মুখ্য চরিত্র: পরিমলবাবু (বয়স পঁয়ষট্টি, ক্লার্কের চাকরি করে রিটায়ার করেছেন) পরমা (পরিমলবাবুর স্ত্রী, বয়স পঞ্চান্ন, গৃহবধূ) প্রসূন (ছেলে, বয়স ত্রিশ, আইটি ফার্মে চাকরিরত) জুঁই (পুত্রবধূ, বয়েস পঁচিশ, স্কুল টিচার) প্রীতি: (মেয়ে, বয়স পঁচিশ, কলেজে পড়ে) প্রিয়ম (নাতি, বয়েস সাত বছর, ক্লাস টু) প্রসূনঃ তাহলে বুঝতে পারছ সবাই, সিচুয়েশনটা খুব ভয়ানক। আগামী কিছুদিন আমাদের কারোরই বাড়ি থেকে বেরোনো চলবে না। প্রীতি- আমার আর দাদার তো ওয়ার্ক ফ্রম হোম চলবে, কিন্তু বৌদির কাজ? জুঁই- অনির্দিষ্টকালের জন্য ছুটি। প্রিয়মেরও। পরমা- আমি এখনো বুঝতে পারছি না, যে এতে লাভটা কী হবে! পরিমল- শোনো, আমি বুঝিয়ে বলছি। একধরণের জীবাণু এসেছে এই দেশে, যা ভয়ানক সংক্রামক। হাঁচি, কাশি, এমনকি হ্যাণ্ডশেকের মাধ্যমেও ছড়াতে পারে। তাই সরকারী আদেশে সকলকে নিজেদের ঘরে বন্দী হয়ে থাকতে হবে। পরমা- কিন্তু তাতে কি জীবাণু মরবে? প্রসূন- না মা, মরবে না, তবে সংক্রমণ বন্ধ হবে। পরমা- কিন্তু এইভাবে কতদিন? প্রীতি- যতদিন না প্রতিষেধক বেরোয়। কিন্তু মা, তুমি এত ঘাবড়াচ্ছ কেন? তুমি তো কোথাও বিশেষ বেরোতে না? পরমা- আরে, আমি কি নিজের জন্য ভাবছি নাকি! আমার চিন্তা তোদের বুড়ো বাবাকে নিয়ে। ওঁর তো আবার প্রতিদিন একটুখানি আড্ডা না দিলে ঘুম হয় না! পরিমল- শোনো কথা! আমি হলাম বুড়ো আর উনি নিজে… প্রসূন- বাবা, এটা কিন্তু ঠিক, তোমাদের বয়সটাই সবথেকে বেশী খারাপ। প্লিজ একবারও বেরিওনা এই কিছুদিন! পরিমল- না না, আমি কোথাও বেরোচ্ছি না। ভাবলেই আমার তো দিব্যি এক্সাইটিং লাগছে!! মনে হচ্ছে, সেই নেতাজীর মত আমিও বেশ সরকারী আদেশে গৃহবন্দী!! পরমা- শোনো, নিজেকে নেতাজী বা পিঁয়াজি যা খুশী ভাবো, প্রসূনের কথাটা ভালো করে শুনে নাও আর মেনে চোলো। জুঁই- আচ্ছা, তুমি বললে দুধওয়ালা, কাগজওয়ালা সবাইকে বন্ধ করে দিতে, কিন্তু তাহলে দোকান বাজার… প্রসূন- নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্র পাওয়া যাবে শুনছি। কিছুটা কিনে স্টক করে রাখতে হবে বাড়িতে। আর হ্যাঁ, প্রমীলাকে এই মাসের মাইনে দিয়ে কাল থেকে আসতে বারণ করে দাও। পরমা- সেকি! প্রমীলা না আসলে তো… প্রীতি- মা, দাদা ঠিকই বলেছে। এখন প্রমীলা বা অন্য যে কেউ এই রোগের বাহক হতে পারে। তা ছাড়া, ওর নিজেরও তো ঘর সংসার আছে! পরমা- তাহলে আমাদের বাড়ির সব কাজকর্ম! জুঁই- সে আমরা সামলে নেব মা! স্কুলে যেতে না হলে আমার হাতে অনেক সময় বাঁচবে। প্রিয়ম- মা, আমিও কাজ করব বাড়ির! জুঁই- থ্যাঙ্কু সোনা, কিন্তু আমাদের সবথেকে বেশী সাহায্য হবে যদি তুমি আর তোমার বাবা শুধু চুপচাপ একটা ঘরে বসে থাকো। বুঝলে? প্রসূন- এই দ্যাখো, আমি আবার কী করলাম! পরমা- বৌমা একদম ঠিক বলেছে। প্রসূন, তোমার বাবাকেও চুপচাপ বসে থাকতে বোলো। কাজ আমরা সামলে নেব। জুঁই- তাহলে প্রমীলাকে এখনই জানিয়ে দিই। প্রমীলাদি! ও প্রমীলাদি! (প্রমীলার প্রবেশ) প্রমীলা- হ্যাঁ গো বলো। জুঁই- শোন। জানো নিশ্চয়ই, চারদিকে অসুখবিসুখ হচ্ছে, তাই কাল থেকে তোমাকে আর আসতে হবে না। আমরা কাজকর্ম সামলে নেব। তবে তোমার কাজটা থাকবে, মাইনেও পাবে। ঠিক আছে? প্রমীলা- সেকি বৌদি! কাজে না এলে আমি সারাদিন করব কী! প্রীতি- কেন, নিজের বাড়িতে থাকবে, বর ছেলে নিয়ে! প্রমীলা- সে আমি পারব না। উফ, সারাদিন ঐ মাতালটার সঙ্গে থাকা যায় নাকি! তোমাদের সঙ্গে থাকি বলে একরকম দিন কেটে যায়। প্রীতি- তা হয় নাকি! এখন রাস্তায় বেরোলে পুলিশ ধরবে, তা জানো? প্রমীলা- আমাদের ধরবে না। আমি ঠিক চলে আসব। প্রসূন- তোমার কোনো চিন্তা নেই। এখন বাজারে মদ পাওয়া যাবে না, তাই তোমার স্বামীও মাতলামি করবে না। প্রমীলা- তাহলে তো আরো বিপদ! ওইসব গিলেই যদি বা একটু শান্ত থাকতো, এখন তো আমায় মারধর শুরু করবে! না দাদা, আমাকে কাজে আসতে মানা করবেন না! প্রীতি- আচ্ছা, তোমার অন্য বাড়ির কাজগুলো? প্রমীলা- সবই তো চলবে! আজই সামনের বাড়ির দিদি বলে দিলেন, এই সময়ে একদিনও কামাই না করতে, উনি মাইনে বাড়িয়েও দেবেন! প্রসূন- এটা উনি একেবারেই উচিৎ কাজ করেননি। আমি ওদের সঙ্গে কথা বলছি এখনই। আমাদের সোসাইটির তরফ থেকে আজই একটা সিদ্ধান্ত নিতে হবে এই ব্যপারে। যাই হোক, তুমি আগামী কিছুদিন একেবারেই রাস্তায় বেরোবে না। বুঝেছ? আর হ্যাঁ, আজ যাওয়ার সময় এই মাসের মাইনেটা নিয়ে যেও। প্রমীলা- কিন্তু বাড়ির সব কাজ তাহলে… জুঁই- সে আমরা ঠিক সামলে নেব। কিছুদিনের তো ব্যপার! প্রমীল- দিদি, আমায় ছাড়িয়ে দিচ্ছেন না তো! কাজটা যে আমার খুব দরকার! প্রসূন- আমি তো বলছিই, চাকরি তোমার থাকবে। এটা কিছুদিনের জন্য ব্যবস্থা, যাতে আমরা সকলেই সুস্থ থাকতে পারি! প্রমীলা- আচ্ছা, আমি যদি মাঝে মধ্যে এসে… প্রীতি- শোনো, তুমি যদি আর একদিনও এই বাড়ি আসো, আমরা তোমায় আর নিজের বাড়ি ফিরতে দেব না। যতদিন লক ডাউন চলবে, তোমাকে আমাদের সঙ্গেই থাকতে হবে। রাজী? প্রমীলা- তা কী করে হয় দিদি… প্রীতি- তাহলে তুমি ভেবে দেখো, আসবে কি আসবে না। প্রমীলা- আচ্ছা দিদি, বুঝতে পেরেছি। (প্রস্থান) পরিমল- কিন্তু সত্যি তো। দোকান বাজার একদম বন্ধ করে দিলে… প্রীতি- সবকিছু এখন অনলাইনে পাওয়া যায় বাবা, আমি… প্রসূন- না রে, এখন ডেলিভারি দেওয়ার কেউ আসবে না, তাছাড়া তাঁদের কেন শুধুশুধু রিস্ক নেওয়াবো! দুই-তিনদিন অন্তর আমি একবার টুক করে বেরিয়ে কিছু কেনাকাটা করে আসব নাহয়। পরমা- একসঙ্গে অনেকটা বাজার করে রাখলেই তো হয়! এক মাসের মতো! জুঁই- কেন মা, শুধুশুধু মজুত করবেন! নষ্ট হয়ে যাবে তো! পরিমল- শোনো, যুদ্ধ তো আর লাগেনি, যে জিনিসপত্র আর পাওয়া যাবে না! নিশ্চয়ই সরকার থেকে চাল ডাল সব্জীর চালান আসবেই। পরমা- তোমার ওষুধগুলো কিনে রেখো। প্রীতি- সব কিনে রাখব মা, চিন্তা কোরো না। প্রসূন- সকলে যদি এখন ভয়ের চোটে প্রচুর জিনিসপত্র কিনতে আরম্ভ করে, বাজারে মিছিমিছি আকাল পড়বে। যাদের হাতে পয়সা নেই, তারা দৈনিক বাজারে কিছুই পাবে না। সেটা কি ঠিক হবে? পরিমল- আর হ্যাঁ, বাড়িতে হাত ধোওয়া নিয়ে কী বলছিলি? প্রসূন- সকলে প্রতি ঘন্টায় মনে করে সাবান দিয়ে ভালো করে হাত ধোবে। আমি স্যানিটাইজারও কিনে রেখেছি, সেটাও ব্যবহার করতে পারো, তবে সাবানেও কাজ হবে। প্রিয়ম- আর বাবা, মাস্ক পরতে বলো? প্রসূন- ঠিক, খুব গুরুত্বপূর্ণ। বাইরে বেরোতেই যদি হয়, মাস্ক পরা বাধ্যতামূলক! পরিমল- আমি ওসব পরব না, কেমন ডাকাত সর্দারের মতো লাগবে। প্রিয়ম- দাদু ডাকাত সর্দার! হিহিহিহি! পরমা- তোমায় বেরোতেই বা দিচ্ছে কে! আর বাড়িতে না পরলেও চলবে, তাই না রে প্রসূন? প্রসূন- হ্যাঁ, সবসময় পরে থাকার দরকার নেই। প্রীতি- দাদা, ‘কন্টাজিয়ন’ নামে একটা সিনেমা দেখেছিস? অনেকটা সেইরকম অবস্থা না রে আমাদের? প্রসূন- একদম ঠিক বলেছিস। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রনে না থাকলে আমাদের সেইরকম অবস্থাই হবে! পরমা- জয় ঠাকুর, আমাদের এই বিপদ কাটিয়ে দাও ঠাকুর!! কী যে ঝামেলা এল আমাদের দেশে! প্রীতি- মা, শুধু আমাদের দেশেই নয়, সারা পৃথিবীতে! তোমার ঠাকুর কি এতজনকে উদ্ধার করতে পারবেন? পরমা- যা জানিস না, তা নিয়ে কথা বলিস না তো! ঠাকুর সমস্ত জীবের স্রষ্টা, সবাইকেই বাঁচাবেন। প্রিয়ম- কিন্তু ঠাম্মা, এই ভাইরাসটাও তো একটা জীব, একেও তাহলে ঠাকুরই বাঁচাবেন, তাহলে আমরা একে মারব কী করে? পরিমল- হাহাহাহাহাহাহা!! নাও, এবার উত্তর দাও!! (সকলের হাসি)