চুপ করে থাকা মানে কিন্তু হেরে যাওয়া বা কথার শেষ নয়, বিনা শব্দ অনেক কথা বলে,তা বোঝবার শক্তি বা অ্যান্টেনা সবার থাকে না।
না চাইতেও যখন দাঙ্গা হাঙ্গামার মারপ্যাঁচে জড়িয়ে যেতে হয়, গলা ফাটিয়ে বলতে ইচ্ছে হয়, ‘চাই না এমন মরণ যুদ্ধ যুদ্ধ খেলা’, এত না পাওয়ার দেশেও,মুখ খুললে প্রাণের ওপর দিয়ে যাবে বলে, স্পিকটি নট হয়ে থাকতে হয়,সে তো একরকম নিজেকে অস্তিত্বহীন ভাবেই পেশ করা।
যুধিষ্ঠিরকেই যখন কম কথায়, ‘অশ্বত্থামা হত, ইতি গজ,’এই ছোট্ট প্রাণঘাতী কথায়, মহা ভারতের যুদ্ধের মোড় ঘোরাতে হয়,পরে ক্ষণিক নরক বাস ও করতে হয়,এই কথা আর কেই বা না জানে।
ইহজীবনে দয়িত কে না পাওয়ার দুঃখ যখন তীব্র হয়, তখন,’চুপকে চুপকে আঁশু বাহানা ইয়াদ হ্যায়’,ছাড়া আর কি বা করার থাকে।
মহা সাইক্লোন এর আগে, প্রকৃতি একেবারে থম্ মেরে যায়,একটি কথাও বলে না,অথচ এই না বলা,কত কিছু বলা,নিস্তব্ধ পৃথিবী আগাম পূর্বাভাস দেয় ধ্বংসের।তা যে বোঝে সে বোঝে।
অনভিপ্রেত পরিস্থিতির ভবিষ্যৎ সম্ভাবনায় অনেক সময় মা বাবা কেও এক্কেবারে চুপ থাকতে হয়,অথচ তাদের ভেতর মন অনৈতিকতাকে মোটেও প্রশ্রয় দিতে চায় না।
খুব ছোট শিশু কন্যাটিকে হটাৎ ভীষণ শান্ত হয়ে যায়,কথার ফুলঝুরি মেয়েটি কারো সাথে কথা বলতে চায় না,তার মনটি যদি পড়তে পারা যেত তবে তার ভবিষ্যৎ জীবনটা এত বন্ধুর, এত ক্ষতবিক্ষত, হয়ত না হতেই পারত।
আত্মীয় পরিজনের ঘাটায় আঘাটায় স্পর্শ তাকে ভবিষ্যতের মনোরোগী করে তুলতেই পারে। যার কারণ সে হয়ত জীবনে আর কোনো পুরুষকেই বিশ্বাস করতে পারে না।
অথচ এক বোবা কান্না সে সারাজীবন বয়ে বেড়ায়।
দেহ মন যখন সাদা এক পট থাকে,হটাৎই কোনো দখনে দমকা হাওয়া,এঁকে চলে এক সুদৃশ্য ছবি,মুখে বলতে,সলাজে চোখ নীচে নেমে যায়, তখন সে নিশ্চুপে বলতেই পারে, ‘তুমি রবে নীরব, হৃদয়ে মম,নিবিড় নিশীথ পূর্ণিমা,নিশীথিনী সম’।
না সব যায়গায় মুখর হওয়া যায় না,বিশেষত এই সমাজে,যখন কোনো বিবাহিতের সঙ্গে, না চাইতেও এক ভালোলাগা ভালবাসার সম্পর্ক গড়ে ওঠে, প্রেম স্বকীয়া পরকিয়া জানে না, সে শুধু দয়িতের প্রতি তার এক আকাশ ভালবাসা বোঝে,যেখানে কোন দৈনতাই তাকে স্পর্শ করতে পারে না।
তখন প্রিয়ের কাছে পৌঁছোতে সুবাতাস কে সঙ্গে নিয়ে গেয়ে ওঠে, “চুপকে চুপকে চল রে পূর্বাইয়া,
বাঁশুরি বাজায়ে,রাশ রচায়ে, দৈয়া রে দৈয়া,গোপী ও সং কান্হাইয়া”।
অনেক সময় ধরে নেওয়া হয় ‘মৌনতা সম্মতি লক্ষণম্’।
মনের কথা, প্রাণের আকুতি যে সবসময় শব্দেই জানাতে হবে এমন নয়, তাই তো প্রাণের কবি বলে ওঠেন, ‘শুধু তোমার বানী নয়গো হে বন্ধু হে প্রিয়, মাঝে মাঝে প্রাণে তোমার পরশ খানি দিও’।
একটি কাহিনি মনে পড়ছে,এক ইংরেজ ভদ্রলোক সাত বার বিয়ে করেছিলেন ,সাত বারই বিয়ে ভেঙেছে, অষ্টম বারে তিনি একটি জার্মান রমনীকে বিয়ে করেন, এবং এতাবৎ তিনি সুখী দাম্পত্য জীবন যাপন করছেন,
এই সফলতার মূলে একমাত্র কারণ, কেউ কারো ভাষা বুঝতেন না।
ভাষা শব্দ অপশব্দ যদি জীবনে ভাঙন আনে, অস্থির করে তোলে পরিস্থিত, তবে নাইবা কথা বললাম, নীরবে তো অনেক বলা যায়।
যখন বিরহী চাঁদ মগ্ন প্রেমে,’চুপ করে চাঁদ সুদূর গগনে, মহাসাগরের ক্রন্দন শোনে’সে বিরহ সে প্রেম কি প্রেম নয়?
জীবনের শেষ পর্বে এসে প্রেমাস্পদ কে পাবার ব্যাকুলতা, অস্তিত্ব বিপন্ন করে,তাকে ছোঁয়ার আশা নীরব গহীনে, আকাঙ্খার প্রকাশ ঘটায়, জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত, তাই তো কবি বলেন,
‘চরণ ধ্বনি শুনি তবে নাথ,জীবন তীরে,
কত নীরব নির্জন, কত মধু সমীরে’।