সন্ধ্যা ঘনিয়ে এসেছে। অনেক দূর থেকে ধুপের গন্ধ পাচ্ছিলাম। আযান হওয়ার পরপরই শাঁখ বাজছে পঁঅঅ শব্দে। চন্দ্রিমা অস্থির হয়ে উঠেছিল, বাড়ি যেতে হবে, দেরি হয়ে গেল!- কী কলঙ্কই না রটবে?
আমরা দূর মাঠের মধ্যে থেকে জোরে জোরে পা ফেলে চলে আসার চেষ্টা করছিলাম। মনের টানে খেলতে খেলতে মাঠ পেরিয়ে, যেতে যেতে নদীর ধারে চলে গিয়েছিলাম।
ফিরছিলাম দ্রুতই। তবুও বুকের ভিতর ধড়ফড় করছিল। যখন বাড়ি পৌঁছে যাই তখন কাকীমা বেশ চোখ পাকিয়ে, আমাকে হালকা বকাবকি করছিল,বদছেলি রাতে বাইরি থাকে কেউ ?
আমি ঘাড় নিচু করে দাঁড়িয়েছিলাম। নিজেকে বেশ অপরাধী মনে হচ্ছিল।
এমন সময় দিদি এসে চন্দ্রিমাকে কড়া গলায় বলে,এই যা বাড়ির ভিতরে যা,ধাড়ি হয়ে যাচ্ছে বুদ্ধি হচ্ছে না? তারপর বেশ শান্তভাবে, আস্তে আস্তে আমার কাছে এসে, তার বাম হাত দিয়ে আমার মাথার চুল ধরে,আলতো করে, টানতে টানতে নিয়ে গিয়ে বারান্দায় বসায়। আমি বসে থাকি হাবাগোবা ভদ্র বালকের মত।
আমার মুখের চিহারা দেখে, দিদি হেসে আমাকে জড়িয়ে ধরে। নিয়ে নেয় তার বুকের মধ্যে। বুকের সাথে আটকিয়ে রেখেছিল অনেকক্ষণ। একধরনের সুখের অনুভূতিতে আমার মন উতলা হয়ে উঠেছিল। নরম ও উষ্ণ বাতাসে ওম-ওম অনুভব করছিল আমার সারা শরীর।
আমার হাতে সাদা কাগজে ভাঁজ করা একটা কাগজ দিয়ে বলেছিল, তুই এই চিঠিটা ভদ্র ছেলের মত ইউসুফ ভাইকে দিয়ে বাড়ি যাবি। তাহলে তোর সব শাস্তি মাপ হবে।
আমি মাথাটা ঘুরিয়ে হ্যাঁ-সূচক সম্মতি জানিয়ে দৌড় দিই।
ইউসুফ ভাইদের বাড়ি ছিল আমাদের বাড়ি থেকে চার বাড়ি পরের বাড়ি। আমি ভয়ে ভয়ে তাই করেছিলাম। অর্থাৎ চিঠিটা ইউসুফ ভাইর হাতে দিয়ে এক দৌড়ে বাড়ি পৌঁছিয়ে গিয়েছিলাম।
ঠিক বাড়ি পৌঁছানোর আধাঘণ্টা পরেই চন্দ্রিমাদের বাড়ি হৈচৈ শুরু হয়ে যায়। তারপর খুব দ্রুত পুরো পালপাড়ায় কান্নাকাটি চলতে থাকে,দুমদুম দড়ামদড়াম শব্দে গুলির শব্দ হতে থাকে। একই বছরে তিন-তিনবার পালপাড়ায় ডাকাতরা এসে টাকা-পয়সা গয়নাগাতি সব নিয়ে যায়। এলাকার সবাই ভয়ে ভয়ে চুপ হয়ে থাকে। সকালে আমরা দেখতে যায়। সেবার চন্দ্রিমার মা’র কান থেকে জোর করে টান মেরে দুলজোড়া ছিড়ে নিয়েছিল। রক্তাক্ত কান দিয়ে রক্ত পড়ছিল। বাড়ির সকলেই খুব কানছিল। আব্বাকে জড়িয়ে ধরে নিমাইয়ের বাবা হুঁহুঁ করে কানছিল। সেদিনই দেখেছিলাম মালতি-দি প্রকাশ্যে সবাইর সামনে ইউসুফ ভাইয়ের বুকে মুখ রেখে ফুপিয়ে ফুপিয়ে কেঁদেছিল।
এ গ্রামে একজন ছেলেই স্কুলে পেরিয়ে কলেজে পড়তে যেতো। তিনি ছিলেন ইউসুফ ভাই। সেই ইউসুফ ভাইও অসহায় হয়ে দাঁড়িয়েছিল। কারণ ডাকাতদের কাছে আগ্নেয় অস্ত্র রয়েছে,তাদের সাথে প্রভাবশালীদের মদদও ছিল। একই ভাবে পালপাড়ার মানুষের জমি ও বাগানগুলো দখল করে নিতে থাকে তারা।
একদিন সকালে উঠে শুনলাম পালপাড়ার নিমাই ও সরজিতরা স্বপরিবারে শহরে চলে যাচ্ছে। আমি দৌড়াতে দৌড়াতে গিয়ে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখতে থাকি। যাওয়ার সময় আমার খেলার সাথী চন্দ্রিমা বার বার ছলছল চোখে আমার দিকে তাকাচ্ছিল। সেই কিশোরী চোখ আজো বুকের মধ্যে আকাশের চাঁদের মত গেথে রয়েছে। কাকীমা আমার কাছে এসে তার স্নেহভরা দুটো হাত দিয়ে আমার দুগাল ধরে কপালে চুমু দিয়ে চোখ মুছতে মুছতে ঘোড়ার গাড়িতে উঠেছিল। সে কথা মনে হতেই আমার চোখ ভিজে যায়।
হঠাৎ আমার চিন্তার জগত থেকে দিদি আমাকে বের করে আনে। আমার ঘাড়ে আলতো করে হাত দিয়ে বলে,কী ভাবছিস, নিয়ে যাবি তো?-আমি গ্রাম দেখতে যাবো। একবার আমাদের বাড়িটা দেখবো।
আমি বলি অবশ্যই নিয়ে যাবো।
তারপর দুপুর গড়িয়ে যায় যায় অবস্থা হয়।
দিদি ওই বয়সে বেশ সেজেগুজে বের হলেন। সাথে চন্দ্রিমাও। এতক্ষণ পর চন্দ্রিমার চোখে চোখ পড়ে আমার। চন্দ্রিমা ঠোঁট আগলিয়ে মিষ্টি করে হাসতে থাকে। কত বড় হয়েছে চন্দ্রিমা!- হয়তো মা-ও হয়েছে।তারপরও অনেক অনেক সুন্দরী সে। পূর্ণাঙ্গ যৌবনবতী,হালকা-পাতলা মনে হচ্ছে।
দেখে একটুও মনে হচ্ছে না,ওর বিয়ে হয়েছে বা ছেলেমেয়ে রয়েছে। চোখ বাঁকিয়ে চুরি করে দেখতে থাকি।
নিমাই পিছন থেকে বেশ আতঙ্কিত দৃষ্টিতে তাকিয়ে দিদির উদ্দেশ্য বলে, দেখেশুনে যাবা দিদি।
আমিই উত্তর দিই,আ-রে না না,কোনো সমস্যা হবে না।আমি আছি না?
নিমাই কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে বলে, হয় সে জন্যই তো ভরসা পাচ্ছি।
চন্দ্রিমা নীরবে তার লাল শাড়ির আঁচল গুছিয়ে অটোতে ওঠে একদিকে বসে।
আমি আর দিদি এক জায়গায় বসি।