• Uncategorized
  • 0

“পুরুষ” নিয়ে বিশেষ সংখ্যায় চয়ন মুখার্জি

ছোটোবেলায় , স্কুলে পড়ি তখন। আমাদের ক্লাসের তিনটি ছেলে স্কুলে বসে লুকিয়ে সিগারেট খেতে গিয়ে ধরা পড়েছিল। তখনো ছাত্রদের মারধোর করা মধ্যযুগীয় বর্বর প্রথা, এরকম কোড অফ কন্ডাক্ট, স্কুল টিচারদের মাথায় চাপিয়ে দেওয়া হয়নি। অতএব বেদম প্রহার এবং তারপরে সেসব গুণধর ছাত্রদের স্বীকারোক্তি, সিনেমার নায়কদের অনুকরণ করতে গিয়ে সিগারেট খেতে তারা হাত পাকিয়েছিল।
কোনো ছোট বাচ্চার জীবনে প্রথম পুরুষ বা হিরো, তার বাবা। তারপরেই আসে শিক্ষক। আর তারপরে..? রুপালি পর্দার নায়করা। যাকে দেখে কমবয়সী ছেলেরা তার স্টাইল আয়ত্ত করতে চায়। একসময় উত্তমকুমারের স্টাইলে চুল কাটার জন্য পাড়ায় পাড়ায় সেলুনে মিলতো, স্পেশ্যাল উত্তম ছাঁট। উত্তমকুমার মারা যাওয়ার পরের দিন কলকাতার বাজারে ফুলের দাম আকাশ ছুঁয়েছিল। একইভাবে মিলতো অমিতাভ কাট, তারপরে মিঠুন, শাহরুখ …! আমরা যারা নব্বইয়ের দশকে জন্মেছি,তাদের অবচেতনে ঘোরে ধূম এর জন আব্রাহাম বা ধূম ট্যু এর হৃত্বিক!
পুরুষ দিবসে , আমার ছোটবেলায় এরকমই এক নায়ক বা পুরুষের কথা লিখতে বসেছি। সুশান্ত সিং রাজপুতের অনেক অনেক আগে, নেপোটিজম যার প্রাণ কেড়ে নিয়েছিল।
সহস্রাব্দের শুরুর দিক। তেলেগু ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রিতে তখন পঞ্চাশোর্ধ্ব নায়করা কুড়ি বছরের কলেজ পড়ুয়ার রোল করতে পর্দায় আসতেন, প্রাণপণে ভুঁড়ি লুকিয়ে রোমান্স করতেন আর নাচের দৃশ্যে সামান্য হাত পা নাড়িয়ে আর বডি ডাবল এর সাহায্য অদ্ভুত অদ্ভুত একশন সিন, যার কাছে নিউটনের গতিসূত্র হার মেনে যায়, তাতে অভিনয় করে পর্দা মাতাতেন আর ভক্তরা সিটি মেরে উল্লাস করতো। “দ্য ডার্টি পিকচার” সিনেমায় নাসিরুদ্দিন শাহের শ্যুটিং – এর দৃশ্যটা মনে আছে? একদম সেম ট্যু সেম।
বেশ চলছিল। এমন সময় সব গোলমাল করে দিল একটি কমবয়সী, কুড়ির কোঠা পার না হওয়া ছেলে। নাম উদয় কিরণ।

 

জন্ম ১৯৮০ সালে, তেলেগুভাষী ব্রাহ্মণ পরিবারে। তিন কূলে কেউ কোনোদিন ফিল্ম লাইনে পা রাখে নি। কিন্তু সেকেন্দ্রাবাদ ওয়েসলি ডিগ্রি কলেজে কমার্স পড়ার সময় সেই যে একবার মাথায় ফিল্মের ভূত চাপলো, আর নামলো না। ৬ ফিটের কাছাকাছি উচ্চতা, গ্রহনযোগ্য মুখ, এককথায় ঈশ্বরপ্রদত্ত টল, ডার্ক , হ্যান্ডসাম চেহারা। সেই সঙ্গে নাচে তুমুল পারদর্শী। আর কী চাই?
স্টুডিওর দরজায় দরজায় কড়া নেড়ে অবশেষে একদিন ভাগ্যে শিকে ছিঁড়লো। কম বাজেটের ফিল্ম, নাম “চিত্রম”। তাতেই হিরোর রোল। বিষয়, টিন এজ প্রেম কাহিনী। ২০০০ সালে মুক্তি পেলো। কেউ আশা করেনি এ ফিল্ম দর্শকের মনে দাগ কাটবে।
কিন্তু ফলাফল দেখে সবার চক্ষু চড়কগাছ। ফিল্ম সুপারহিট। ৪৪ লাখ টাকা বাজেটের ছবি বক্স অফিস কাঁপিয়ে দিনের পর দিন চলতে লাগলো। এতটাই জনপ্রিয়তা যে তামিলে ডাব করে মুক্তি পেলো, কানাড়া ভাষায় রিমেকও হলো।
প্রোডিউসারের দল ঝাঁপিয়ে পড়লো। একের পর এক ফ্যান ক্লাব গজিয়ে উঠলো। কলেজ পড়ুয়া মেয়েদের বুকে ঝড় তুলতে লাগলো “উদয় কিরণ” নামটা! ডায়লগ আর গান লোকের মুখে মুখে ঘুরতে লাগলো।
পরের ছবি “ন্যূভু নেনু”! ব্লকব্লাস্টার। তার পরের ছবি “মানাসান্থা ন্যুভ্যূ”। সুপারহিট। গরিব তেলেগু ব্রাহ্মণ পরিবারের ছেলেটির জীবন বদলে গেলো। দ্বিতীয় ছবির জন্য ২০০১ সালে তেলেগু ফিল্ম ফেয়ার বেস্ট এক্টরের পুরস্কারও মিলে গেলো। প্রথম তিনটি ছবি, পরপর সুপারহিট, কজনের ভাগ্যে জোটে? লোকের মুখে মুখে উদয় কিরণের নাম হয়ে গেলো, হ্যাটট্রিক হিরো।
চতুর্থ ফিল্ম একটু জম চললেও সেই ঘাটতি পুষিয়ে গেলো পঞ্চম ফিল্মে। অল টাইম ব্লকবাস্টারের মধ্যে একটি।
আর পিছনে ফিরে তাকানো নয়, জীবন রোলস রয়েসের মতো মসৃণ গতিতে এগিয়ে চলবে। এমনটাই ভাবছিলেন হয়তো উদয় কিরণ। কিন্তু ভাগ্য দেবতা আড়ালে মুচকি মুচকি হাসছিলেন।
ফিল্ম জগতের সূত্রেই পরিচয় হয়েছিল দক্ষিণী ছবিটি মহানায়ক কাম রাজনৈতিক নেতা , চিরঞ্জীবীর সঙ্গে।ইতিউতি চিরঞ্জিবীর সভায় দেখা যাচ্ছিল উদয় কিরণকে। তারপরেই ব্রেকিং নিউজ। চিরঞ্জীবীর মেয়ে সুস্মিতার সঙ্গে উদয় কিরণের বাকদানের খবর চ্যানেলে চ্যানেলে প্রচারিত হলো।
আর তারপরে আবার চমক। বাকদান ভেঙে গেলো। কারণ নিয়ে দুই পক্ষই মুখে কুলুপ এঁটে বসলো।
আর উদয়কিরণের ভাগ্যের চাকা পিছনের দিকে গড়াতে শুরু করলো।
কোনো এক অদৃশ্য শক্তির অঙ্গুলিহেলনে একদা হ্যাটট্রিক হিরোর ছবিগুলি সিনেমা হলে আর জায়গা পেলো না। প্রোডিউসার কোম্পানিগুলি চুক্তি সই করিয়েও বছরের পর বছর বসিয়ে রাখতে শুরু করলো। ২০০২ এর মধ্যে পাঁচটি ছবি মুক্তি পাওয়া হ্যাটট্রিক হিরোর হাতে পরের তিন বছরে মাত্র তিনটি ছবি , ভাবা যায়?
তথাকথিত উচ্চবর্ণের পরিবার থেকে উঠে আসায়র কারণে পেরিয়ারবাদীদের চক্ষুশূল ছিলেন তিনি। সেই সঙ্গে প্রবল প্রতাপশালী চিরঞ্জীবীকে চটিয়েছেন।
ফল তো ভুগতেই হবে।
আরো একটি কারণ ছিল।
তেলেগু ইন্ডাস্ট্রিতে তখন তিন বিখ্যাত পরিবারের পরবর্তী প্রজন্মের ফিল্ম লাইনে অভিষেক হওয়ার প্রস্তুতি পর্ব চূড়ান্ত। চিরঞ্জীবীর ছেলে রামচরণ তেজা, অভিনেতা কৃষ্ণর ছেলে মহেশ বাবু, এবং প্রবাদপ্রতিম অভিনেতা তথা অন্ধ্রপ্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী এন টি আরের নাতি এন টি আর জুনিয়র। এদের মধ্যে মহেশ বাবুর যোগ্যতা সন্দেহাতীত হলেও বাকি দুজনের সম্পর্কে সেকথা বলা যায় কি? শেষ জনের জন্য এটুকু বললেই যথেষ্ট যে অভিনয় জীবনের শুরুতে দশটা ছবি ফ্লপ করেছিল।
তবু এরা থেকে গেলেন। আর পরপর হিট ছবি উপহার দেওয়া উদয় কিরণের হাত শূণ্য।
চেষ্টা চালালেন তামিল ইন্ডাস্ট্রিতে নিজের ভাগ্য পরীক্ষা করার। সেখানেও ব্যর্থ।
সমস্ত বড় বড় প্রযোজক কোম্পানি বয়কট করেছে উদয় কিরণকে। মরিয়া হয়ে নিজের প্রোডাকশন হাউস খুললেন। তাতেও লাভ হলো না।উপর থেকে কলকাঠি নাড়ানোর ফলে সিনেমা হলগুলির বয়কট চলতেই লাগলো। একের পর এক ফ্লপ ফিল্ম করেও এন টি আর জুনিয়রের হাতে ফিল্মের অভাব নেই, অথচ একদা হ্যাটট্রিক হিরোর ঝুলি শূন্য।
অর্থকষ্টে ভুগতে লাগলেন হ্যাটট্রিক হিরো। ইন্ডাস্ট্রির সাথে যোগাযোগ ক্রমেই বিচ্ছিন্ন হতে লাগলো। ২০১২ সালে বিয়ে করেছিলেন। অবস্থা এমনই দাঁড়ালো যে সংসার চালানোর জন্য স্ত্রীর উপার্জনের ওপর নির্ভর করতে হচ্ছিল। দিনে দিনে মানসিকভাবে ভেঙে পড়ছিলেন। অন্তিম পরিণতি খুব দ্রুত এগিয়ে আসছিল।
অবশেষে ২০১৪ র ৫ ই জানুয়ারি। সকালবেলা ঘুম ভেঙে তেলেগু সিনেমা ইন্ডাস্ট্রি শুনলো , একদা হ্যাটট্রিক হিরো যে জিমে যাতায়াত করতেন, সেখানেই সুইসাইড করেছেন।
টলিউডে ফিটনেস ফ্রিক হিসেবে পরিচিত ছিলেন তিনি। তাই হয়তো মরার জন্যও জায়গা হিসেবে বেছে নিলেন জিম।
একটু চিৎকার চেঁচামেচি হলো। কয়েকজন শ্রদ্ধা জানাতেও এলেন। তারপরে সব ধামাচাপা পড়ে গেলো।
মৃত্যুর পর কোথায় যেতে হয় জানি না! যদি কোনো নির্দিষ্ট জায়গা থাকে, সেখানে নিশ্চয়ই আজ উদয় কিরণ সুশান্ত সিং রাজপুতকে অভ্যর্থনা জানিয়ে বলছেন, “ওয়েলকাম! ইউ আর নট অ্যালান, বাডি!”
নেপোটিজম চলতে থাকে। তার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করা একলা পুরুষ হেরে যায়, উদয় কিরণ, সুশান্ত সিং রাজপুতরা পর্দার আড়ালে চলে যান। আর বিইং হিউম্যানের গল্প শুনে, অভিনেতার মানবিক সত্বায় আপ্লুত হয়ে ভক্তরা হাততালি দিতে থাকে।
শেষ কোথায়?
ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *