বাবা দাড়ি কামাচ্ছেন। কাচের বাটিতে করে গরম জল দিয়ে গেছেন মা। গোল একটা টিনের বাক্সে সাদা একটা দাড়ি কামাবার সাবান। ও সাবানটা গায়ে মাখা যায় না।
দেরাজের গায়ে বেলজিয়াম গ্লাসের আয়না। বাবা পায়জামার উপরে গেঞ্জি পরে দাড়ি কামাচ্ছেন।
খোকা মায়ের বিছানায় বসে “জ্ঞানের আলো” নিয়ে খেলছে। জ্ঞানের আলো আসলে একরকম খেলনা। একটা বোর্ডের একদিকের কলমে থাকে প্রশ্ন, অন্য দিকে কলমে উত্তর। এলোমেলো করে সাজানো থাকে। প্রশ্নের গায়ে তারের একটা দিক আর সঠিক উত্তরের গায়ে তারের আরেকটি দিক ঠেকাতে পারলেই ব্যাটারির জোরে আলো জ্বলে ওঠে। পিছনে রয়েছে তারের কাজ।
খোকা বলল, বাবা, এ জিনিসটা একেবারেই বাচ্চাদের খেলা। পিছনে তারের কানেকশনটাই আসল। যদি মিস্ত্রি ভুল উত্তরে তার জড়িয়ে রাখত, তাহলে ভুল উত্তরেই আলো জ্বলত। এর মধ্যে বুদ্ধির কিছুই নেই বাবা।
বাবা বললেন, হুঁ।
খোকা বলল, মানুষ অনেক জিনিস ভুল জানে। ঠিকটা কেউ ধরিয়ে দিলে ক্ষেপে যায়। মারধোর করে।
বাবা বললেন, হুঁ।
আবার ভুল কথা বললেও অনেক সময় তাকে মাথায় নিয়ে নাচে।
বাবা বললেন, প্রথমটার উদাহরণ কি?
খোকা বলল, গ্যালিলিও গালিলি। বললেন পৃথিবী সূর্যের চারিদিকে ঘোরে। একটা সোজা কথা। ঠিক কথা বলার জন্য জেলে পুরে দিল।
আর দ্বিতীয়টা?
খোকা বলল, ক্রিস্টোফার কলম্বাস। পুরোপুরি ভুল একটা জায়গায় পৌঁছে আনন্দে আত্মহারা। ভারতে পৌঁছে গেছি। ভাগ্যিস আমেরিগো ভেসপুচি ভুলটা ধরিয়ে দিল। বাবা, আপনি কি সেফটি রেজরে দাড়ি কামান?
হুঁ।
খোকা বলল, সতেরো শো পঁচিশ সালের সেপ্টেম্বরে জাঁ জ্যাকস পেরেট সেফটি রেজর আবিষ্কার করেছেন।
বাবা বললেন, বেশ।
আধুনিক যুগে জিলেট ভাল সেফটি রেজর তৈরি করেছেন। ঊনিশ শো চার সালে। বাবা, আপনি যখন দাড়ি কামাবেন, খুব সতর্ক হয়ে কামাবেন।
বাবা পিছন ফিরে ছেলের দিকে তাকান। বলেন, অসতর্কতার কোনো কিছু চোখে পড়েছে?
খোকা বলল না, রবার্ট ক্লাইভের কথা মনে পড়ে গেল কি না, তাই বলছি।
হঠাৎ ক্লাইভের কথা কেন?
খোকা বলল, নিজের ওপর রাগে ঘৃণায় ক্লাইভ নিজের গলায় ক্ষুর চালিয়ে আত্মহত্যা করেন। পাপ বাপকে ছাড়ে না।
ডেটল হাতে নিয়ে জল মিশিয়ে গালে ঘসতে ঘসতে বাবা বলেন, তুমি কি আজকাল পাপ পুণ্যের হিসেব রাখা শুরু করেছ?
খোকা বলল, অনেকে ভুল করে। কিন্তু টের পায় না যে ভুল করছে। অনেকে টের পায়। খারাপ লাগা থেকে বাঁচতে আত্মহত্যা করে। হিটলার আত্মহত্যা করেছিল।
মা ডাকছেন। যাই বলেও বসে রইল খোকা। জিজ্ঞাসা করল, বাবা আপনি আর জ্যাঠামশায় রোজ দাড়ি কামান কেন?
বাবা জবাব দিলেন, দাড়ি কামালে ভাল লাগে।
খোকা বলল, মোটেও না। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর দাড়ি কামাতেন না, দেখতে তো কই খারাপ লাগে না। কার্ল মার্কস, এঙ্গেলস দাড়ি কামাতেন না। খারাপ তো লাগে না।
বাবা বললেন, এটা অভ্যাস। কেউ কামায়। কেউ কামায় না।
বাবা, দাড়ি হয় একরকম হরমোনের জন্য। আবার দাড়ি হয় না আরেক রকম হরমোনের জন্য। মেয়েদের কারো কারো দাড়ি গোঁফ গজায় হরমোনের গণ্ডগোল হলে।
বাবা বললেন, হুঁ।
খোকা বলল, বাবা, এই যে আমার গলার স্বরটা বদলে গেছে, এটা হরমোনের জন্য।
বাবা বললেন, হ্যাঁ। তুমি বড় হচ্ছ। এখন খাওয়া দাওয়া ভাল করতে হবে। অনেকটা লম্বা হতে হবে।
বাবা, লম্বা হওয়াই কোনো লক্ষ্য হতে পারে না। বিদ্যাসাগর মশায় লম্বা ছিলেন না। তা বলে মানুষ হন নি, বলা যাবে না।
মা প্লেটে করে ডিমসিদ্ধ নিয়ে ঘরে ঢুকলেন। খোকাকে বললেন, কি রে, যাই বলে সাড়া দিয়েও বসে রইলি যে?
বাবার সাথে গুরুত্বপূর্ণ আলোচনা হচ্ছিল।
খোকার জবাব শুনে মা বাবার দিকে অবাক হয়ে চেয়ে রইলেন। তারপর বললেন, খোকা, অনুকে ফোন করতো বাবা। আজ বিকেলে ঘুগনি হবে। ঘুগনি বড়ো ভালবাসে মেয়েটা।
আজ সে আসতে পারবে না মা।
কেন রে, কি হয়েছে তার?
ওদের আরেকটা মোটরগাড়ি নিয়েছে। তাতে চড়ে বিড়লা প্ল্যানেটারিয়াম বেড়াতে যাবে।
মা বললেন, তা তুইও যা।
আমি প্ল্যানেটারিয়াম যাব কেন? ওরা তো সত্যি সত্যি তারা দেখাবে না। গোল একটা ছাদের ভিতর দিকে আলো ফেলে দেখাবে।
মা বললেন, তা ওরা যা দেখায়, ভাল বলেই তো লোকজন দেখতে যায়।
ঝাঁঝিয়ে উঠে খোকা বলল, বাজে বোকো না তো! যা বোঝো না, তা নিয়ে কথা বলো কেন? তুমি জানো, সূর্যের পরে আমাদের সবচাইতে কাছের তারা কোনটা? ধ্রুবতারা কতদূরে আছে? আমাদের প্রতিবেশী গ্যালাক্সির নাম কি? শনিগ্রহের কটা চাঁদ?
অভিমান করে মা বললেন, তোর মতো সারাক্ষণ বই মুখে বসে থাকি আমি? যাবি না তো যাবি না। এত রাগ কেন?
খোকা ঘোষণা করল, অনু ওর স্কুলের কয়েকজন মেয়েকে নিয়ে একসাথে যাচ্ছে। আমাকেও অনেক করে যেতে বলেছিল। আমি রাজি হই নি।
মা বললেন, কেন, কদিন আগেও অনু ছাড়া চলত না তোমার। হঠাৎ করে কি হল?
গুম হয়ে থাকে খোকা। বাবা মাকে ইঙ্গিতে থামতে বলেন।
খানিকটা সময় পরে খোকা বলে, ও ওর স্কুলের বন্ধুদের আগেভাগেই জানিয়ে ফেলেছে। আমার সঙ্গে কোনো আলোচনা না করেই ডিশিসন নিয়েছে।
বাবা বললেন, ঠিক আছে। আমরাও একদিন কলকাতা বেড়াতে যাব।
নাঃ, ভিড় আমার আর ভাল লাগে না।
মা বললেন, তুই আজকাল খেলতে যাস্ না, সাইকেলের কোনো যত্ন নিচ্ছিস না, হলটা কি তোর?
খোকা বলল, বলছি তো আমার আর কিছু ভাল লাগে না।
মা শুকনো মুখ করে বাবার দিকে তাকান। বাবা জানালা দিয়ে দূরের দিকে তাকিয়ে আছেন। একটা চিল একা একা আকাশে পাক খাচ্ছে।
সারাদিন ধরে লাইব্রেরি ঘরে বসে অঙ্ক করছে খোকা। বাবা কাছেই ইজি চেয়ারে বসে আছেন। দুপুর গড়াতে মা বাতাবিলেবু ছাড়িয়ে নুন মরিচ মেখে টেবিলে রেখে গেলেন। খানিকক্ষণ পরে এসে দেখলেন যেমনকার লেবু তেমনটি পড়ে আছে। খোকা মুখে তোলে নি। মা মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন, আমি খাইয়ে দিই? বিনা বাক্যব্যয়ে খোকা খেতে থাকল। মা অভিমান করে বললেন, আজকাল তুই দরকার ছাড়া কথাটি বলিস না। কেন রে?
পড়ার চাপ মা।
মোটে ক্লাস নাইনে পড়িস। ভাবসাব দেখাস যেন এম এ ক্লাসে পড়ছিস। এত গাম্ভীর্য কেন?
আমাকে হোস্টেলে পাঠিয়ে দাও মা।
বাবা বললেন, রিকশায় পাঁচটা মিনিট লাগে না স্কুলে যেতে। হোস্টেলে সিট দেবে কেন? এখানে অক্সফোর্ড কেমব্রিজ ওয়েবস্টার ডিকশনারি, গ্লোব, এনসাইক্লোপিডিয়া। হোস্টেলে এমন মিলবে?
বিকেল গড়াতে জ্যাঠামশায় ফিরলেন। লাইব্রেরি ঘরে এসে বললেন, খোকা তোর অনুকে দেখে এলাম।
খোকা ব্যগ্রভাবে বলল, কলকাতায় যায় নি?
বড় জ্বর হয়েছে রে। ওর বাবা ডেকেছিল। দেখে এলাম। ওষুধ দিয়ে এসেছি।
মায়ের বুকে মুখ রেখে ডুকরে উঠল খোকা।
বাবা বলল, মাকে নিয়ে যা, একবার দেখে আয়।
অনুর বাড়িতে গিয়ে তার হাতটা ধরে বসে রইল খানিকক্ষণ। কোনোরকম সংকোচ বোধ করল না।
ফেরার সময় অনু তার কানে কানে বলল, আমাকে আর কখনো বকিস না। সকালে তুই বকেছিলি বলে কেঁদে কেঁদে জ্বর বাধিয়েছি।
খোকা মনে মনে বলল, আর কোনোদিন কাঁদাব না।
ক্রমশ…