• Uncategorized
  • 0

দৈনিক ধারাবাহিক উপন্যাসে মৃদুল শ্রীমানী (পর্ব – ৭০)

পর্ব – ৭০

৬৯

ঘুম আসছে না কিছুতেই। চোখের মধ‍্যে, বুকের মধ্যে একটা জ্বালা করছে। আমি কি তাহলে সমাজ বিচ্ছিন্ন পরিত্যক্ত একটা মানুষ? সকালে কলেজের আলোচনা সভায় আমি  যা বলেছি, তা কারো ভাল লাগে নি। অনসূয়াদিও দেখিয়ে দিলেন আমার তরফে কারখানা চালানোয় কত অসম্পূর্ণতা। আর বাবা মায়ের সামনে দাদার হাতে মার। বাড়িতে আমার জায়গাটা ঠিক কি? “আমি কি একটা কুড়িয়ে পাওয়া মেয়ে?
ভেতরটা তোলপাড় হতে থাকে শ‍্যামলীর। ট্রামলাইন ধরে একটা লোক হাঁটছে। খ‍্যাপার মতো। ভূতগ্রস্ত হতভাগ‍্যের মতো। নিয়তি তাড়িত নিরাশ্রয় নিরালম্ব আত্মার মতো।  ওই লোকটা সন্ধ্যায় ওইরকম খ‍্যাপার মতো হেঁটে চলে।  গাড়ি ওর মুখের উপর গাড়লের মতো কেশে দিয়ে গেল। লোকটা হাঁটতে হাঁটতে দেখছে রাস্তায় বেশ‍্যা রমণী গান গাইছে। তিনটি আধবুড়ো ভিখিরি চুলের উকুন আর গায়ের এঁটুলি মারছে। হাইড্র‍্যাণ্ট থেকে কুষ্ঠ রোগী চেটে চেটে জল খাচ্ছে। বুকের ভিতর তার অনন্ত তৃষা। এবার নিচু হয়ে কি দেখছে খ‍্যাপাটা! একটা ইঁদুর। রক্ত মাখা ঠোঁট। মরে পড়ে আছে? না ঘুমাচ্ছে। এবার একটা পেঁচা এসে নিয়ে যাক ওকে। বড় মায়াভরা চোখ নিয়ে ইঁদুরটাকে দেখছে পাগল। এই রকম টলমলে আত্মা নিয়ে রোজ রাতটহল খ‍্যাপার! শিয়ালদায়, এন্টালিতে, বালিগঞ্জে, গ‍্যালিফ স্ট্রিটে, বেলগাছিয়ায়। তার মতো বেগানা আর কে আছে? কোথাও মানিয়ে নিতে পারে না সে। কেউ তাকে সহ‍্য করতে পারে না। পরেও না, ঘরেও না।  বলে, তাই আমি এমন একাকী। একা একা পথ হাঁটে পাগল। আকাশের তারা দ‍্যাখে। কালপুরুষ। বৃশ্চিক রাশি। তারপর কলকাতার  শেষ ট্রাম ধাক্কা দেয় তাকে। পাঁজরে জোর ধাক্কা। পাঁজর গুঁড়িয়ে গেল।….
বুকের ভেতর সাংঘাতিক জ্বালায় উঠে পড়ল শ‍্যামলী। আজ কি সে ঠিক মতো জল খায় নি? এত ব‍্যথা হচ্ছে কেন পাঁজরে আমার? কোথাও ঘন্টি বাজে। কেন বাজে ঘন্টি। পাঁজরে ভীষণ ধাক্কা।
মুখে চোখে জল দিয়ে আয়নার দিকে তাকায়। আয়না তার দিকে ভারি করুণ মুখে তাকায়। অক্টোবর মাস। এমন অক্টোবরে পাঁজরে ট্রামের ধাক্কা খেয়ে হাসপাতালে যান তিনি। বাইশ তারিখ না? চুয়ান্ন সাল। কবি জীবনানন্দ দাশের মৃত্যুর কথা সে মনে করতে পারে। আনন্দ ছিল তার? অন‍্য কোনো মাত্রায় মহৎ ভাবে নিশ্চয়ই ছিল। লোকে বুঝেছিল কি? নিজের বুকে হাত ছোঁয়াতে চান কবি। বলেন, তাই আমি এমন একাকী। অক্টোবরের নিশুতি রাতে বিছানার উপর পদ্মাসনে বসল শ‍্যামলী।
“নিবিড় ঘন আঁধারে জ্বলিছে ধ্রুবতারা
মন রে মোর পাথারে হোস নে দিশেহারা।”
দরদর ধারায় চোখ গলে গলে পড়ছে। আর গান গাইছে মেয়ে।
“রাখিয়ো বল জীবনে রাখিও চির-আশা
শোভন এই ভুবনে রাখিয়ো ভালবাসা”
হঠাৎ দরজায় টোকা শুনে দরজা খুলে মাকে দেখতে পেল শ‍্যামলী। মা তাকে জড়িয়ে ধরে তার হাত পা টিপে টিপে দেখতে দেখতে বললেন, তুই ঠিক আছিস তো? আমি একটা কুস্বপ্ন দেখছিলাম রে।
মাকে নিজের খাটে বসায় শ‍্যামলী। তাঁর গায়ের কাছে ঘেঁষে থেকে মেয়ে গেয়ে চলে,
“সংসারের সুখে দুঃখে চলিয়া যেয়ো হাসি মুখে
ভরিয়া সদা রেখো বুকে তাঁহারি সুধাধারা….”

ক্রমশ…

ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *