বিভূতি ভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘কিন্নর দল’এর মতো আমাদেরও একটা দল ছিল। নাচ গান নাটকের দল। রবিবর্তিকা।নামটা বাবার দেওয়া।শুনলে মনে হয় রবি ঠাকুরের সঙ্গে এর যোগ আছে।আদতে তা নয়,এর অর্থ সূর্যের আলোর সঙ্গে সম্পৃক্ত।
নামটা দেওয়া যদিও বাবার,তবু এটা নিয়ে তাঁর কোনও উৎসাহ ছিল না।বরং শান্তি বিঘ্নিত হচ্ছে বলে বকতেন।
বাবা দীর্ঘদিন পর্যন্ত জানতেনই না আমি নাচ শিখি ও অনুষ্ঠান করি।আমার প্রথম নৃত্যগুরু আয়ুস্মতী চক্রবর্তী।তাঁর সঙ্গে আমি বহু অনুষ্ঠান করেছি এবং বেশিরভাগই মূল শিল্পীর ভূমিকায়। আশির দশকের শেষে আর নব্বই দশকের প্রথমে বিভিন্ন পত্র পত্রিকায় শুরু হল শিল্প সংস্কৃতি পাতায় আমার ছবি ও নাচের প্রশংসা।
বাবা কাগজ খুব মনোযোগ দিয়ে পড়তেন না।পছন্দ না হলে খালি হেডিং দেখে রেখে দিতেন।
একদিন সকালে দেশ পত্রিকা পড়ছেন।এটি তিনি নিয়মিত পড়তেন।শিল্প সংস্কৃতি পাতায় একটি মেয়ের ছবি দেখে মাকে ডাকলেন।
সকাল বেলায় স্নানে যাবার আগে সাড়ে আটটায় দুজনে একসঙ্গে চা খেতেন।এরপর স্কুলের জন্য প্রস্তুতি। মা চা করে বাবার ঘরে ঢোকা মাত্র বাবা বললেন,আজ দেশে একটা মেয়ের ছবি দেখে চেনা লাগল।অনেকটা সাজলে গুজলে মনাকে যেমন লাগবে।
মা বলল,তা নাম দেখনি?
নাহ।
দেখো তাহলে।
বাবা আবার পাতাটা খুলে দেখে বললেন শ্রীমতীর ভূমিকায়… বলে থেমে গেলেন।
কি গো পড়ো।
বাবা গম্ভীর মুখে বললেন,মনা যে নাচ করে জানি নাতো!
তারপর আমাকে ডাকলেন।কতদিন এসব হচ্ছে?
আমি চুপ করে রইলাম।মা বাঁচিয়ে দিল।স্কুলের দেরী হয়ে যাবে।শিগগিরই স্নানে যা।
এরআগে অবশ্য মা আয়ুস্মতীদিকে একদিন বলেছিলেন,তোমার দাদা তো খুবই নামী ব্যক্তি।তোমার অনুষ্ঠান করতে তো ভালোই খরচ হয়,সুভিনিয়রও করো দেখি।এক কাজ করো, তুমি নিজে এসে দাদাকে চিফ গেস্ট করার প্রস্তাব দাও ও বিজ্ঞাপন দিতে বলো।
দিদি যথারীতি এক অনুষ্ঠানের আগে এলেন বাড়িতে ও বাবাকে অনুরোধ করলেন।বাবা রাজিও হলেন।
বাবা দিদির অনুষ্ঠানে গেলেও হয়তো স্টেজে খানিকক্ষণ থেকে চলে এসেছেন।আর বেশিরভাগ সময়ই অফিস থেকে যাওয়ায় আমরা যে বাড়িতে নেই, অনুষ্ঠানের অংশগ্রহণকারী তা জানতেও পারতেন না।ফলে আমি এখনো নাচ করি এটা বাবার অজানাই ছিল।
আমি ঘর থেকে চলে যাবার সময় শুনলাম,মা বললেন, কিগো তুমি তো অনুষ্ঠানে গেছিলে,বক্তব্যও রাখলে,অথচ জানোও না তোমার মেয়েই মুখ্য ভূমিকায়!তা কি লিখেছে?
বাবা তখন লেখা পড়ে উচ্ছ্বসিত হয়ে বললেন,লিখেছে শ্রীমতীর ভূমিকায় বিতস্তা ঘোষাল অসাধারণ অভিনয় করেছেন।এত অল্প বয়সে এই অভিব্যক্তি মনে দাগ কাটে।
বিতস্তা ঘোষাল শব্দটা বাবা বেশ জোরে উচ্চারণ করলেন।
মা হেসে ঘর থেকে বেরিয়ে এলেন।আমিও তাড়াতাড়ি স্নানে ঢুকলাম।মূলত মায়ের উৎসাহেই আমাদের দল গড়া হল।এর যাবতীয় দায়ভার মা গ্রহণ করলেন।এমনকি হল বুক করা থেকে যা যা খরচ অনুষ্ঠানের তার সবটাই প্রথম কয়েকবার মা’ই করলেন।পরবর্তী সময়ে হল বুক মা করতেন।পরে আমরা টাকা তুলে সে টাকা দিয়ে দিতাম।ধীরে ধীরে একটা ফান্ড তৈরি হল।
প্রথম যে বার রবিবর্তিকা অনুষ্ঠান হলে করবে বলে ঠিক করল,তখন আমি ক্লাস এইটে পড়ি।মূলত মায়ের ইচ্ছায় আর পাড়ার বন্ধু, মায়ের স্কুলের ছাত্রী, পাড়ার কিছু দাদার প্রচেষ্টায় দুটো নৃত্য নাট্য হবে ঠিক হল।একটা রাখাল ছেলে আরেকটা নকসী কাঁথার মাঠ।প্রথম টা সুকান্ত ভট্টাচার্যের, আরেকটা জসিমউদ্দীনের কবিতা।এবার এর নৃত্যরূপ, স্ক্রিপ্ট, কি গান কোথায় যাবে তার সবটাই আমি আর ঝুম মিলে ঠিক করলাম।আর আমাদের পাড়ার এক অল্পবয়স্ক মিউজিসিয়ান, যিনি এখন খুবই জনপ্রিয় তিনি আমাদের লেখা সেসব গানে সুর দিলেন। একটা গান ছিল -মাগো মা তুমি রাগ কোরো না,ও যে রাখাল ছেলে,মানুষ নয়,সে যে কাছে গেলে বড় খুশি হয়,মাগো বড় খুশি হয়।
এটা হরিণ শিশু তার মাকে বলছে।যেখানে তার মা তাকে মানুষের ছেলের সঙ্গে মিশতে বারণ করছে।
এখন এই গানটা আমি লিখে দিলাম,কিন্তু সুর কি হবে?সেই দাদা, আমরা তাকে বাবুলিদা বলে ডাকি,তিনি সুর দিলেন তখনকার সদ্য প্রকাশিত এক জনপ্রিয় সুপারহিট গান ফার্স্ট টাইম দেখা তুজে লাভ হো গয়া,সেকেন্ড টাইম মে পেয়্যার হো গয়…এর সুর।
মা পড়লেন চিন্তায়।কপি রাইট নিয়ে প্রশ্ন উঠবে নাতো!আমি তখনো এ বিষয় সম্পর্কে পুরো অজ্ঞ। বাবুলিদা সব শুনে এমনভাবে দু একটা জায়গা পরিবর্তন করে দিল যে কেউ সরাসরি কিছু বলতে পারবেন না।তা সে গানের সঙ্গে দর্শক ফাটিয়ে হাততালি দিল।
আরেকটা কাজও করেছিলাম।আমাদের এক শিক্ষক বললেন,জসিমউদদীন রবীন্দ্রনাথকে পছন্দ করতেন না।তাই শুনে নকসী কাঁথার মাঠে আমি মূল গান গুলো সব রবীন্দ্রনাথের রাখলাম।মাঝে লোকসংগীত ঢোকালাম।আমার মনে হল,এভাবেই দুজনের মধ্যে ভাব করিয়ে দিলাম।
এর আগে আমরা একটা কাজ করেছিলাম।পাড়া ঘুরে চাঁদা সংগ্রহ। সে অর্থে কাউকে চিনি না।সঙ্গে পাড়ার এক দাদা, মনোজ দা,তবলা বাজাতো,(আমাদের স্কুলের এক সিনিয়র দিদির সঙ্গে তার তখন প্রেম চলছে, তাকে স্কুলের অনুষ্ঠানে তবলা বাজাতে দেখেছিলাম)সেই দাদাকেই ধরলাম।সে আমাদের দুই বোন,শাশ্বতী (আমার ঘনিষ্ঠ বন্ধু, গানের দিকটা সেই পরিচালনা করত,)তার বোনেরা (ছোট বোন স্বাতী- আমার বিপরীতে যতদিন নাচ করেছি পুরুষ চরিত্র করেছে )নিয়ে পাড়ার প্রতিটি বাড়ি ঘুরতে শুরু করল।বিকেল পাঁচটা থেকে ছটা পর্যন্ত। অবশ্য এতে মা ভীষণ রেগে গেছিল,আর বাবা তো জানতেই পারিনি।জানলে আর কোনও জন্মে প্রোগ্রাম করা হত না।
যাহোক মনোজ দা একটা করে বাড়ি নিয়ে যায়,আর আমাকে দেখিয়ে বলে,এই বাচ্চামেয়েটা একটা অনুষ্ঠান করছে পাড়ার সব বাচ্চাদের নিয়ে, যদি একটু সাহায্য করা যায়!
শুনে কেউ বলেন,আঃমলো যা!এ আবার কি!লোকের বাড়ি টাকা তুলে নাচ গান!
আবার কেউ নিরস বদনে দু টাকা,এক টাকা দেন।
একটি বাড়িতে গেলাম।মনোজদা বলল,এরা খুব বাজে, এক পয়সাও দেবে না।
গেট খুলল এক দিদি।জিজ্ঞেস করল কি দরকার!
আমি বললাম।
দাঁড়াতে বলে ভিতরে চলে গেল।মনোজদা বলল,নিশ্চয়ই মাকে ডাকতে গেছে।যা ঝগরুটি ওর মা।চল চলে যাই।
আমি বরাবর ডাকাবুকো। এসব নিয়ে ভয় পাইনা।আর অন্যায় তো করছি না।অপেক্ষা করলাম।
মিনিট পাঁচেক বাদে সেই দিদি এলো।সঙ্গে মা।তাকিয়ে দেখলাম মনোজ দা নেই। কখন সরে গেছে কে জানে!
আমরা অপেক্ষা করছি কি বলে শোনার জন্য। আমাদের আশ্চর্য করে দিয়ে কাকিমা বললেন,বকাটেগিরি না করে বাচ্চাদের নিয়ে একটা সুন্দর অনুষ্ঠান করছিস,আমি খুব খুশি, আমাদের কালচারটাই খারাপ হয়ে যাচ্ছে। তোরা যে রবীন্দ্রনাথকে মনে রেখে অনুষ্ঠান করছিস তাতেই আমি খুশি।
আমি কিছু বলতে গেলাম,এটা রবীন্দ্রনাথ নিয়ে নয়,কিন্তু শাশ্বতী হাত চেপে ধরল।হেসে বলল,হ্যাঁ কাকিমা দেখতে যাবেন।
কাকিমা একটা একশো টাকা আর একটা একটাকার কয়েন দিলেন।
আমরা অবাক হয়ে গেলাম। এত টাকা তো কেউ দেয়নি।বললাম, কত টাকা ফেরত দিতে হবে?
বললেন,ফেরত নয়,পুরোটাই দিলাম।জমিয়ে ফাংশন কর।লাগলে আরও দেব।
সেই মুহূর্তে মনে হল কাকিমা সাক্ষাৎ মা লক্ষ্মী।
সবাই ধপাধপ প্রণাম করে চলে এলাম।
ধীরে ধীরে রবিবর্তিকার খ্যাতি ছড়িয়ে পড়ল আশেপাশেও।প্রতি বছরই ছ সাতটা অনুষ্ঠান করতে শুরু করলাম বিভিন্ন জায়গায়। কলশোর সংখ্যা বাড়ছিল ক্রমশ। এবার এলাকার বিশিষ্ট শিল্পীদের পাশাপাশি অনেক প্রতিষ্ঠিত জনপ্রিয় শিল্পী, অভিনেতা,পরিচালকও আমাদের সাহায্য করতে এগিয়ে এলেন।
দিনগুলো যেন উপচে পড়ত আনন্দে।প্রতিদিন সৃষ্টির আনন্দে ভরে থাকত গায়ত্রী নিকেতন। একদিকে আমার বাবার অধ্যাত্ম সাধনা অন্যদিকে মায়ের কর্মব্যস্ত জীবনের মাঝে আমাদের নাচ গান নাটকের রিহার্সাল, বাটিতে বাটিতে মুড়ি,চপ,চানাচুর,কখনো বোন বানাচ্ছে লুচি,আলুরদম,আলুভাজা,কখনো অন্য কেউ অন্য কিছু আর মা নিরলসভাবে হাসিমুখে সকলকের তদারকি করছেন,তার মাঝেই একবার খানিকটা পড়িয়ে নিলেন ইংরেজি গ্রামার,ইতিহাস, ভূগোল…শুধু যে আমরা তিনবোন পড়লাম তা নয়,যতগুলো ছেলে মেয়ে রিহার্সাল করছিলাম সকলেই মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে মায়ের পড়ানো শুনলাম,সকলেই কিভাবে যেন জানতাম পরের রিহার্সালে মা এগুলো ধরবেন,লেখাবেন,তাই প্রস্তুত হয়ে নিতাম, আমার মা আমাদের একক গন্ডী ভেঙে তখন সকলের মা হয়ে উঠতেন,আর আমি যে চার বছর বয়স থেকেই দুই বোনের জন্য মায়ের পাশ হারিয়েছি,অধিকার হারিয়ে নিজেকে ধীরে ধীরে সরিয়ে নিয়েছি মায়ের থেকে,সেই চৌদ্দ পনেরো ষোলো বয়সের একটা মেয়ে মনে মনে মায়ের জন্য অহংকারে উচ্ছ্বসিত হত,ভাবত,দেখ ঝুম রুম মাকে তোরা যতই বেঁধে রাখ নিজের করে,আসলে মা সর্বজনীন। আমি তোদের স্বেচ্ছায় মাকে দিয়ে দিয়েছি।তবে যদি চাই মাকে এক মুহূর্তে নিজের করে নেব।
অথচ আমি মনে মনে এটাও জানতাম, মায়ের ওপর অধিকার প্রয়োগ করতে গেলে যে জোর দরকার তা আমার বিন্দু মাত্র নেই। আসলে অধিকার করে যা পাওয়া যায় সেই বিষয়টার প্রতিই আমার আসক্তি চলে গেছিল চার বছর বয়সে।যেদিন সে ভোরবেলা শুনেছিল,মুনাই তুমি এখন বড় হয়ে গেছ।বড়দিদি বোনেদের কাছে মায়ের মতো হয়।