আজ খুব গুরুত্বপূর্ণ বৈঠক সি এইচ -এর কোর কমিটির। এমন বৈঠক তো কতই হয়, কিন্তু আজ এটা একটু অন্যরকমের বৈঠক। আজ এখানে জাস্টিস সেলে আসা কতিপয় অভিযোগ নিয়ে আলোচনা হবে। তবে মিটিং এ আসা সবাই জানে সেটা আই ওয়াশ ছাড়া কিছু নয়। আসলে তো হবে সাম্প্রতিক হই চই ফেলে দেওয়া মারিওভা কফি জয়েন্টের রেপ অ্যান্ড মার্ডার কেস নিয়ে। এখানে পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছে কে অপরাধী। তার অপরাধ আরও মারাত্মক কারণ সে বাইরের লোক। পৃথিবী থেকে এখানে ফুল বেচতে এসে যে এরকম একটা ঘৃণ্য কাণ্ড ঘটিয়ে ফেলতে পারে, তার দুঃসাহস সত্যি অবাক করার মতো। তার চেয়েও বিস্ময়কর হল এই আর্থেনিয়ায় এমন ঘৃণ্য কাজেরও সমর্থক রয়েছে। আর, আরও পরিতাপের কথা, সে একজন মেয়ে! একজন মেয়ে হয়ে মেয়ের ওপর নৃশংস অত্যাচারীর প্রতি সমবেদনা! জাস্ট ভাবা যায় না। বৈঠক শুরুর আগেই সেই নিয়ে কফির কাপে তুফান তুলছিলেন কোর কমিটির সদস্যরা।
রিও রাবাইতো কফিতে চুমুক দিতে দিতে বললেন ‘ এ তো রাষ্ট্রদ্রোহিতা! চিফকে বলতে হবে এখুনি রাষ্ট্রদ্রোহিতার অভিযোগে মেয়েটাকে’
কথার খেই হারিয়ে ফেললেন রিও। কোন শাস্তি দিলে যে ঠিক হয়, তিনি ভেবে উঠতে পারলেন না।
মধু বললেন ‘আমি তো ভাবছি জেন্ডার ইস্যুতে ওকে ফাঁসাব’
রিও তালে তাল দিয়ে বললেন ‘প্রতিরক্ষাতেও যদি কিছু করা যায়?’
মধু ওমনি বলেন ‘ দূর! আমাদের আইনে বড়সড় বদল দরকার। আজ এখানে একজন আইনের লোক থাকলে ভালো হত। তাই না পদ্মাসনা?’
পদ্মাসনা এতক্ষণ চুপচাপ সবার কথা শুনছিলেন। এবার তিনি খেপে গিয়ে বললেন ‘ অল বকওয়াশ। যা ইচ্ছে বললেই হল? রাষ্ট্রদ্রোহ, জেন্ডার, প্রতিরক্ষা! আমাদের মনে রাখতে হবে, মেয়েটা আর্থেনিয়ার নাগ রিক। এবং খুবই উজ্জ্বল কেরিয়ার তার। তরুণ মহলে সে খুবই জনপ্রিয়। আসল অপরাধীকে ছেড়ে আপনারা এখন মেয়েটাকে নিয়ে পড়লেন! মাথায় একটা কথা খুব পরিষ্কার ভাবে ঢুকিয়ে নিন। মেয়েটাকে এখনি কিছু করা যাবে না। অন্তত জনসমক্ষে। তাতে পাবলিক আমাদের বিরুদ্ধে চলে যাবে। মেয়েটার ফ্যামিলি ব্যাকগ্রাউন্ড কিন্তু’
এই অব্দি বলে নিজেই খেই হারিয়ে ফেললেন পদ্মাসনা। তাঁর কি যেন একটা মনে পড়ে গেছে। আসলে আজ সকালটা বড় এলোমেলো ভাবে শুরু হয়েছে। সকালে উঠেই কোর কমিটির সবাইকে গুড মরনিং উইশ পাঠান চিফ। ঘুম চোখে সেটা দেখতে গিয়ে চমকে উঠেছেন আজ পদ্মাসনা। সুপ্রভাতের পরে চিফ আলাদা করে লিখেছেন – মারিওভা কেসে সব ফোকাস যেন ফুলওলার ওপর থাকে, তার পাশে কে দাঁড়াল না দাঁড়াল সেই নিয়ে মাথা ঘামানোর কোন দরকার নেই। মেসেজটা পেয়ে অবাকই হয়েছিলেন পদ্মাসনা। যেকোন প্রতিবাদ অংকুরে বিনষ্ট করার মধ্যে দিয়েই আর্থেনিয়া এগিয়ে চলেছে এতদিন ধরে। এক চিফ থেকে আরেক চিফ, মুখ বদলেছে, বদলায়নি অবদমনের ধরন। হঠাৎ কী এমন ঘটল যে রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে এতবড় প্রতিবাদকে দেখেও না দেখার ভান করতে বলছেন চিফ? নাকি এটা তাঁর কোন চাল? মেয়েটির কপালে নাচছে আরও ভয়ংকর কোন শাস্তি?
সক্কাল বেলা এই মেসেজটা পেয়ে ইস্তক মেজাজটা এত খিঁচড়ে আছে যে কফির সঙ্গে রোজ যে কাঁঠালের চিপস না খেলে দিনটা ভালো করে শুরুই হয় না, সেই চিপসও মুখে রোচেনি আজ। কোনরকমে দুটো ইডলি গিলে অফিসে চলে এসেছেন। আগেকার দিনে মিটিং মানে ছিল সঙ্গে ভালো মন্দ খাওয়া , সেন্ট্রাল হাবে সেসব সিন নেই। শুখনো মুখে মিটিং করো। তাও যদি মিটিংটাও ঠিকঠাক হত। নিজের মতপ্রকাশ, যুক্তিতর্ক কিছুর বালাই নেই। শুধু ঘাড় গুঁজে চিফের নির্দেশ মেনে নাও। এমনিতেই পদ্মাসনার মেজাজ খাট্টা, তার ওপর রিও আর মধুর আগডুম বাগডুম বকবকানির চোটে মাথা খারাপ হবার জোগাড়। পদ্মাসনা বিরক্ত গলায় বললেন ‘ যে যার নোডে গিয়ে বসে পড়ুন। এখুনি মিটিং শুরু হবে।’
মিটিং শুরুর আগে আর্থেনিয়ার জাতীয় সঙ্গীত বাজে –
‘ আমার বুকের রক্ত দিয়া,
বাঁচাব এই আর্থেনিয়া
চুলোয় যাক বাকি দুনিয়া।’
আর কোন পদ নেই, এই তিন লাইনই ঘুরিয়ে ফিরিয়ে গাইতে হয়। গান চলা কালীন উঠে দাঁড়াতে হয়, হাতটা বুকের বাঁদিকে রেখে, কলোনিয়াল হ্যাং ওভার এর মতো এ হচ্ছে পৃথিবীর হ্যাং ওভার। দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে বিরক্ত লাগে পদ্মাসনার। প্রতিবার জাতীয় সঙ্গীত বাজলেই বেজায় মাথা গরম হয়ে যায়। কোন হতচ্ছাড়া যে লিখেছিল এর লিরিক। শালা, জনসংখ্যার অর্ধেকের বেশি রোবট, তারা বুকের রক্ত দিয়ে আর্থেনিয়াকে বাঁচাবে? রক্ত আর আই সি (ইন্টিগ্রেটেড চিপস) দিয়ে লেখা যেত না? পদ্মাসনা এর থেকে ভালো লিখতেন নিঃসন্দেহে। হাজার হোক, তাঁর সুদূর পূর্বজরা রীতিমতো গানের চর্চা করতেন। ত্যাগরাজের ভজন ভেসে বেড়াত বাতাসে বাতাসে। তাই সুর ছন্দ তাল জ্ঞান তাঁর খারাপ নয়।
জাতীয় সঙ্গীত শুনতে শুনতে পদ্মাসনা মনে মনে নিজস্ব একটা জাতীয় সঙ্গীত তৈরির মধ্যে এতটাই মগ্ন হয়ে পড়েন যে তিনি খেয়ালই করেন না, জাতীয় সঙ্গীত কখন শেষ হয়ে গেছে আর তাঁর নোডে চিফের আইকনের বদলে ভেসে উঠেছে মিকি টকিহাউসের ছবি। আর তাই দেখে চোখ কপালে উঠেছে মধু ম্যানহাটান আর রিও রাবাইতোর। রিও আর থাকতে না পেরে বলেন ‘ দেখুন দেখুন পদ্মাসনা, মিটিং শুরুর আগে মিকি এসে হাজির। এমন তো কখনো হয়নি’
পদ্মাসনার ঘোর কেটে যায়। তিনি চমকে উঠে দেখেন সত্যি তো, এমন একটা গুরুত্বপূর্ণ মিটিং এর আগে মিকি কেন? এমন তো সত্যি আগে কখন হয়নি। সকাল বেলায় চিফের ওইরকম একটা মেসেজ, তারপর আবার এখন মিকি, কী সব হচ্ছে? দেশটা উচ্ছন্নে গেল দেখছি। মিকির ছবি বড় হতে হতে স্ক্রিন ঢেকে ফেলে। ঠোঁট নড়ে সে ছবির। পদ্মাসনা শোনেন মিকি বলছে ‘ অনিবার্জ কারণে আজকের মতো মিটিং স্থগিত রাখা হল। রাতে টেক্সট করে চিফ পরবর্তী নির্দেশ জানিয়ে দেবেন।’ চুঁ চুঁ চুঁই। লহমায় মিলিয়ে গেল মিকির মুখ। স্ক্রিন একদম ল্যাপা পোঁছা। হতভম্ব মুখে ওঁরা বেরিয়ে আসেন কমিটি রুম থেকে। মধু আর রিও পাবে ছোটেন। ওদের ভয়ানক তেষ্টা পেয়ে গেছে। পদ্মাসনা ভাবেন কী করবেন এখন। বাড়ি যাবেন একবার? নাকি অফিসে গিয়ে জমা কাজ সারবেন? ঠিক সেই মুহুর্তে একটা দৃশ্য দেখে তাঁর পা দুটো মাটিতে গেঁথে যায়। উলটোদিকের কনফিডেনশিয়াল রুম থেকে পার্পল ওভার অল পরা এক দীর্ঘাঙ্গী বেরিয়ে আসছেন শান্ত পায়ে। খুব চেনা চেনা লাগে মহিলাকে। তাঁর সামনে দিয়ে চলে যাবার পর প্রায় চেঁচিয়ে ওঠেন পদ্মাসনা। আরে! জাস্টিস সেলে নালিশ করতে আসা মেয়েটির ভিডিও তাঁর কাছে এসেছে। এই মহিলা ছিলেন মেয়েটির সঙ্গে। ইনি কি তাহলে জারার মা? কিন্তু ইনি এখানে কেন? চিফের সঙ্গে কী কথা তাঁর গোপনে?