• Uncategorized
  • 0

সাপ্তাহিক উপন্যাসে সপ্তর্ষি মণ্ডল (পর্ব – ২)

অজ্ঞাত

৭।।
চোরি করতা হ্যায় শালা — দূর থেকে শব্দটা ভেসে আসতেই , আধ ঘুম চোখে ধরমাড়িয়ে উঠে বসলো সন্দীপন । আধো আলো কম্পার্টমেন্টে দু পা এগিয়ে যেতেই দেখে মাথার ভিড় । ঘিরে থাকার জনতার মাঝে , হাত জোড় করে কাকুতি মিনতি করছে একটা ছেলে , বয়স ওই দশ কি বারো হবে । ওদিকে ক্ষুব্ধ জনতার উগ্র চিৎকার আর এদিকে সন্দীপনের প্রশ্ন একটাই , ইস্কুলে পড়ার বয়সে চুরির পথ কেন ? ইতিমধ্যে রেল পুলিশের হস্তক্ষেপে ঝামেলা কিছুটা নিয়ন্ত্রণে আসে । ছেলেটিকে রেল পুলিশ গ্রেফতার করেন । সন্দীপনের এসব দেখতে ভালো লাগছিল না , তাই নিজের সিটে এসে বসে পড়লো সে আবার ।
পরদিন যখন ঘুম ভাঙলো ট্রেন তখন অজানা পথে ছুটে চলেছে দুর্বার গতিতে । ঘড়িতে তাকিয়ে দেখে তখন সকাল ৭টা বাজে । আর চার ঘন্টার রাস্তা , তারপর আসানসোল নেমে পড়বে সে । তাই ধীরে ধীরে উঠে ব্যাগটা ঠিক ঠাক করে নিলো সে আরেকবার । তারপর চোখে মুখে হালকা জল দিয়ে এসে বসে একটা চা কিনে উপভোগ করতে লাগলো ।
ঘড়ির কাঁটা তখন বারোর ঘরে । আসানসোল স্টেশনে গাড়ি এসে থামলে , আস্তে আস্তে সে নেমে এলো ট্রেন থেকে । চেনা পথের আনন্দে বাইরে বেরিয়ে হাঁক মারলো জোরে ,
— ট্যাক্সি । রূপনারায়নপুর যাবে ?
দু তিন জন তার ডাক শুনে এগিয়ে এলো । তাদের মধ্যে একজন লাল গেঞ্জি পড়েছিল । মাঝারি উচ্চতা । সেই প্রথমে এগিয়ে এসে বললো ,
—- কোথায় যাবেন ?
—- রূপনারায়নপুর , অমল নার্সিং হোম
সন্দীপন হেসে উত্তর দিলো ।
—- চারশো লাগেগা ।
বেশ কিছুক্ষণ ভেবে ড্রাইভারটি বললো । সন্দীপন আর দর দাম না করে রাজি হয়ে গেল ওই ভাড়াতেই ।
সারাটা দিন মায়ের সাথে কাটিয়ে দেওয়ার যে আনন্দ তা সন্দীপন তাড়িয়ে তাড়িয়ে উপভোগ করেছিল আজ । বুঝতেই পারে নি কখন যে যাওয়ার সময় এসে উপস্থিত হলো , কখন চোখের পলকে ভোপালে এসে উপস্থিত হলো সে । আজ ১৮-র রাতটা সন্দীপনের একদম ভালো লাগছে না । ঠিক সেই মুহূর্তে মায়ের ফোন কলে কিছুটা সামলে নিলো সে নিজেকে । বেজে ওঠা ফোন তুলতেই ওপাশ থেকে ভেসে এলো মায়ের কণ্ঠস্বর ,
—- ওরা এসেছিলো বাড়ি দেখতে । কুড়ি দিতে চায় । বাবু , বলছিলাম কি , বাড়িটা বিক্রি না করে কোন উপায় হয় না ।
সন্দীপন বেশ নিচু গলায় বললো ,
—– উপায় থাকলে কি বলতাম মা । তাও চেষ্টা করে দেখছি , যদি কিছু হয় ফোন করে দেবো ।
এটুকু বলেই মোবাইলটা কেটে দিলো সে । মন আজ প্রচন্ড ভারাক্রান্ত । ইতিমধ্যে কোম্পানি দু দুটো মেল পাঠিয়েছে যার কথা সন্দীপন বেমালুম চেপে গেছে সবার কাছে । আজ সে একা । তাই একটা শেষ চেষ্টার আশায় ল্যাপটপটা খুলে বসলো একবার । মেল আইডিটা খুলে লিখতে শুরু করলো একটা চিঠি সি এম ডি কে সে ,
—- Respected sir ,
This letter written to you is just a formal request to look after the matter regarding a demand of bond of about 10 lakhs which is taken from your company due to my resignation. I served your company for the post of administrative officer from may 2015 . I worked there for a long tenure of 19 months in the Burdwan branch at West Bengal under KOLKATA RO , but couldn’t got myself confirmed as I couldn’t pass the licenciate exam .
After the death of my father in October 2016 it became impossible for me to serve the both end I.e home and company . Finally , I had to resign from the company on 13 Jan 2017 for very personal and domestic reason . The company demands my total gross salary of the entire period as the bond amount . I repeatedly send mails to my branch officials, DIVISION , KRO OFFICIAL, DGM sir and even HO requesting them to lessen the amount because of my financial downfall but everytime my request met with a rejection.
Sir , it is impossible for me to explain the pain of a just widow woman , who had nothing left except a house and a few pension . Her condition is also not good and being the only son I had to look after her .
On the other hand , the official were putting pressure for the collection of this huge amount and there were even mails indicating of taking legal action. With no way out , I am forced finally sold out the house , the lonely belonging of my just widow mother and submitted the bond .
Sir , it is my request to you to reconsider the entire situation once again . I fully believe in you and so I am writing this letter . I served the company full heartedly and in lieu receive my salary . There were fooding and lodging expenses that might had spent from the amount . But after resignation the company took the entire gross salary that make my income zero . I believe the company is not so worst that it can’t even provide food and basic amenities to its employers .
But on the other hand , taking entire gross salary is equivalent to zero salary paid . I would request you to consider it once again and do something not for the sake of me but a just widow woman .
Sir , humanity is the greatest thing in the earth and you had proved it repeatedly from time to time . Please consider and reply me soon that can an employee’s salary be made zero only in the name of a bond ?
Thanking you
Sandipan
প্রতিদিন উত্তর পাওয়ার আশায় সন্দীপন মেল বক্স চেক করতো একবার । আশা ছিল কিছু একটা সুরাহা হবে । কিন্তু সবটাই ব্যর্থ করে কোম্পানি দশ লক্ষে অটুট থেকে গেল আর তারপর একদিন বাবার স্মৃতিটা বিক্রি করতে হলো তাকে । জীবন পথে তার মায়ের নতুন ঠিকানা হলো তার মামার বাড়ি , হাওড়া আর সন্দীপনের , হ্রদ নগরী । কিছুটা কষ্ট হলেও একটা বড় বোঝ হালকা হলো সন্দীপনের কাঁধ থেকে ।
৮।।
সেদিন আগস্টের শেষ দিন । জন্মদিনের আগে আগে এমন একটা ঝটকা সন্দীপনের কাছে খুবই কষ্টকর ছিল । ফেসবুকের পাতা খুলেও তাই শান্তি নেই একটুও । কবিতাও আসছে না ভালো করে । এরই মাঝে একটা শীতল ঝোড়ো হাওয়া বয়ে এলো কোথা থেকে যেন । ম্যাসেঞ্জারের ম্যাসেজ বাক্সে সেই অচেনা সুন্দরী ডাক দিয়েছে তাকে , লিখেছে ;
—- আপনি ভারি সুন্দর কবিতা লেখেন তো ?
—– চেষ্টা করি মাত্র । তা আপনি কি করেন ?
মনে মনেই একটু হেসে উত্তর দেয় সন্দীপন ।
—- আমি । এখনও কিছু করি না । চাকরির চেষ্টা করছি ।
উত্তর দেয় মেয়েটি ।
—- কি রকম চাকরি খুঁজছেন ? মানে কোন পরীক্ষা দিয়েছেন এর মধ্যে ।
সন্দীপন জানতে চায় ।
— ব্যাংকের কিছু পরীক্ষা দিয়েছি । সামনে স্টাফ সিলেকশনেরও পরীক্ষা আছে ।
উত্তর ভেসে আসে স্ক্রিনের ওপাশ থেকে ।
— দেখুন । ব্যাঙ্ক আর এস এস সি – এক নয় । যেটা করবেন একটা করুন ।
লিখে পাঠায় সন্দীপন । কিন্তু ততক্ষণে মেয়েটি অফলাইন হয়ে যাওয়ায় কথা এখানেই স্থগিত করে দিতে হয় ।
এরপর আর কি ! খাওয়া দাওয়া সেরে ঘুম । পরের দিন সন্দীপন অফিস পৌঁছায় সময়ের বেশ আগেই । তার মেজাজ আজ বেশ ফুরফুরে আর স্বভাবতই এ বিষয়ে সকলেই আজ বেশ অবাক ।
সন্দীপনকে দেখে নিশা এগিয়ে এলো কাছে । হাসি মুখে জিজ্ঞাসা করলো ,
—- আজ তো বহত খুস লগ রহে হো তুম । বাত কেয়া হ্যায় ।
নিশার কথা শুনে সন্দীপনের মুখে একগাল হাসি ফুটে উঠল এবার । ঝকঝকে পরিস্কার কথায় উত্তর দিলো সে ,
—– পূজা আ রহা হয় । খুশ তো রহনা পরেগা ।
—- হা ইহে ভি সহি হয় ।
নিশা উত্তর দিলো ।
এরই মধ্যে বাকিরাও এসে উপস্থিত । সকলে ক্যান্টিনের দিকে প্রস্থান করলো এবার ।
সেদিন সন্ধ্যায় ফেসবুক খুলতেই সন্দীপনের চোখে পড়লো একটা ছবি । ছবিটি সত্যের আর ওপরে ঝুলছে একটা ক্যাপশন —
একজন ডাকহরকরার খোঁজে কত দিন রয়েছি যে আমার মনের খবর বয়ে নিয়ে আসবে একদিন ।
মনে মনে একটু হেসে কমেন্টে লিখে ফেললো সে —
ডাকহরকরা তো কত বার এসে ফিরে গেছে খালিহাতে । চিনে নিতে হয় তাকে নাহলে চেনাবে কি করে সে নিজেকে ।
ফল কি হবে জানা নেই তার , তবে বন্ধুত্বের শক্তিশেলে অপর পক্ষ যে আহত তা বলতে বাকি থাকে না আর ।
৯।।
চারদিকে কাশ ফুল ফুটে আছে আর মাঝখান দিয়ে বাইক নিয়ে ছুটে চলেছে সন্দীপন ও তার বন্ধু শুভ । নবমীর এই রাতটি কোনদিন ভুলতে পারে নি সন্দীপন । জীবনে শেষ বারের মত মদ খেয়েছিল তারা আর তারপর মনে জমে থাকা কষ্টগুলো বেরিয়ে এসেছিল বুক ফেটে । নিউটাউনে কাটানো সেই রাত্রে ওরা তিনজন , মানে ,শুভ , নব আর সন্দীপন ছাড়াও সেই কষ্টের ভাগ নিয়েছিল কিছু গেলাস ও রঙিন জলের বোতল । নবমীর শেষে বিজয়ার সকালে বিদায় জানিয়ে ঘরে ফিরে এলো শুভ । ওর আবার অফিস আছে । প্রাইভেটের পৃথিবীতে ছুটি বড়ই কম । সন্দীপন অবশ্য ফিরেছিল ঘন্টা খানেক পরে । ব্রেকফাস্ট সেরে উবের শেয়ার বুক করে নিয়েছিল সে । সন্দীপনের মন আর কলম সেদিন উবেরে বসে বসেই লিখে ফেলেছিল কয়েকটা লাইন —
” আগামী বছর আমাদের হবে ,
রাতগুলো আমাদের নিয়ে জাগবে
সন্দীপনের সন্দীপন এসেছে ,
সত্যবতীও ঠিক দেখা দেবে সেই ফাঁকে ।”
আজ কোজাগরী লক্ষী পুজো । সবাই যখন দেবী আরাধনায় ব্যস্ত , সন্দীপন তখন ফেসবুকের পাতায় তাকিয়ে । হঠাৎ একটি শব্দে হোস ফিরল তার । মেসেঞ্জারে একটি মেসেজ এসেছে আর মেসেজ করেছে সত্যবতী ,
—- হায় ।
সেও দেরি না করে উত্তর দিল,
— হ্যালো । পুজো কেমন কাটলো ।
—- ধুর । বৃষ্টিতে কেমন কাটবে ।
বেশ বিরক্তি নিয়েই উত্তর দিলো সত্য ।
—- বৃষ্টি ভালো লাগে না বুঝি ।
সন্দীপন লিখে পাঠালে , ওপাশ থেকে এক গুচ্ছ হাসির ইমোজি ভেসে এলো স্ক্রিনে । তারপর উত্তর এলো ,
—– ভালোই লাগে । তবে পুজোর দিনে বৃষ্টি কি ভালো লাগে !
সন্দীপন কিছু স্যাড ইমোজি পাঠালো এবার । তারপর লিখলো ,
—- বাড়ি কোথায় ?
সত্য মিনিট কয়েক থেমে লিখে পাঠালো ,
—– চন্দননগর ।
—- ওয়াও । ডাকতে পারতে তো । চলে আসতাম কোম্পানি দিতে ।
লিখে জানায় সন্দীপন ।
সত্যবতী তৎক্ষনাৎ উত্তর দিয়ে অফলাইন হয়ে যায় ,
—– মাম ডাকছে । এখন আসি ।
এরপর আর সত্যবতীর সাথে কোন কথা হয় নি সন্দীপনের । সুতরাং , এই টুকু তথ্য নিয়েই সন্দীপনকে পরের দিন ফিরে যেতে হবে তার কাজে । এর মানে হল ছুটি শেষ আর তাই ভোপালের টিকিট এর সিটটাও কনফার্ম হওয়ার মেসেজ চলে এসেছে মোবাইলে । পরের দিন বিকেল ছটায় তার ট্রেন , শিপ্রা এক্সপ্রেস ।

(চলবে)

ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *