ধারাবাহিক অনুবাদ গল্পে পূর্বা দাস (পর্ব – ১)

যুদ্ধের প্রহর

যদিও ব্যাপারটা তখনও তেমন গুরুত্ব পায়নি সকলের কাছে, কিন্তু প্রথম লৌহ পক্ষীটি আকাশে দেখতে পাবার আগেই খবর ছড়িয়ে পড়েছিল কানে – কানে। রাজ দেউড়ির সেপাইরাই এই অশুভ সংবাদ ছড়িয়ে দিচ্ছিল চারিদিকে। যাকে অবশ্য প্রথমে সবাই গুজবই ভাবছিল। রাজকীয় দৌড়নৌকার কান্না – এক ভয়ঙ্কর বিপদের সংকেত। হাইয়াং হাইরেল – এই নামেই ডাকা হয় ড্রাগনের মাথাওয়ালা সরু নৌকাটিকে। নৌকাদৌড়ের উৎসবের দিন এই নৌকাই নাকি কাংলাপটের তীরে আর্তনাদ করে উঠেছিল। বহু শতাব্দী ধরে মণিপুরের মানুষ জানে এই কান্না ভীষণ অমঙ্গল সূচক। প্রতিটি মানুষের অস্থিমজ্জায় মিশে আছে এই বিশ্বাস। খবরটা ছড়াতে লাগলো হাওয়ার সাথে। ধীরে, কিন্তু উষ্ণ উপত্যকায় হিমেল আশঙ্কার নিশান হয়ে। এই খবর প্রতিটি ছোট ছোট গৃহস্থালিতে প্রবেশ করছিল এবং শিহরিত করছিল জনমানস। তাই প্রথম যখন তারা এরোপ্লেন দেখতে পেল আকাশে, ততটাই বিস্মিত হয়েছিল, যতটা তাদের তাড়না করছিল একটাই প্রশ্ন, ‘ এসব এখানে এলো কেন?’
ছোট্ট মনিপুর রাজ্যের বেশিরভাগ অধিবাসীরাই গরীব এবং সাদাসিধা। যুদ্ধ শুরু হয়ে গেল হঠাৎই। আকাশ থেকে আগুনের বল নেমে আসছে যখন তখন এবং ভয়ঙ্কর বিস্ফোরণে ফালাফালা করছে চারিদিক। মানুষজন মানসিক বৈকল্যের শিকার হল দ্রুত। তারা দিনরাত তাকিয়ে থাকতো আকাশের দিকে। এমন ভয়ঙ্কর যুদ্ধ এদের অত্যন্ত দুঃস্বপ্নেও কখনো ছিল না।
কিন্তু তার চেয়েও বিস্ময়কর ভাবে প্রমানিত হল মানুষের গভীর অভিযোজ্যতা। কিছুদিন বাদেই তারা তাদের স্বাভাবিক ভক্তিমূলক জীবনযাত্রায় ফিরে গেল। যদিও সে সময়ও বোমাবর্ষণের খামতি ছিল না কোথাও। এমন নিষ্ঠুর ধ্বংসলীলা এই ছায়া উপত্যকা প্রথমবার জানছিল।
মন্দিরের ঘন্টাধ্বনি আবার শোনা যেতে লাগল এবং রাজপুরোহিতও যথারীতি পূজার্চনার নির্দিষ্ট কাজগুলি শুরু করেছিলেন। ভগবান শ্রীকৃষ্ণ ও রাধার মূর্তির নিত্যপুজা একইভাবে আবার শুরু হল যেমন আগে হত। তরতাজা ফল ফুল এবং ধূপের গন্ধে মন্দিরের পবিত্র ভাবটিও পূর্বাপর ছিল।
এই গল্পের মুখ্য চরিত্র যদি কুঞ্জবিহারী কে ধরা হয় তো তার বয়স তখন সতের। শহর থেকে বেশ দূরে পাহাড় ঘেরা উপত্যকায় কুঞ্জবিহারীদের গ্রাম। যেন খুশিতে উচ্ছ্বল কোন শিল্পীর আঁকা একটা অপূর্ব ল্যান্ডস্কেপ। কুঞ্জবিহারী এখন তার দলবলের সাথে খুবই ব্যস্ত থাকে সারাদিন। সবাই মিলে বড় বড় গর্ত খোড়ে ওরা। যুদ্ধের সময় গ্রামের মানুষজন যাতে বাঙ্কার হিসাবে সেগুলি ব্যবহার করতে পারে। কখন যে ওই উড়ুক্কু রুপালি মাছগুলো পেট থেকে বড় বড় ডিমের মতো আগুনের গোলা বের করে দেবে কেউ জানে না। এই কাজটা করতে গিয়ে কুঞ্জবিহারী এবং তার প্রতিবেশীরা বেশ আত্মপ্রসাদ পেল এবং এই যুদ্ধের তারাও কিছুটা অংশীদার এটা ভেবে গর্বিতও। এছাড়া এই আশ্চর্য যুদ্ধের সম্পর্কে আর কোন ধারনা ওদের ছিল না।
যুদ্ধ নিয়ে কুঞ্জবিহারীর মনে ভয়ের চেয়ে বিমুগ্ধতা ছিল বেশি। সে আশ্চর্য হত মানুষের একে অপরকে সংহার করার কুশলী রূপ দেখে। এত বিপুল ধ্বংস এ দেশে এর আগে কখনো কেউ দেখেনি, ভাবেওনি। ছোট থেকে একসাথে বেড়ে ওঠা বন্ধু সনাতনের সাথে একদিন সন্ধ্যা পর্যন্ত ট্রেঞ্চ কাটলো। পরদিন সকালে উঠে ও শুনল, সনাতনের বাবা-মা দুজনেই একসাথে মারা গেছেন। বোমা টা পড়েছিল ঠিক ওদের রান্নাঘরের পেছনে। ঘটনাটা এতই অবাক করা যে ওরা ঠিকঠাক শোক অনুভব করতেও পারছিল না। এরপর থেকে গর্ত খোঁড়া ওরা আরো বাড়িয়ে দিল। যত্রতত্র মাটি খুঁড়ে আশ্রয় বানাচ্ছিল, যাতে যতটা সম্ভব অপমৃত্যু আটকানো যায়।
কুঞ্জবিহারী রাত্রে রোজ তার শক্তপোক্ত চৌকির নিচে ঘুমাতো। অন্যদিকে ওর বাবা-মা এসব গ্রাহ্য ই করত না। ওর মা প্রায়ই বলে, “মরি মরব, তাবলে বাচ্চাদের মতো লুকোচুরি খেলতে পারব না।” কুঞ্জ কিন্তু যুদ্ধের ব্যাপারে যারা অভিজ্ঞ তাদের পরামর্শ মেনে চলাই পছন্দ করত। বেঁচে থাকাটা তার কাছে বেশ উত্তেজনাময় হয়ে উঠছিল দিনে দিনে। কুঞ্জবিহারীর বেশিরভাগ বন্ধুরাই থাংজম গোষ্ঠীর ছেলেপুলে। এখন এক নতুন খেলায় মেতেছে ওরা। ভেঙে পড়া যুদ্ধবিমানগুলোর অবশেষ নিয়ে আসছে খুঁজে খুঁজে। কুঞ্জকেও ডাকাডাকি করত প্রায়ই। একদিন ওরা বলল, “চল কুঞ্জ, আজ রাত্রে আমরা নদীতে নামব। একটা লোহা পাখিকে দেখলাম জ্বলতে জ্বলতে নদীর মধ্যে পড়তে। কপাল ভালো থাকলে আমরা ওটাকে প্রায় আস্ত অবস্থাতেই পেতে পারি।” কুঞ্জ এককথায় ওদের ‘ না ‘ বলে দেয়। এ কি ভয়ঙ্কর দুঃসাহসের খেলা শুরু করেছে ওর বন্ধুরা! সে ভাবে, থাংজম গোষ্ঠীর লোকেরাই এমন পাগল হয়। ওরা ক্ষ্যাপার মতো খুঁজছে লোহা পাখিদের ধাতব অংশ। নিজেদের জীবন বিপন্ন করে ওরা বিমানের ধ্বংসাবশেষ থেকে ভারী ধাতব পাত তুলে আনছে। পরে সেগুলোকে নিজেদের ইচ্ছেমতো কোন অস্ত্র বা অন্য দরকারি জিনিস বানিয়ে নিচ্ছে। এমন শক্তপোক্ত আর দামি ধাতুও তো আগে পায়নি কখনো ওরা। কুঞ্জ এটাও ভাবল, অন্তত একটা গোষ্ঠী তো ‘ইম্ফল যুদ্ধ ‘ থেকে কিছু ফসল ওঠাতে পারছে। ‘ বিশ্বযুদ্ধ ‘ কি, তার কিছুই ওরা বোঝেনি। ওরা শুধু জানে, বাইরের দেশের মানুষেরা কেড়ে নিতে এসেছে ওদের প্রিয় দেশটাকে।

ক্রমশ…

ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।