্যই…”
“তোর কাছে ধরা দেয়নি মৃত্তিকা…” কনিস্কের কথার রেশ ধরে বলে ওঠে অনিরুদ্ধ।
“তবে আমার শান্তি একটাই…! ও আমার এই বাড়ির পাশেই কবরস্থানে চির ঘুমে শায়িত আছে।যাওয়ার সময় দেখে যাস তোরা…! আমি তো ওখানেই থাকি সারাক্ষন…! মাটির কাছাকাছি..।”
কনিস্কের কথা শেষ হতেই ওরা তিনজন বেরিয়ে পড়লো বাড়ির উদ্দেশ্যে।
কনিস্কের বাড়ি মূল জনপদ থেকে একটু দূরে হওয়ায় রাত ন’টার মধ্যে জনশূন্য হয়ে পড়লো পারিপার্শ্বিক পরিবেশ। জমাট অন্ধকার কনিস্কের বাড়ির গলিটাকে আরো গা ছমছমে করে তুলেছে। ওরা তিনজন নিজেদের জুতোর আওয়াজ ছাড়া কিছু শুনতে পারছে না।
“কি রে রাতুল,টর্চটা জ্বালা..! তুই যেখানেই যাস,টর্চ নিয়ে যাস জানি..। আজ অনিসনি..?”
“এনেছি বন্ধু..। আসলে আমি ভাবছি,একবার কবরখানায় ঘুরে এলে কেমন হয়?”
ওমের কথায় চিন্তাক্লিষ্ট রাতুল জবাব দেয়।
“মন্দ বলিসনি রাতুল..। চল…! একবার ঘুরেই আসি তিনজনে।মাটির মর্মান্তিক পরিণতি শুনে মনটা খারাপ হয়ে গেলো।ওর কবরে অন্ততঃ শ্রদ্ধা নিবেদন করে আসি তিন বন্ধু মিলে। আবার কবে আসবো, ঠিক নেই…”
অনিরূদ্ধের প্রস্তাবে রাতুল আর ওম সম্মতি জানায়।
কিছুক্ষনের মধ্যেই পৌঁছে যায় ওরা। একটা শনি মন্দিরের পাশ দিয়ে সোজা রাস্তা কবরখানা পর্যন্ত চলে গেছে সাপের মতো। কবরখানা ঢোকার গেটটা দেখেই বোঝা যায় বহু পুরানো। পলেস্তারা খসে যাওয়া দেওয়ালটা আগাছায় ভর্তি হয়ে আছে।
রাস্তার স্ট্রিট লাইটের আবছা আলো পরিবেশটাকে আরো রহস্যময় করে তুলেছে। হঠাৎ একটা কুকুরের ডাকে চমকে ওঠে ওম।কাঁপা কাঁপা কণ্ঠে বলে ওঠে,”রাত বাড়ছে..! বাড়ি ফিরতে পারবো না কিন্তু। কেটে পড় রাতুল..।”
“ওঃ..! ভয়ে মরছিস..!আরে বাবা,চিন্তা করছিস কেন? তেমন বুঝলে কনিস্কের বাড়ি থেকে যাবো।”
রাতুলের ধমকে চুপ করে যায় ওম।
অবশেষে কবরখানার মধ্যে ঢুকে পড়ে তিন বন্ধু।
ছাতিমফুলের গন্ধে ‘ম ম’ করছে গোটা এলাকা।
হঠাৎ রাতুল একটা কবরের উপর টর্চ ফেলতেই চমকে ওঠে।
“অনিরুদ্ধ, ওম…! এদিকে আয়।”
ওরা তিনজনই হামলে পড়ে সমাধিস্থলের উপর।টর্চের আলোয় জ্বল জ্বল করছে লেখাটা… “মৃত্তিকা” !
একটা ঝরা পাতা অধিকার করে আছে মৃত্তিকা অক্ষরের অর্ধেকাংশ। ওম পাতাটা সরাতেই পিছন থেকে কনিস্কের গলা ভেসে এলো,”আমি পাশেই আছি বন্ধুরা…..!”
একটা নির্ভেজাল, নৈঃশব্দ্য ভেদী কণ্ঠ।চমকে ওরা তিনজন পিছনে তাকাতেই দেখলো একটা দীর্ঘদেহী ছায়ামূর্তি।অবিন্যস্ত চুলে দীর্ঘদিন চিরুনি পড়ে নি। গায়ে পাতলা চাদর।
“কে ..? কনিস্ক..?” রাতুল একটা ঢোঁক গিলে চাপা কণ্ঠে বলে ওঠে।
“না বাবু..। আমি কবরখানার চৌকিদার।এখানেই থাকি। পাশের সমাধিতে হাত দেবেন নি।কালকেই কবর দিয়েছি।এখনো কাজ চলছে বাবুর কথামতো..!”
“বাবুর কথামতো..! মানে ? কার কথা বলছো তুমি ভাই?”
“কনিস্ক দাদাবাবু..!” পরশু সকালে আমাকে ডেকে বললো,’আমি মরলে মৃত্তিকা দিদিমনির পাশেই আমায় কবর দিবি।এটাই আমার শেষ ইচছা..’ অনেকদিন ধরেই ভুগছিল।মরে গিয়ে বেঁচেছে বাবু..!”
রাতুলের হাত থেকে পড়ে যায় টর্চটা। প্রবল হাওয়ায় ছাতিম গাছটা তখনো দুলে চলেছে অনবরত…!