গল্পে অজন্তাপ্রবাহিতা
ডেটিং এপ
ঊনিশের ডিসেম্বরে পরেশ বাবু রিটায়ার হলেন । অফিসে যেতে না পারার দুঃখটা ঘুচতে না ঘুচতেই লকডাউন। বাবারে ! প্রাণ ওষ্ঠাগত।
সারাদিন কাজ বলতে,ভেজা কাপড় মেলা, শুকনো কাপড় তোলা, ময়লার বালতি কর্পোরশনের গাড়িতে খালি করা ,গিন্নি সবজি ধুয়ে শুকোলে,সেই সবজি ফ্রীজে তুলে রাখা, লঙ্কা ,কালোজিরে,জিরে ,মৌরি ছাদে শুকোতে দিলে সেগুলো উল্টে পাল্টে দিয়ে আবার ভালো করে শুকোনো।
ধুর ! ধুর ! কার ভালো লাগে এসব।
কোথায় অফিসার ক্যান্টিনে ভৌমিক বাবুর সাথে গল্প, লোকাল ট্রেনে অজানা অপরিচিত মুখের সাথে আড্ডা মেরে সময় কাটানো ,আর কোথায় এসব।
এসবের সাথে কাজে ভুল হলে গিন্নির মুখ ঝামটা তো আছেই। এই তো সেদিন,খোকা বিগ বাস্কেট থেকে বেশ গলদা চিঙড়ি পাঠিয়েছিল। গিন্নি সেগুলো ধুয়ে পরিষ্কার করে সানরাইজের প্যাকেটে ভরে দিয়ে বললো ,ফ্রীজে তুলে রাখো। আজ শনিবার। নিরামিষ। কাল মালাইকারি করে দেবোখন।
হলো কি ,সেই সময় একটা ফোন এসে পড়ায় কথা বলতে বলতে সান রাইজের প্যাকেটটা ফ্রীজে না রেখে ওয়াশিং মেশিনের সামনে রেখে দিয়েছিলেন। ব্যালকনির গ্রিলের সাথে মশার নেট খানা গিন্নি ধুতে নিয়েছিলেন । চোখের নিমেষে কাক এসে
সান রাইজের প্যাকেট খানা ছো মেরে নিয়ে গেলো।
কান থেকে ফোন নাবিয়ে ট্যাপ করে যে কল কাটা হবে,সে সময় টুকুও দিলো না।
তারপরে ,’গিন্নিরপাঁচালি ” না শুনলেও হবে।
গিন্নির তো রিটায়ারমেন্ট নেই,উনি আর কি বুঝবেন ?
টিভিতেও ‘কঙ্গনাপুরাণ’ দেখে দেখে পেকে যাওয়া ছাড়া আর কি আছে।
একদিন ছাদে ঘুরতে ঘুরতে পাশের বাড়ির পল্টুর কাছে কথাটা জানাতেই ও বললে,”ও কাকু ! এই সমস্যা , চাপ নিও না। ফোনটা দশ মিনিটের জন্য দাও। ”
“কী করবি ?”
” আরে কাকু ,সমস্যার সমাধান করবো। “এক্কেবারে মস্তানি সুরে বলে ওঠে।
পরেশ বাবুর হাত থেকে ফোনটা কেড়ে নিয়ে আঙ্গুল দিয়ে এদিক ওদিক করে কী করলো কে জানে ,ফোনটা ফিরিয়ে দিয়ে বললে,” কাকু ! ডেটিং এপ ডাউনলোড করে দিয়েছি। নাম ,রাহুল। আর প্রোফাইল পিকচারটা দীপের। তোমার টাক দেখলে কেউ রিকু দেবে না। খুশি থাকো । প্রেমে থাকো । সব ঠিক হয়ে যাবে। ”
বাড়ি ফিরে এসে আমতা আমতা করে গিন্নিকে জানাতেই বলে উঠলো,”যা খুশি করো ,আমার মাথা খাবে না। ”
সপ্তাহের মধ্যেই পরেশ বাবু বেশ ডেটিং এপে বেশ সড়গড় হয়ে উঠলেন। কিন্তু সমস্যা হলো,সকালে দুপুরে ,রাতে সবাই একই প্রশ্ন করে,কী করছো?
প্রতিবেলা বানিয়ে বানিয়ে কী বলা যায়। মাঝে মাঝে বলতে হয় ,”এই তো আজ মাছের ঝোলটা আমি বানালাম। খুব ভালো রান্না করি ,আমি। “গিন্নির বানানো মাছের ঝোলের ছবি নিজের নাম দিয়ে আপলোড করতেই সবার “বাহ্ বাহ্” শুরু হয়ে গেলো। কবে খাওয়াবে ,কী সুন্দর দেখতে , কী করে বানালে ইত্যাদি।
দু মিনিট কথা বলেই সবাই বেস্ট ফ্রেন্ড হয়ে যায়,সেলফি চায়। এগুলো খুব চাপ।
রোববারে সকালে উঠে মোবাইলটা খুলতেই ,সুনয়নার টেক্সট ,” গুড মর্নিং ,বেবি ”
“সুপ্রভাত ”
” এই জাগলে ?”
“হ্যা ”
“ইশশ এতো দেরিতে ? কলকাতা শহরতো চলতে শুরু করেছে। এখন আর কোথায় লকডাউন।”
” হ্যা ! তা ঠিক ,রাতে দেরি হয়ে গেছিলো শুতে। ”
” কেন, কী করছিলে ? নটি বয়। ”
” গ্যাস হয়ে গেছিলো ,তাই ঘুম আসছিলো না। ”
গিন্নি চায়ের কাপ নিয়ে এসে দিয়ে ঝাঁঝালো সুরে বলে ,” তরকারি আনবে ? নাকি চাল সেদ্ধ খাবে ? একটা আলুও নেই বাড়িতে। ”
“যাচ্ছি।”
আবার মোবইলে মেসেজ,এবার পায়েল।
“হাই ,জি এম”
“সুপ্রভাত”
“উঠেছ ? ”
“হ্যা ”
“এবার কী করবে ?”
“তরকারি আনতে যাবো” লিখতে গিয়েও থেমে গেলেন,নাহ এটা লেখা যাবে না।
চায়ের কাপে চুমুক দিতে দিতে গম্ভীর মুখে এই প্রশ্নের কী উত্তর দেয়া যায়, ভাবতে লাগলেন।
কর্তার সিরিয়াস মুখ দেখে গিন্নির কটাক্ষ প্রশ্ন ,”কী হয়েছে ? এতো মাথা চুলকোচ্ছো , বুড়ো বয়সে কোনো অকাজ করে বসো নি তো ?”
না পেরে,আমতা আমতা মুখ করে, পরেশবাবু সমস্যাটার কথাটা গিন্নিকে বললেন।
গিন্নি ঝাঁঝালো সুরে প্রশ্নের সমাধান বলে দিলেন ,” বলো ,ডার্লিং এই উঠলাম। এখন রেললাইনের পারে কচুবনে গিয়ে বসবো। ফেরার সময় এবাগান ও বাগান থেকে কিছু তরিতরকারি নিয়ে আসবো। “