• Uncategorized
  • 0

ছোটগল্পে তপশ্রী পাল

ভাইরাল বিয়ে

বিয়েটা ঠিক হয়েছিলো প্রায় বছরখানেক আগে। দুজনেই কম্পিউটার ইঞ্জিনিয়ার। সম্বন্ধ করে ঠিক করা বিয়ে, কিন্তু তারপর অজস্রবার রোমিতের সঙ্গে চ্যাট করেছে মিথিলা, হোয়াটসঅ্যাপে ভূরি ভূরি ছবি দেওয়া নেওয়া হয়েছে! গুগল ডুয়োসে ভিডিও চ্যাটিংও বাদ যায়নি! তারপর মলে দেখা করে একসঙ্গে সিনেমা দেখা আর কফি শপে বসে ঘন্টার পর ঘন্টা আড্ডাও হয়ে গেছে বারকতক। শুধু ফরম্যালিটিটুকু মিটলেই এক হতে পারে ওরা। এসব দেখে শুনে মিথিলার বাবা রমেশবাবু রোমিতের বাবা বিকাশবাবুকে বললেন “যদিও ভেবেছিলুম শীতকালে চারহাত এক করবো, কিন্তু আমে দুধে যখন মিশেই গেছে, এই গ্রীষ্মেই লাগিয়ে দিই, কী বলুন?” বিকাশবাবু বললেন “মিয়াঁ বিবি রাজি তো ক্যা করেগা কাজি? আজকালকার ছেলে মেয়ে! আমাদের কাজ শুধু অনুষ্ঠানটুকু করা, বাকি সব নিজেরাই করে নেয়! তাই দেরী করলে কোনদিন নিজেরাই রেজিস্ট্রি করে আমাদের মিষ্টিমুখ করাবে! বৈশাখেই লাগিয়ে দিন!” অতঃপর বিস্তর কেনাকাটা, বাড়িভাড়া, খাওয়ার মেনু, নেমন্তন্ন কার্ড, ফটোশ্যুট মায় ইতালীতে হনিমুন যাওয়া অবধি সব প্ল্যান জানুয়ারির মধ্যে ফিক্স করে দুই পরিবার রেডি!
ওমা! এরেই কয় ম্যান প্রোপোসেস গড ডিসপোসেস! মার্চ পড়তে না পড়তে কী আপদ এক চীনে ভাইরাস এসে গোটা বিশ্ব ছেয়ে ফেললে! লাখ লাখ লোক আক্রান্ত, হাজারে হাজারে মৃত গোটা পৃথিবী জুড়ে! কারো এ বিষয়ে ঘুণাক্ষরেও জানা ছিলোনা! ফলতঃ গোটা দেশে লকডাউন! কোন অনুষ্ঠান করা, লোক জড়ো করা মানা। অতএব একটাই উপায় থাকে বিয়ে পিছিয়ে দেওয়া। বাংলার পাঁচের মতো মুখ করে বসেছিলো রোমিত! নেমন্তন্ন চিঠি ছেপে চলে এসেছে আর এখন এ সব সহ্য হয়? আর ইতালি! সে তো এখন খালি! মানে হতে বসেছে। এতো লোক মারা গেছে! মনের ওপর একশো মণ বোঝা চাপিয়ে ভুলভাল প্রোগ্রাম লিখছিলো রোমিত ঘরে বসে ওয়ার্ক ফ্রম হোম করতে গিয়ে। এমন সময় টুং করে মিথিলার মেসেজ ঢুকলো। “হেলো! মুখ হাঁড়ি করে বসে আছো তো? আমি মনে মনে দেখতে পাচ্ছি তোমার মুখটা! আচ্ছা, আমরা যদি সোশ্যাল ডিসট্যান্সিং করে রেজিস্ট্রি করি! তারপর ফরম্যাল ম্যারেজটা সব আত্মীয় স্বজনের জন্য ভারচুয়াল দেখানোর ব্যাবস্থা করি জুমে! এমনকি পুরোহিত মশাইও তো অনলাইনে বিয়ে দিতে পারেন! ধরো তুমি সেজে তোমার ঘরে বসলে, আমি আমার ঘরে, আর পুরোহিত মশাই আর বাবারা লগ-ইন করলো মিটিং-এ! অনলাইন বিয়ে হলো! কী এক্সাইটিং হবে ভাবো! নির্ঘাত মিডিয়া দেখাবে আমাদের বিয়ের ভিডিও! আর বিয়ের ভোজটা পরে সেরে নিলেই হবে! বলো বলো! তুমি রাজি? ভাবতেই আমার গুজবাম্প হচ্ছে! কী নতুনরকম বিয়ে হবে ভাবো! সবাই তো আজকাল ডেস্টিনেশন ম্যারেজ করছে! কেউ হেলিকপ্টারে চড়ে, কেউ আন্টার্ক্টিকার বরফে দাঁড়িয়ে! আমরা ডিজিটাল ম্যারেজ করবো!”
মিথিলা প্রায় জোর করে রাজি করিয়ে ফেললো রোমিতকে! পুলিশ পারমিশন নিয়ে, রেজিস্ট্রি অফিসে, একটি ঘরে বারো ফুট দূরে দুটি বেঞ্চে মাস্ক পরে বসে সই করলো দুজনে। অতঃপর ডিজিটাল ম্যারেজ বেশ ভালোভাবেই মিটে গেলো ওদের! টেকনোলজির কল্যাণে সবাই বাড়ি বসেই দেখলো বিয়ের অনুষ্ঠান!
কিন্তু তারপর? এই তারপরটা নিয়েই যতো গোল! বিয়ে যখন হয়েছে, বৌকে তো ঘরে তুলতেই হবে! অবশেষে সেটাও মিটলো সব আচার বিচার মেনে! বরণডালায় ছিলো একটি টেম্পারেচার মাপার যন্ত্র! রোমিতের মা মাস্ক এবং গ্লাভস পরে বরণডালা হাতে প্রথমে মিথিলার টেম্পারেচার মাপলেন! নিশ্চিন্ত হয়ে বললেন “বৌমা, এই নাও স্যানিটাইজার! ভালো করে হাত স্যানিটাইজ করে নাও! রোমিত, তুইও কর! ওগো, ঐ দেখো স্যাভলন জল করা আছে। সব তত্ত্ব আর স্যুটকেস গুলোতে ছিটিয়ে ডিসইনফেক্ট করো দিকিন!” তারপর বরণ করে বৌ ঘরে তুললেন। বললেন “ঢুকেই বাথরুমে গরম জল করা আছে। প্রথমেই বেনারসীটসী সব খুলে ডুবিয়ে দিও! রোমিত তুইও!” অগত্যা অমন সাধের নতুন ডিজাইনার বেনারসী জলে চুবিয়ে দিলো মিথিলা! করোনা ছুঁলে চুয়ান্ন ঘা! তবু রোমিতকে তো পাওয়া যাবে!
পরদিন বৌভাত মিটে গেলো। এলো ফুলশয্যার রাত! এর জন্যেই তো হা পিত্যেস করে অপেক্ষা এতোদিন! ওরা ঠিক করেছিলো দূরে দূরে বসে গল্প করেই কাটিয়ে দেবে রাতটা! দরজা বন্ধ করে রোমিত দরজার কাছ থেকেই মাস্ক পরা মুখে একটা ফ্লাইং কিস ছুঁড়ে দিলো মিথিলার দিকে। মিথিলাও ফিরিয়ে দিলো কিস সহজেই! তারপর রোমিত খাটের এক কোণে এসে বসলো। মিথিলা আর এক কোণে!
কিন্তু যতো রাত বাড়তে লাগলো ততোই সব গোলমাল হয়ে গেলো। দুজনেই খাটের মাঝখানের দিকে এগোতে লাগলো কথা বলতে বলতে! ঘুম পায় না বুঝি? একটা মিষ্টি আড়মোড়া ভাঙলো মিথিলা! ওর দেহের প্রতিটি খাঁজ, প্রতিটি ভাঁজ হিল্লোলিত করে! রোমিত রোমাঞ্চিত হলো! তারপর “চুলোয় যাক!” বলে জড়িয়ে ধরতে গেলো মিথিলাকে। মিথিলা এক লাফে খাটের কোণে গিয়ে ফিসফিস করে বললো “কোভিড!” আরেকজন শুনলো “রোমিত!” “এই তো আমি! পালালে কেন?” বলে আবার জড়িয়ে ধরতে গেলো মিথিলাকে! মিথিলা এবার মাটিতে! রোমিত বললো “কী হলো? আমাকে ভয়!” মিথিলা বললো “উঁহু, কোভিডকে ভয়!” রোমিত তখন মিথিলাকে অধিকার করতে চাইছে। ওর মাথায় কিছু খেলছে না। বললো “সে আবার কে? তোমার এক্স নাকি?” মিথিলা বললো “হে ভগবান! আরে, কোভিড! করোনা ভাইরাস!” রোমিত বিরক্ত হয়ে বলে “আসুক দেখি আমাদের বেডরুমে! ব্যাটাকে মেরে তাড়াবো! নইলে আমার নাম রোমিত নয়!” মিথিলা চিন্তিত মুখে বসে রইলো। রোমিত বললো “কী হলো? বলবে তো! এমন রাতটা নষ্ট করবে? কী চিন্তা করছো এতো?” মিথিলা দাঁত দিয়ে ঠোঁট কামড়ে বললো “রাগ কোরো না! জানো আমরা, এমনকি তোমার মাও এতো কিছু মানলেন, খালি আরটিপিসিআর টা দুজনেই করে নিলে পারতাম!” “উঃ সেটা আবার কী? এ তোমার টিভি চ্যানেল দেখার ফল!” রাগে ফুলতে ফুলতে বলে রোমিত! “না গো ডক্টর সরকার বলছিলেন তুমি আর আমি একটা পুল টেস্ট করতুম দুজনের থুতুর স্যাম্পেল একসাথে নিয়ে! নেগেটিভ এলেই নিশ্চিন্ত!” মাথা নেড়ে বললে মিথিলা। “কেন? তোমার কি আমাকে দেখে করোনা আক্রান্ত মনে হচ্ছে? কোন সিম্পটম দেখছো আমার? হাঁচি, কাশি, শ্বাসকষ্ট! এতো চিন্তা, তো এখন বিয়েটা করতে গেছিলে কেন? বছর দুয়েক পরে করলেই হতো!” গাল ফুলিয়ে বলে রোমিত। “রাগ করো না, ধরো, তুমি বা আমি যদি অ্যাসিম্পটোম্যাটিক ক্যারিয়ার হই? জানো, এমন হচ্ছে অনেক! গোটা পরিবারের হয়ে যেতে পারে! আর তোমার মা বাবার বয়স হয়েছে! কোমরবিডিটি থাকতে পারে! এসো না লক্ষ্মীটি! আজ রাতটা গল্প করে কাটিয়ে দিই! কাল একবার ঐ পুল টেস্টটা করে তারপর -!” “এই ভাইরাস সারাজীবন পিছু ছাড়বেনা! চলো কাল তোমায় বাপের বাড়ি পৌঁছে দিই!” বলে কোলবালিশ আঁকড়ে পাশ ফিরলো রোমিত।
ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।