• Uncategorized
  • 0

দৈনিক ধারাবাহিক উপন্যাসে মৃদুল শ্রীমানী (পর্ব – ৬৮)

পর্ব – ৬৮

৬৭

খাওয়ার পর বাবার ঘরে গিয়ে ব‍্যাঙ্কের পাশব‌ই আর চেকব‌ই বাবার হাতে দিল শ‍্যামলী।
বাবা, কারেন্ট অ্যাকাউন্টে কত আছে দেখে নাও। তোমার এখন কোথাও কোনো দেনা নেই। দুটো গাড়ির সারাইয়ের দাম হাতে এখনো আসে নি। তোমার লেবাররা পুজোর কটা দিন কারখানা খোলা রাখতে রাজি আছে। চারঘন্টা করে দুটো শিফটে চালাবো। কিছু বাড়তি পয়সা দেওয়া উচিত। পুজোয় অনেকেই নিজের গাড়ি নিয়ে কলকাতায় ঠাকুর দেখতে যাবে। তারা এক আধটু দেখিয়ে নিতে আসতেও পারে। সেই ভরসায় কারখানা খোলা রাখব। এতে আর কিছু না হোক গুড‌উইল বাড়বে।
শশাঙ্ক পাল বললেন, পাশব‌ই দেখে কি করব মা, সব‌ই তো জানি।
হ‍্যাঁ বাবা, তোমার আমলে তুমি লেবার দের সঙ্গে সারাক্ষণ খাটতে। কথায় বলে, খেটে খাটায়, দ্বিগুণ পায়। আর তখন তোমার লেবার আরো বেশি ছিল। তারা সব তোমার হাতে তৈরি ঝানু মিস্ত্রি।
কি রকম দিন ছিল বল্, স্মৃতি সরণি বেয়ে অনেক পিছিয়ে যান তিনি।
ঠিক বাবা, আমায় কলেজে যেতে হয়, তার উপরে নিজেকে তৈরি রাখতে আমি লাইব্রেরিতে বসে পড়াশুনা করি।
শশাঙ্ক পাল স্নেহ ভরে বললেন, বাড়িতে বসে পড়িস না কেন?
ওটা রিডিং রুম বাবা। আমি মুখ ফসকে লাইব্রেরি বলে ফেলি। ওখানে বসে পড়তে হয়। ওখানে স্টেটসম‍্যান কাগজটা পাই।
শশাঙ্ক পাল উৎসাহ দিয়ে বললেন,  স্টেটসম‍্যান খুব ভাল কাগজ। সেকালে অ্যারিস্টক্র‍্যাট ফ‍্যামিলির লোকদের স্টেটসম‍্যান না হলে চলত না। কলকাতা হাইকোর্টের জজ ব‍্যারিস্টাররা সব স্টেটসম‍্যান পড়তেন।
ওখানে বসে বসে পড়ার আসল কথাটা তোমাকে বলি নি বাবা।
শশাঙ্ক পাল বললেন, কি আবার আসল কথা। তুই স্টুডেন্ট। লাইব্রেরিতে পড়িস, ব‍্যাস। হয়ে গেল।
না বাবা, দৈনিক তিনঘন্টার বেশি একটানা পড়লে কলেজের স্টুডেন্টদের ওরা ফুড কুপন দেয়। ওই কুপন দেখিয়ে আমি ছেলেদের কলেজের ক‍্যান্টিনে সবজি ভাত খাই।
বাসন্তীবালা রেগে ওঠেন। একটা মান‍্যিগণ‍্যি লোকের মেয়ে হয়ে তুই লোকের বাড়ি মেগে খাস, এটা করতে তোর ঘেন্না হয় না? তোর কি হায়া পিত্তি কিছুই নেই রে? বাপের সম্মানটা মাটিতে মিশিয়ে না দিলেই কি চলে না তোমার?
মায়ের কথার সরাসরি উত্তর না দিয়ে শ‍্যামলী বলল, জানো বাবা, সেকালে যারা পড়াশোনা করত, লোকজন তাদের সম্মান করে সিধে পাঠাত। চাল ডাল কাঁচা কলা। ছেলের জন্মদিন উপলক্ষে পণ্ডিত বাড়িতে সিধে পাঠিয়ে তৃপ্তি বোধ করত লোকজন।
বাসন্তীবালা বললেন, সে গুরুঠাকুর আর সাধু সন্নিসীকে এখনও লোকে সম্মান করে। শুধু তোর উৎপটাং ব‍্যবহারে আমার ইচ্ছে থাকলেও গুরুদেবকে এখনও টাকা দিতে পারিনি। নকুড়বাবু আমাদের কি না কি ভাবছেন বল্ তো? জামাইটাও তো সেদিন কত ছ‍্যা ছ‍্যা করে গেল।
শ‍্যামলী মায়ের কোনো কথাই গায়ে না মেখে বলল, জানো বাবা, নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা আসত দূর দূরান্ত থেকে। তারা সারাদিন পড়াশোনা করত। বড়ো বড়ো রাজা আর ভূস্বামী রা এই ছাত্রদের খাবারের যোগাড় করতে জমি দান করত। আর গ্রামের বাসিন্দা লোকজন সেই জমি চাষ করে অর্ধেক ফসল নিজের হাতে রাখত। বাকি অর্ধেক জমা দিত বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাণ্ডারে।
উৎসাহ ভরে শশাঙ্ক পাল বললেন, আমরা তো নালন্দা বেড়াতে গিয়েছিলাম। তুই তখন গুটগুট করে হাঁটতে পারিস। মায়ের কাছে তোদের সবকটাকে দাঁড় করিয়ে নালন্দার একটা ছবি এখনো অ্যালবামে আছে।
শ‍্যামলী বলল, জান বাবা, এইভাবে জমি দিয়ে আর পরিশ্রম দিয়ে সেদিনের সমাজ ভাল ছাত্র আর পণ্ডিতদের পড়াশোনায় উৎসাহ দিত। তুমি জান বাবা, আমি মাধ্যমিক আর উচ্চ মাধ‍্যমিক দুটো পরীক্ষায় জেলার সেরা হয়েছিলাম। তাইতে আমি স্কলারশিপ পাই। আমার কলেজের বেতন দেওয়া আর খাতা ব‌ই কিনি সেই পয়সায়। আমি তোমার কারবার হতে কোনো পয়সা নিই না বাবা। ফ্রি সার্ভিস দি‌ই।
বাসন্তীবালা বললেন, তো বাপের কারবার দেখছিস, তোরাই তো মালিক। তোরা নিজেদের জিনিস নিজেরা গুছিয়ে রাখবি, তাতে এত বলার কি আছে?
শ‍্যামলী বলল, মা, আমি পাল অটোমোবাইল এর মালিকের কাছে একটা এনগেজমেন্ট লেটার পেয়ে কথাটা বলছি কেমন? তোমার শুনতে ইচ্ছে করলে শোনো। কিন্তু আমায় বাধা দিও না।
একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে শ‍্যামলী আবার বলল, বাবা, তোমার যে একসপিরিয়েন্স ছিল, আমার তা এখনো তৈরি হয় নি। তোমার যে কোয়ালিটি মিস্ত্রি তুমি নিজের হাতে তৈরি করে নিয়েছিলে, আমি তাদেরকে পাই নি। কটা আনপড়কে নিয়ে আমি যা হোক করে চলছি। তুমি যে যন্ত্রপাতি সাজ সরঞ্জাম একটা একটা করে যোগাড় করেছিলে তা বেহাত হয়ে যে সামান‍্য কটা পড়ে আছে, তাই দিয়ে আমি কাজ চালাচ্ছি বাবা। তোমাকে পাশব‌ই চেকব‌ই সব ফেরত দিলাম। তোমার কারখানার হিসাব সব কাল তোমাকে বুঝিয়ে দেব বাবা। আর আমার যেটুকু ম‍্যানেজমেন্ট শেখা হয়েছে, তাতে একটা চলনসই অ্যপ্রেন্টিসের কাজ জুটিয়ে আমার একার পেট ভাল‌ই চলে যাবে।
শশাঙ্ক পাল বললেন, তোকে তো আমি বলেছিলাম, কারখানা বেচে দিচ্ছি। আমি শরীরে মনে ফুরিয়ে গেছি। আমি এখন হিসেবের বাইরে। তুইই তো জেদ করে নিজের বিয়ের গয়নাগুলো বিক্রি করে, তোর বিয়ে বাবদে রাখা ফিক্সড ডিপোজিট ভাঙিয়ে দেনা শুধে আবার আমায় কারবারে নামালি।
আর এখন তুই বলছিস অন‍্য জায়গায় অ্যাপ্রেন্টিস হবি, তবু আমার পাশে থাকবি না?
বাবা, এখন তুমি দেখতেই পাচ্ছ, আমার কারণে তোমার ভারি অসুবিধা হচ্ছে। তুমি তোমার গুরুদেবকে টাকা দিতে পারছ না, আগে তুমি যেভাবে দানধ‍্যান করতে, তা তুমি আমার কারণে পারছ না। এই পথের কাঁটাটাকে সরিয়ে দাও। সবাই তোমাকে আবার সম্মান করবে।
 শশাঙ্ক পাল বললেন, তুই এই শোকাতাপা বাবার বুকটাতে এত আঘাত দিলি?
বলে তিনি হু হু করে কেঁদে উঠলেন।
বাসন্তীবালা হাঁউমাউ করে কেঁদে উঠে বললেন ওরে মুখপুড়ি, তুই কি বাবাটাকে বাঁচতে দিবি না?
পিছন থেকে সবিতা বলল, অসুস্থ অথর্ব বাবার দেখাশুনা করা সন্তান হিসেবে তোর কর্তব‍্য। তুই কি চাস, সবাই সে জন‍্যে তোর কাছে মাথা নিচু করে থাকবে?
শ‍্যামলী একটা বেতের মতো সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে বলল, বাবা, আমি অযোগ্য লোক বলে তোমার কারখানায় সে রকম লাভ করে দেখাতে পারি নি। মাসের সংসার খরচের উপরে দুহাজার টাকা পুজোর খরচা দিয়েছি বলে মা রাগ করছে। কিন্তু আমি কি করে কি সামলাচ্ছি, তা তোমাকে বুঝতে হবে। তার উপর রোজ আমার উপরিপাওনা এই মারধোর, গালমন্দ। এটাই কি আমার পাওনা ছিল?

ক্রমশ…

ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।