ছোটদের জন্যে বড়দের লেখায় সাপ্তাহিক ধারাবাহিকে ঊশ্রী মুখোপাধ্যায় (নব্বইয়ের গল্প – ৯)

হারমোনিয়াম
একটা বাক্সের মত দেখতে যন্ত্র। সামনের দিকে লম্বা লম্বা সাদা কালো কাঠ, আঙুল ছোঁয়ালেই নিচে নেমে যায়। পেছন দিকে একটা গোটানো হাতপাখার মত কিছু, মধ্যিখানে ফুটো করা। ঐ পাখার মত জিনিসটা ধরে টানাটানি করলে, ফুটোগুলো দিয়ে ফুসফুস করে হাওয়া বের হয়। আর তখনই সাদা কালো কাঠে আঙুল রাখলেই প্যাঁ প্যোঁ ভ্যাঁ ভোঁ আওয়াজ বের হয়। এরেই নাকি কয় হারমোনিয়াম। শুধু তাই নয়, ঐ সাদা কালো কাঠের টুকরোগুলো হল রিড, আর পেছনের পাখার মত জিনিসটাকে বলে ব্লো, অপিনিহিতি মতে, বেলো। রোজ সকাল সন্ধে জিনিসটা একটা বড় কাঠের বাক্স থেকে বার করা হয়, আর দিদি সেটার আওয়াজের সঙ্গে গলা মিলিয়ে ‘আআআ’ ‘কৃষণো মুরারি, যমুনাকে তীর, গউবে চরাবত’ এইসব ভুলভাল বলে। না বাংলা, না হিন্দি, ভুলভালই তো। আর হচ্ছে সা রে গামা পাধা নি(এটাও ভুল, কারণ বোম ফেলেছে জাপানি টা কিছুতেই বলে না)। পাশে বসে পুলিশের মত পাহারা দিত মাসি অথবা বাবা যাতে অনেকক্ষণ ধরে যন্ত্রটি বাজানো হয়, ঐ সব গলাবাজি হয় আর যাতে আমি ফাঁক পেয়ে ‘রেওয়াজে’ বিঘ্ন না ঘটাই।
জ্ঞান হওয়ার পর হারমোনিয়ামের সঙ্গে এটাই ছিল আমার প্রথম সাক্ষাৎ। ‘সরগম’, ‘রেওয়াজ’, ‘খেয়াল’ ‘বন্দিশ’, শব্দগুলো তখন বহুদূরে।তখন একটাই স্মৃতি, দুই পাহারাদারের চোখ এড়িয়ে কি করে বেলোর দুটো দিকের আংটা খুলে দেওয়া বা মাঝের ফুটোগুলোতে ঝাঁটার কাঠি ঢোকানো অথবা নিদেনপক্ষে রিড টিপে ভ্যাঁপ্পোর ভোঁ আওয়াজ করা যায়। মোদ্দাকথা, হারমোনিয়ামের প্রতি ছোটবেলায় ছিল একটা অসীম কৌতুহল, তবে তার সঙ্গে সুর, তাল বা গানবাজনার সম্পর্ক বিশেষ ছিল না, ব্যাপারটা অনেকটা ছিল গিনিপিগ এর প্রতি বৈজ্ঞানিক এর মনোভাবের মত।
বেশ চলছিল। হঠাৎ গোলমাল পাকালেন মাসি মহোদয়া। তিনি আবিষ্কার করে বসলেন যে আমার গলা দিয়ে মোটামুটি ঠিকঠাক সুর বের হয়। ব্যস্ আর যায় কোথায়! বিজ্ঞানচর্চা মাথায় উঠল, ঘেঁটি ধরে বসিয়ে দেওয়া হল হারমোনিয়ামের সামনে। সাধো গলা! রীতিমতো অত্যাচার যাকে বলে। তখন তো শিশুদের মনস্তত্ত্ব নিয়েও কেউ ভাবত না, ঘরে বাইরে সর্বত্র তারা দু’চার ঘা খেতও,এমনকি আমির খানও নেহাতই হিরো ছিলেন, সিনেমা-টিনেমা বানাতেন না, বানালে হয়তো ‘মাসি সেহত কে লিয়ে তু তো হানিকারক হ্যায়’ এর মত একটা গান পাওয়া যেত।
হাসবেন না মশাই। অত্যাচার নেহাত কম ছিল না। রোজ সকাল বিকেল দু’বেলা খেলার থেকে এক এক ঘন্টা কেটে ঐ হারমোনিয়ামের সামনে বসিয়ে গলা সাধানো হত। কিন্তু তা বলে কোনদিন পড়ার সময় থেকে এক ঘন্টাও কাটা পড়েছে? সে গুড়ে বালি। ফল, যা হওয়ার, তাই হল। হারমোনিয়ামের সঙ্গে সম্পর্ক হল আদায় কাঁচকলায়।তার মধ্যে আর এক অত্যাচার ছিল ক্লাসিক্যাল গান(কেন যে ক্লাসিক বলা হত কে জানে)। কথা বোঝা যায় না, হাঁ হাঁ করে চেঁচিয়ে বড় বড় তান করতে হয় আর তার সঙ্গে হারমোনিয়ামে নির্ভুল আঙুল চালাতে হয়। কাঁহাতক সহ্য হয় হ্যাঁ? শেষমেশ মনে বিপ্লবী চেতনা। গলা সাধার সময় বাথরুমে ঢুকে দরজা বন্ধ। উপর্যুপরি কয়েকদিন। রেওয়াজের সাময়িক ইতি।
কয়েক বছর পর। মাসি শ্বশুরবাড়ি। দিদির পড়াশোনার চাপ বেড়েছে। গান ছেড়েছে। আজকাল ঐ হতচ্ছাড়া হারমোনিয়াম বাক্সেই পড়ে থাকে। হঠাৎ একদিন আবার বাক্সের ঢাকা খুলল। ও দিকে এক মিষ্টি মহিলা। “আমি দিদিমণি, তোকে গান শেখাব, শিখবি তো?” এক দেখাতেই ভালো লাগা, ভাব। শুধু দিদিমণি নয়, হারমোনিয়ামের সঙ্গেও। এবার ক্লাসিক্যাল ছাড়াও অন্য গানও শেখা হচ্ছে, ফাংশনে গাওয়া হচ্ছে, সঙ্গে আরো দুশো মজা। আশেপাশের বাড়ির অনেকেই গান শিখতে শুরু করেছে, গলা সাধার চোটে পাড়ার লোকের ত্রাহি মধুসূদন অবস্হা। সকালে ‘তোমারি গেহে পালিছ স্নেহে’, বিকেলে ‘শুকনো পাতার নূপুর পায়ে’। গলা ছেড়ে, যাকে বলে গলা ফাটিয়ে। বিশেষ করে পাশাপাশি বাড়িতে দুই বন্ধু, হারমোনিয়াম সহ। ‘তোমার দুয়ার খোলার ধ্বনি’ আর ‘ধিতাং ধিতাং বোলে’ র তারস্বরে যুগলবন্দী চলছে। ঐ সময় কাক চিল বসত কিনা জানিনা, তবে পাড়ায় কুকুর বেড়াল যে অদ্ভুতভাবে কমে গিয়েছিল, সেটা সত্যি।
অনেক গুলো বছরই কেটেছিল এভাবে, হারমোনিয়াম আর মানুষের। এক এক সময় রেওয়াজ অসহ্য লেগেছে, দিদিমণির মত ঠান্ডা মানুষও বকাবকি করেছেন, ছেড়ে দিতে ইচ্ছে করেছে, তবু ছাড়ব ছাড়ব করেও ছাড়া হয় নি। গান জীবনের পাকে পাকে এমনভাবে জড়িয়েছে, যে হাজার অবহেলাতেও সে নিজেও পুরোপুরি ছেড়ে যায় নি। ছাত্রজীবন থেকে কর্মজীবনে পা, আবার হারমোনিয়াম বাক্সবন্দী, কারণ দিদিমণির বয়স হয়েছে, ছাত্রীর সময় নেই। তবে গান আছে, প্রতি মুহূর্তে।
হারমোনিয়ামের অভিমান হয়। ছোটবেলা থেকে এত অত্যাচারেও যে টিকে আছে, আজ তার গায়ে জমছে ধুলো, কাঠের ফাঁকে ঘুণপোকার বাসা। না হয় গলা সাধতেই হত একটু, তা বলে এত উপেক্ষা? সুর ভাঙতে থাকে হারমোনিয়ামের, আর চিৎকার করে করে গলারও।
হয়ত গল্পটা এভাবেই শেষ হয়ে যেত, যদি না অনেকগুলো বছর পর বাক্সটা হঠাৎ খুলত। হারমোনিয়ামের গায়ে উঠত পালিশ, সারানো হত, আবার ফিরে আসত। আর তার নতুনভাবে সাজানো রিডে আঙুল ছোঁয়ানোর মুহূর্তে মনে আসত চিরাচরিত আকর্ষণ বিকর্ষণের গল্প। গলা সাধার, নির্ভুল বাজাতে চেষ্টা করা, অথবা না করার, রাগ করে হারমোনিয়ামকে ‘শয়তানের কল’ বলে গাল দেওয়ার আর ফাংশনের আগে সবাই মিলে ‘আজি শুভদিনে পিতার ভবনে’ গাওয়ার।টুকরো স্মৃতির কোলাজ, এখনো সাজানো, যাতে আবার ফিরে আসা যায়, সুর খুঁজতে। আসলে কিছু কথা অকিঞ্চিৎকর হলেও, মনে থেকে যায়, জীবনভর। মানুষও বারবার সেই গল্পের কাছেই ফিরে আসে।