• Uncategorized
  • 0

দৈনিক ধারাবাহিক উপন্যাসে মৃদুল শ্রীমানী (পর্ব – ১২৮)

পর্ব – ১২৮

খুব সকালে উঠে চুল না ভিজিয়ে স্নান সেরে একটা শাদা শাড়ি পরল শ‍্যামলী। আঁচলটা আটকে নিল একটা ব্রোচ দিয়ে। চুলে টপনট বাঁধল সে। পরল শাদা ব‍্যাণ্ডের একটা ঘড়ি। কপালে শাদা চন্দনের টিপ। ঠোঁটে লিপস্টিক লাগালো না। চোখে
কাজল পরল পেনসিল দিয়ে।  নখে দিল রঙহীন ন‍্যাচারাল পলিশ । একটা শাদা ছোট হাতব‍্যাগে একটু পয়সাকড়ি।
তারপর বাবার কাছে গিয়ে দাঁড়াল। বলল, বাবা, ওঁদের বাড়ি যাচ্ছি। শশাঙ্ক পাল তাকে দেখে বললেন, দারুণ সেজেছিস তো! খুব ভাল লাগছে।
মা এসে তাকে খুঁটিয়ে দেখে বললেন, এতবড় হলি, একটুও সাজতে শিখলি না। মেয়ে বলল, বাবা কিন্তু বলেছে সাজ ভাল হয়েছে। বাসন্তীবালা বললেন, তোর বাবার কথা বাদ দে। কিন্তু তোরও কি কোথায় কোন্ অনুষ্ঠানে কী পরতে হয়, সেই বোধ হয় নি?
সে কি মা? এই যে শাদা শাড়ি পরেছি!
মা রেগে গিয়ে বললেন, উদ্ধার করেছ। অল্পবয়সী মেয়ে শাদা শাড়ি পরলে কি ভাল লাগে।
মেয়ে জোরের সঙ্গে বলল, মা অসম্ভব। শ্রাদ্ধের অনুষ্ঠানে আমি বেশি সাজগোজ কিছুতেই করব না।
শশাঙ্ক পাল বললেন, শাদা শাড়ি খারাপ কিসে? শুনেছি, শাদার মধ্যে না কি সব রঙ রয়েছে!
বাসন্তীবালা বললেন, তুমি চুপ করবে? তুমি যদি সব বুঝতে তো হয়েই যেত! পরক্ষণেই গলা নামিয়ে তিনি মেয়ের উদ্দেশে বললেন, ও রে মা, গলায় একটা হার না পরলে হয় রে! লোকে কি বলবে?
মেয়ে বলল, লোকের কথায় কি আসে যায় মা? মেয়েদের শরীরটা কি একটা শো কেস যে দামি জিনিস দিয়ে সাজিয়ে গুছিয়ে রাখতে হবে?
বাসন্তীবালা মেয়ের গায়ে হাত বুলিয়ে আদর করে বললেন, না রে মা, বড়ো হয়েছিস, এখন কানে আর গলায় কিছু পরতে হয়। নইলে নিন্দে হয়।
শ‍্যামলী রাগ করে বলল, ওইজন‍্য আমি যেতে চাই নি। নিজের খুশিমতো তুমি কিছুতেই চলতে পাবে না। সর্বক্ষণ শুধু নিন্দে হয়, আর মন্দ হয়।
বাসন্তীবালা বোঝানোর সুরে বললেন, তোর সেই যে একটা মুক্তোর সেট আছে, সেটা বের কর্ না! শাদা শাড়িতে শাদা মুক্তো হার মানাবে খুব।
শ‍্যামলী বলল, মা, একটা লোক মারা গিয়েছেন। আমি একটা দুঃখের অনুষ্ঠানে যাচ্ছি মা!
 বাসন্তীবালা বললেন, তা হোক্। ওটুকু পরতে হয়।
শ‍্যামলী গলায় নিল মুক্তোর মালা, কানে মুক্তোর দুল। হাতে মুক্তো বসানো চুড়ি কিছুতেই পরতে রাজি হল না। আংটিও পরল না।
আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজেকে নিজে জিজ্ঞাসা করল, ও মেয়ে, অ্যাডজাস্ট করছো, না কম্প্রোমাইজ?
গাড়ি গেটের সামনে দাঁড়াতে গেট খুলে দিল। ড্রাইভার গাড়ি বারান্দার নিচে রাখল গাড়ি। গাড়ি থেকে তাকে নামতে দেখে কজন প্রবীণা এগিয়ে এলেন। এসো এসো, তুমিই বুঝি শ‍্যামলী? তোমার কথাই হচ্ছিল। হাসিমুখে এগিয়ে এলেন রমানাথ। উফ্, তুমি এসে গেছ, আমি নিশ্চিন্ত। তারপর রমানাথ তাকে নিয়ে গেলেন মায়ের ঘরে। পালঙ্কে ধবধবে শাদা চাদর পেতে তার উপরে নকুড়বাবুর ছবিটি মালা দিয়ে সাজানো। নিচে গালিচা পাতা। একটা সোফায় বসে আছেন ওঁর স্ত্রী। শাদা শাড়ি পরেছেন বটে, তবে সেটা যে যথেষ্ট দামি তা বেশ বোঝা যাচ্ছে। গহনাও পরেছেন যথেষ্ট পরিমাণে। এমনকি কোমরে পরেছেন সোনার কোমর বন্ধনী।।
নাকের উপর হিরের নাকছাবি। তাঁকে ঘিরে বসে আছেন বেশ কয়েকজন বৃদ্ধা। প্রায় সকলেই কৃশকায়া, কপালে অনেকেই রসকলি করেছেন। কারো কারো মস্তক মুণ্ডন করা। রমানাথের মা বললেন, বাবা মাকে আনো নি?
শ‍্যামলী বলল, আমাকে উনি অনেকবার করে আসতে বলছিলেন, তাই আমি আগে চলে এসেছি। বাবা মা পরে আসছেন।
তিনি বললেন, ওরে খোকন, ওঁদের জন‍্য গাড়ি পাঠাতে ভুলে যাস্ না। তোর বাবা উঠতে বসতে সর্বদা পালবাবুর নাম নিতেন। তারপর শ‍্যামলীর দিকে তাকিয়ে বললেন, শ‍্যামলী, তোমার জামাকাপড়ের ব‍্যাগ কই? খোকা বলে নি, আজ শ্রাদ্ধ, কাল ব্রাহ্মণ ভোজন, তার পরদিন আত্মীয়স্বজন আপ‍্যায়নের ব‍্যবস্থা। খোকা বলে নি গুছিয়ে?
শ‍্যামলী অবাক হয়ে তাকালো রমানাথের দিকে।
তার মা বললেন, ঠিক আছে, ঠিক আছে, এসে পড়েছ যখন আর কোনো চিন্তা নেই। তোমার জন‍্য একটা ঘর গুছিয়ে রাখা আছে। আর কাজের মেয়েরা কোথায় কে আছে দেখে নাও। ওদের পরিচালনা করতে হবে। কেউ যেন জলখাবার আর মিষ্টি না পেয়ে বাড়ি না চলে যায়।
সবচেয়ে প্রবীণা মহিলাটি বললেন তুমি পালবাবুর কোন্ মেয়ে? বড় না ছোটো?
শ‍্যামলী বলল, দিদির বিয়ে হয়ে গেছে।
বৃদ্ধা বললেন, অ, তা এখনো তো পড়াশোনা করছ?
শ‍্যামলী বলল, হ‍্যাঁ। পড়ছি।
রমানাথ বললেন, মা এবার ওকে নিয়ে যাই?
শ‍্যামলী তখন সেই ঘর থেকে বেরোতে পারলে বাঁচে।
রমানাথের মা বললেন, হ‍্যাঁ বাবা, ওকে ওর ঘরটা দেখিয়ে দে।
শ‍্যামলীকে রমানাথ নিজের ঘরে নিয়ে গেলেন। তার ঘরেও একটি সেকেলে ভারি মেহগনি কাঠের পালঙ্ক। মানানসই বড়ো টেবিলে নকুড়বাবুর ছবি সাজানো। দুই পাশে পিতলের ফূলদানিতে রজনীগন্ধার স্টিক। শ‍্যামলীর হাতটা নিজের করতলে নিয়ে রমানাথ বললেন, শ‍্যামলী, তুমি এসেছ, আমার বড্ড ভাল লাগছে।
ঠিক সেই মুহূর্তে ঘরে একটি বৌ ঢুকে পড়ে বলল, ইশশ, বিরক্ত করলাম না কি?
রমানাথ বলল, না না, বৌদি, কি বলবে বলো না?
শ‍্যামলী বেশ টের পাচ্ছিল লজ্জায় তার কান লাল হয়ে যাচ্ছে।
বৌটি বলল, ওকে জলখাবার দিতে হবে। ও নিশ্চয়ই সকালে কিছু খায় নি। শ‍্যামলী মুখ তুলে বলল, বৌদি আপনি ব‍্যস্ত হবেন না। আমাদের নিজেদের একটু কথা আছে। কয়ে নিয়েই আমি যাচ্ছি। সব পরিচালনা আমিই করব।
বৌটির মুখের দুষ্টুমি মাখা আলো সহসা ম্লান হয়ে গেল। নতমুখে চলে গেল সে।
রমানাথের দিকে তাকিয়ে একটু কড়া ভাবে মেয়ে বলল, আজ আপনার বাবার স্মরণানুষ্ঠান। আজ নিজেকে বিশেষ ভাবে সংযত রাখবেন। সমস্ত মনোযোগ রাখবেন ওই শ্রদ্ধা নিবেদন করার বিষয়ে। কাউকে ভুল বোঝার কোনো অবকাশ দেবেন না।
রমানাথ নিজের আলমারির চাবি শ‍্যামলীর হাতে দিয়ে বললেন, চাবিকাঠি তুমি রাখো। সবাইকে সব বলা আছে। মায়ের ঘরে তাঁর কাছে টাকা রাখা আছে। তবু যদি কেউ হঠাৎ করে কিছু চায়, তুমি এখান থেকে দিয়ে দিও।
শ‍্যামলী বলল, কতটাকা রাখা আছে?
রমানাথ বলল, পাঁচ হাজার।
শ‍্যামলী বলল, এতটা টাকা সামনে রাখতে হবে না। পাঁচশো টাকা রেখে বাকিটা লকারে রাখুন।
এমন সময় ঘরের বাইরে দাঁড়িয়ে কে বলল, পুরুতঠাকুর খোকনকে ডাকছে।
 রমানাথ শ‍্যামলীকে বললেন, তুমি সব যা করার গুছিয়ে কোরো।
শ‍্যামলী বলল, আজকের দিনের জন‍্য ভুলে যান আমি এখানে আছি। নিজের কাজটা অখণ্ড মনোযোগ দিয়ে করবেন।
রমানাথ হাসল। শ‍্যামলী হাসল না । গম্ভীর হয়ে থাকল।
শ‍্যামলী নিজে নিজেই বাড়ির ঘরগুলি দেখে নিল। ভাঁড়ার ঘরে সে ঢুকতে দুটি কাজের মেয়ে তার দিকে চেয়ে হেসে বলল, তোমাকে আজ আমরা প্রথম দেখছি। কিন্তু আমরা সব জানি।
শ‍্যামলী গম্ভীর হয়ে বলল, প্রত‍্যেককে যত্ন করে খাবার দেবে। কেউ যেন না খেয়ে চলে না যায়। আর বাইরের লোক ভাঁড়ার ঘরে ঢুকতে দেবে না। কোনো কিছু মনে হলে আমায় জিজ্ঞাসা করে নেবে।
তুমি এসে গেছো, দেখো, আমরা সব ঠিক ঠিক করব। এবাড়িতে তো আজ কমদিন হল না।
নিচে একটা বড়ো ঘরে শ্রাদ্ধের আয়োজন। প্রয়াত ব‍্যক্তিকে উপহার দেওয়া হবে বলে নূতন খাটবিছানা, ছাতা, জুতা, আহারের জন্য বাসনকোসন, জামাকাপড়ের আয়োজন দেখে মিশরের পিরামিড আর মমির কথা মনে পড়ল শ‍্যামলীর।
ঘরের এক কোণে বসে গীতাপাঠ করে যাবেন একজন। সেই পুরোহিত এসে পড়লেন। একটি বধূ তাঁর পা ধুইয়ে দিতে যেতে তিনি আপত্তি করলেন। বললেন, কলঘরটা দেখিয়ে দাও, আমি নিজেই পা ধোবো। বধূটি নিজেকে অপরাধী ভেবে শ‍্যামলীর দিকে তাকালো। শ‍্যামলী তাকে বলল, দুশ্চিন্তা করবেন না। আমি তো আছি। শ্রাদ্ধের মূল পুরোহিত সমস্ত আয়োজন আগের দিন দেখে গিয়েছিলেন। তবুও শ‍্যামলী রমানাথকে গিয়ে বললেন, আপনি একবার খুব ভাল করে দেখে নিতে বলুন, কোথাও কোনো রকম ঘাটতি রয়েছে কি না। পুরোহিত বললেন, মা, শ্রাদ্ধের আসল জিনিস হল শ্রদ্ধা। সেটুকু থাকলে বাকি সব বাড়তি জিনিস। তবে আমি নিজেই সব গুছিয়ে রেখেছি। কোনো কাজ আটকাবে না। শ‍্যামলী বাড়িতে কাজ করতে থাকা বধূ ও কাজের মেয়েদের ডেকে বলে দিল এটা দুঃখের অনুষ্ঠান। খাওয়া দাওয়া হৈচৈ এর অনুষ্ঠান নয়। তাই খুব চুপচাপ খাবার দেবার ব‍্যাপারটা সেরে নেবে। আরো দিই, আরো নাও, এসব করবে না। শ্রাদ্ধের শুরু হলে সবাই চুপচাপ থাকবে।
ঠিক দশটার সময়  শ্রাদ্ধ শুরু হল।  সেই সময় রমানাথের মায়ের ঘর থেকে একটা কান্নার রোল উঠল।

ক্রমশ…

ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।