• Uncategorized
  • 0

দৈনিক ধারাবাহিক উপন্যাসে মৃদুল শ্রীমানী (পর্ব – ১২৩)

পর্ব – ১২৩

শেষ দুপুরে সবিতাপিসিকে বলে বাড়ি থেকে বেরিয়ে পড়ল শ‍্যামলী। সবিতা বললেন, নিশ্চয়ই  কোনো ফেরেণ্ডোর সাথে সিনেমায় যাবি! তুই পারিস‌ও বটে। আমার তো ভাবলেই বুক কাঁপে।
শ‍্যামলী চোখ পাকিয়ে বলল, সিনেমা দেখতে যাওয়া খারাপ?
পিসি বলল, তা কেন, এই বয়সে একটু সাজবি গুজবি, স্নো পাউডার লিপস্টিক, কিন্তু তুই যেভাবে ছেলেদের সাথে কথা বলিস্, আমার তো ভয় করে। হ‍্যাঁ রে, তোর সেই যে বন্ধুটা খামে করে চিঠি পাঠাল, ও কোথায় থাকে রে? বিলেতে?
শ‍্যামলী বলল, বিলেতে বললে উত্তরটা সহজ হয়ে যায়। তা ধরে নাও বিলেত‌ই এক রকম।
সবিতা বললেন, একজনদের বাড়ির একটা লোক বিলেতে গিয়েছিল। তারপর শোনা গেল সে মেম বিয়ে করেছে। আর মেমটাকে গ্রামের বাড়িতে আনছে। সবাই তো তটস্থ। যারা যারা একটু লেখাপড়া জানে, তারা ক‍্যাট ম‍্যাট গ‍্যাট ইয়েস নো ভেরি গুড বলা অভ‍্যেস করছে। ওমা, মেম এল শাড়ি পরে, এসে বাংলায় বলল নমস্কার। এমনকি হেঁট হয়ে শাশুড়িকে পেন্নাম অবধি করল। সবাই নাক সিঁটকে বলল, এ আবার কেমন মেম!
শ‍্যামলী বলল, পিসি, এখন তোমার গল্প শুনতে গেলে আমার আর সিনেমা দেখা হবে না।
পিসি বলল, যাচ্ছ যাও, সিনেমার গল্পটা আমায় না বললে সব তোর মা বাবাকে বলে দেব। কি রে, বলবি তো গল্পটা।
শ‍্যামলী বলল, আচ্ছা আচ্ছা, আর চিনে বাদাম কিনে দিলে, তার‌ও ভাগ তোমায় দেব।
পিসি শ‍্যামলীর হাতটা টেনে নিয়ে কড়ে আঙুলটা আলতো করে কামড়ে দিল। বড্ড সুন্দর লাগছে রে তোকে। ঠাকুর বাছাকে আমার রক্ষে করো।
শ‍্যামলী শাড়ির আঁচলটা মাথার উপর দিয়ে ঘুরিয়ে নিল। এ পাড়ায় একটা বুড়ো আছে। সে যদি একবার দেখতে পায়, একঝুড়ি কথা পাড়বে। এড়ানো দায় হয়ে যায়।
থানায় গিয়ে সোজা ওসির চেম্বারের সামনে দাঁড়াল। আর্দালিটা এর আগের দিন দেখেছিল, সাহেব তাকে বসিয়ে হেসে হেসে কথা বলেছিলেন। তাই আজ সে শ‍্যামলীকে বলল, নমস্কার দিদিমণি, আপনি ভিতরে চলুন। একটু পরেই সাহেব এসে যাবেন।
শ‍্যামলী ওসির চেম্বারে না বসে, দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কাচের আলমারিতে রাখা ব‌ইগুলি দেখতে লাগল।
পুলিশের আলমারিতে কত ব‌ই! কোড অফ ক্রিমিনাল প্রসিডিওর,  ইণ্ডিয়ান পেনাল কোড, ইণ্ডিয়ান এভিডেন্স অ্যাক্ট, লিগ্যাল ডিকশনারি, ল লেকসিকন, কমেনটারিজ অন হিউম্যান রাইটস, নারকোটিকস অ্যাক্ট।
এমন সময় ওসি চেম্বারে ঢুকে বললেন, ব‌ই শুধু দেখা নয়, একটু বসে পড়াও যেতে পারে, তবে বাড়িতে নিয়ে যেতে চাইলে দিতে পারব না। এসব ব‌ই পুলিশের নিত‍্যসঙ্গী।
শ‍্যামলী বলল, না, ব‌ই দেখতে আমার খুব ভাল লাগে। একজনদের বাড়িতে গিয়ে তাদের পারিবারিক লাইব্রেরিতে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ব‌ই দেখতে দেখতে আমি সাড়ে তিন ঘণ্টা পার করে দিয়েছিলাম।
ওসি বললেন, বাঃ, দাঁড়িয়ে থাকা খুব ভাল অভ‍্যাস। সত্যি বলতে কি, নিজের পায়ে দাঁড়াব, এই চিন্তা সর্বদা আমাকে কুরে কুরে খেত।
শ‍্যামলী বলল, আপনার কাছে খুব দরকারে পড়ে এসেছি।
ওসি বললেন, বলুন, কি রকম দরকার।
শ‍্যামলী বলল, আমার দাদা আর ভাইয়ের বেল করিয়ে দিয়েছেন আপনি। কিন্তু কোনো টাকা পয়সা দেওয়া হয়নি। আমরা ওটা মিটিয়ে দিতে চাই।
ওসি বললেন, বেল করিয়ে দেওয়া বাবদে আমি কি কোনো টাকা চেয়েছি?
শ‍্যামলী লজ্জা পেয়ে বলল, না তা আপনি চান নি। কিন্তু আমাদের তো টাকা দেওয়া উচিত!
ওসি বললেন, না টাকা দিতে হবে না। ও আমি সামলে দিয়েছি।
শ‍্যামলী বলল, না না, সে কি কথা? আপনি নিজের গাঁট থেকে দেবেন কেন?
ওসি বললেন, শুনুন, আপনার ভায়েদের বেইলেবল সেকশন দিয়েছিলাম, মনে আছে আপনার?
শ‍্যামলী বলল, হ‍্যাঁ। মনে আছে।
ওসি বললেন, বেইলেবল মানে হল পুলিশ অভিযুক্ত ব্যক্তিদের জামিন দেবে। এই জামিন দেওয়াটাই পুলিশের দায়িত্ব। আটকে রাখাটা নয়।
শ‍্যামলী বলল, অসভ্যতা করে ধরা পড়লে আটকে রাখাটা পুলিশের দায়িত্ব নয়?
ওসি বললেন, বেইল দেওয়া মানে কিন্তু ছেড়ে দেওয়া নয়। জিওল মাছ দেখেছেন?
শ‍্যামলী বলল, হ‍্যাঁ দেখব না কেন? ক‌ই মাগুর শিঙি, এগুলো জিওল মাছ।
ওসি বললেন, বাবা বাজার থেকে ওই শিঙি মাগুর আনলে মা হাঁড়িতে জল দিয়ে রেখে দিতেন। কিন্তু, হাঁড়িতে জল দিয়ে তাতে জিওল মাছ রাখা মানে কি ছেড়ে দেওয়া?
শ‍্যামলী বলল, ছেড়ে দেওয়া আদৌ নয়। সুবিধা মতো যাতে খাওয়া যায়, তার ব‍্যবস্থা করে রাখা।
ওসি বললেন, বেইল দেওয়া জিনিসটা আসলে অমনি। কোর্ট যেদিন ডেকে পাঠাবেন, সেদিন হাজিরা দিতে বাধ‍্য থাকবেন অভিযুক্ত ব‍্যক্তি।
পুলিশের ওই দায়িত্ব থাকে যে অভিযুক্তকে বলতে হয় তুমি বাপু বেইল নাও। আর ঘরে চলে যাও। কোর্ট যেদিন ডাকবেন, সেদিন ভালমানুষের মতো মানে মানে চলে আসবে।
 শ‍্যামলী বলল, বুঝলাম।
ওসি বললেন, অভিযুক্তদের এটা বুঝিয়ে বলে জামিনের উদ্যোগ নিতে বলাটাই পুলিশের কাজ। তো আমি সেই কাজটাই করেছি। বেইল পাইয়ে দিয়েছি।
শ‍্যামলী বলল, উকিল বাবুর ফিজ় তো দিতে হবে। আর বেইলের জন‍্যেও না কি টাকা নেন ওঁরা?
ওসি বললেন, উকিলকে ওকালতি করে খেতে হয়। তাই কাগজ কালি কলম আর খসখস করে লেখার জন্য তাঁরা যদি মজুরি চান, সেটাকে দূষণীয় বলতে পারব না। ফিজ় নিয়েই উকিলবাবুদের বাড়িতে হাঁড়ি চড়ে।
তবে পুলিশ চাইলে উকিল বাবুর সাহায্য ছাড়াও জামিন দিতে পারে। মানে দেওয়াটাই স্বাভাবিক। আটকে রাখাটা অস্বাভাবিক।
শ‍্যামলী বলল, বাবা টাকাটা মিটিয়ে দেবেন বলেছেন। কত দিতে হবে যদি বলেন।
ওসি বললেন, আপনি কত দিতে পারবেন?
শ‍্যামলী বলল, আচ্ছা মুশকিল তো! বেইল দিলেন আপনি। এখন যা ন‍্যায‍্য খরচ তাই তো দিতে হবে?
ওসি বললেন, সরকারের তহবিলে বেইল বাবদ একটা ফুটো পয়সাও জমা পড়ে না। তাহলে সে নিয়ে চিন্তা নেই। বাকি র‌ইল উকিলবাবুর ফি। ওটা আমি ম‍্যানেজ করেছি।
শ‍্যামলী বলল, না না, সে কি কথা, উকিলবাবুর খরচটা আপনি কেন দেবেন?
ওসি বললেন, আমার এক ছোটবেলার বন্ধু ক্রিমিনাল লইয়ার। পশার ভাল নেই। আমি এই চেয়ারে আসার পর দুটি হাত ধরে বলেছিল দুচারটা কেস ধরিয়ে দিও ভাই, ন‌ইলে, না খেয়েই মরতে হবে।
 আমিও বললাম মাঝে সাঝে একটু আধটু ফ্রি সার্ভিস দেবে তো? আপনার কেসটা সেই ফ্রি সার্ভিসের একটা। কোনো পয়সা লাগে নি।
শ‍্যামলী বলল, বৈষ্ণব পদাবলীতে অহৈতুকী করুণা বলে একটা কথা আছে। এযেন অনেকটা সেই রকম হয়ে গেল।
ওসি বললেন, আপনি সিআরপিসি খুলে দেখুন, সেকশন ফিফটি পড়ে দেখুন। পুলিশের দায়িত্বের মধ‍্যে পড়ে বেইলের ব‍্যবস্থা করে দেওয়া। কি জানেন, পাবলিককে নাকানি চোবানি খাওয়ানো পুলিশের দায়িত্ব নয়, বরং তাকে সহৃদয় মনোভাব দেখাতে পুলিশ দায়বদ্ধ।
শ‍্যামলী সব শুনে অবাক হয়ে গেল।

ক্রমশ…

ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।