এই সময়ের লেখায় ভজন দত্ত – পঞ্চম পর্ব

করোনা – এক পাতি পাব্লিকের ডায়েরি
পঞ্চম পর্ব
মাঝরাতে পাতি-পাতি পাব্লিকদের ঘুম আসে না। গলাবন্ধ হয়ে আসে। শ্বাসকষ্ট হয়। গায়ে হাত দিয়ে গরম অনুভব হলে ঢোক গেলার চেষ্টা করে।যেন গায়ের তাপটাকে ঢোক গিলে শরীরের ভেতর সে চালান করার চেষ্টা করে।কেউ যাতে গায়ে হাত দিয়ে তাপ বুঝতে না পারে। কিন্তু তারা ঢোক গিলতে পারে না!দমবন্ধ হয়ে আসে। মনে হয় এই বুঝি অন্তিম সময়!তাদের কষ্ট লাঘব করতে কেউ কি একটু জল দেবে! ঘুমের মধ্যে অজান্তেই একটা খুক করে কাশির শব্দ হতেই পাতি পাব্লিক ধড়ফড়িয়ে বিছানা থেকে উঠে পড়ে।
এসময় কাশলেই সচেতন লোকজন তো দূরের কথা, এতদিনের বিয়ে করা বউও কেমন সন্দেহের চোখে তাকায়। বাতকম্মের মতো লোকজন তাই আজকাল কাশিও গোপন করছে।মৃত্যু ভয়ে ভীত মানুষ একে অপরের দিকে আড়চোখে মেপে নিচ্ছে জীবন! সুস্থ না অসুস্থ বিতর্ক সরিয়ে তারা তাই মুঠো মুঠো মাল্টিভিটামিন ও প্যারাসিটামল তুলে এনেছে বাজার থেকে।
★
কিছু টাকা ডাইনে-বাঁয়ে এদিক-ওদিক করে ইন্দিরা আবাস যোজনায় পাওয়া একটা ছোটঘর, তাতেই গাদাগাদি করে এখন ঘুমানো। ঘুম আসে না। বাইরে এসে একটা বিড়ি ধরিয়ে ভাবে, বাইরে শুলে কি ‘করোনা ঠাকুর’ রাগ করবে!হুজুগে ঘরের উঠোন থেকে খুড়ে পাওয়া পোড়া কাঠটুকরোর তিলক তো সেও কেটেছে, তবে ভয় কিসের!তার ওপর শীতলা পুজোর দিন ওর বউও তো ভিড়ের মধ্যে গিয়ে শীতলা মায়ের পুজো দিয়ে এসেছে।জুম্মাবারে সকলে মিলে মসজিদে নামাজ পড়ে এসেছে ওর সব বন্ধুরা। এই তো কাল ফরিদ ভাইয়ের কাছে আবার শুনলো ওদের কোরান শরীফের ভেতর নাকি আল্লাহর সাদা দাড়ি ও লাল চোখের পাতা পাওয়া যাচ্ছে। বলতে বলতে নাকি ফরিদ ভাইয়ের গায়ে কাঁটা দিচ্ছিল। সেজন্য পীর সাহাব বাড়ি বাড়ি এসে বলে গেছেন, ওদের বারবার নামাজ পড়তে হবে,ঘরে ঘরে আজান দিতে হবে,তবেই এই শয়তান ভাইরাস থেকে মুক্তি মিলবে।
এদিকে আবার মেসেঞ্জারে, হোয়াটসঅ্যাপে এই লকডাউনের বাজারেই চার-পাঁচজন একই মেসেজ পাঠালেন। মেসেজটি এরকম, “আগামী শনিবার (২৮/০৩/২০)ভারতীয় সময় বিকেল সাড়ে চারটে (৪.৩০), বাংলদেশী সময় বিকাল ৫ টা ও অন্যান্য সকল দেশের আন্তর্জাতিক সময় অনুযায়ী COVID- 19 এর হাত থেকে রেহাই পেতে আমরা সমগ্র পৃথিবীর হিন্দু ভাই ও বোনেরা আমাদের সকল সনাতন ধর্মাবলম্বীদের মঙ্গল কামনায় করুনাময়
সৃষ্টিকর্তা ঈশ্বরের নিকট প্রার্থনা করব।
যথাসম্ভব জনসমাগম এড়িয়ে নিকটবর্তী মন্দিরে,
সম্ভব না হলে বাড়িতে, অথবা যে যেখানে অবস্থান
করবেন সেই অবস্থায় থেকে সবাই এক সাথে
কলিযুগের মুক্তি লাভের একমাত্র বাণী মহানাম
সংকীর্তন””হরে কৃষ্ণ হরে কৃষ্ণ, কৃষ্ণ কৃষ্ণ হরে হরে, হরেরাম হরে রাম, রাম রাম হরে হরে “”
১০৮ বার বলব। এর পর গীতা পাঠ
“যদা যদা হি ধর্মস্য গ্লানিভাবর্তি ভারত ॥
অভ্যথানমধর্মস্য তদাত্তানং স্রিজাম্যহম ॥
পরিত্তরাণায় সাধূনাং বিনাশায় চ দুষ্ক্রিতম ।
ধর্মসংস্থাপনার্থায় সম্ভাবমি যুগে যুগে ॥ ১ বার
উচ্চারণ করব!!একজন সনাতন ধর্মাবলম্বী হয়ে হয়ে সবাইকে জানিয়ে দেওয়ার দায়িত্ব টা আপনাকেই দিলাম।ঈশ্বর অবশ্যই আমাদের রক্ষা করবেন!!
মেসেজটি পাওয়া মাত্রই কপি/ ফরোয়ার্ড করে
ছড়িয়ে দিন ফেসবুকের যত সনাতনী বন্ধু আছে /
নিজের ওয়ালে/হিন্দু ধর্মীয় যত গ্রুপ /পেজ, এমন
কি ফেসবুকের বাইরে যারা আছে তাঁদেরকেও জানিয়ে দিন।”
পাতি পাব্লিক ভাবে,মানুষ যখন রোগ থেকে, সংক্রমণ থেকে বাঁচার জন্য বিজ্ঞানের কাছে এসে হাত পাতছে,নতজানু হয়ে বসছে। নিজে সুস্থ থাকার জন্য ও অপরকে সুস্থ রাখার জন্য মানুষ যখন চিকিৎসকদের পরামর্শে এতদিনকার গোষ্ঠীবদ্ধ জীবন ছেড়ে নিঃস্ব নিঃসঙ্গ জীবনে কোনোরকমে মানিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করছে, তখন ধর্মের ধ্বজাধারীরা আবার মাথাচাড়া দিয়ে উঠতে শুরু করছে। মক্কা,পুরি,বেনারস,ভ্যাটিকান থেকে শুরু করে যখন সব মন্দির,গির্জা, মসজিদের দরজা বন্ধ হয়েছে, স্বয়ং পৃথিবী-ঈশ্বর যখন মুখে মাস্ক বেঁধে একা একা বাঁচতে চেষ্টা করছে, তখন কি এগুলো চক্রান্ত বলে ধরা হবে না!এর পিছনে কি সামনের দিনে আগত রামনবমী (১৯ চৈত্র,১৪২৬, ২/৪/২০২০), সবেবরাত (৯/৪/২০২০),গুডফ্রাইডে (১০/০৪/২০২০), এসব উৎসব পালনের ছক চলছে না অঙ্ক, কে জানে!
♥
আজ লকডাউনের চতুর্থ দিনে আশঙ্কা সত্যি প্রমাণিত হয়ে আক্রান্তের সংখ্যা হাজার ছাড়ালো। জানিনা এর শেষ কোথায়! মানুষ, অধিকাংশ মানুষ এখনো দরকার না পড়লে বের হচ্ছেন না। বের হলেও যে যতটা পারছেন সাবধানতা অবলম্বন করে চলেছেন।গরিষ্ঠ মানুষের ভূমিকা ভালো। কতিপয় চিরকালীন ত্যাঁদড়দের সোজা করা যায় না বোধ হয়! মুদিখানার ভিড় কমে আসছে। ঘরে ‘ল্যাদ’ খেয়ে মহান দেশপ্রেমিক হবার এমন সুযোগ কেউই হাতছাড়া করতে চায় না।
কোলকাতা শহরে জীবাণুনাশক ছড়ানো হলেও রাজ্যের অন্যত্র তা কেন ছড়ানো হবে না তা নিয়ে নেটিজেনদের মাথাব্যথা দেখা না গেলেও এখন সোশ্যাল মিডিয়ায় জ্ঞান বিতরণ কমে আসছে।দিনদিন বাড়ছে গৃহকোণ থেকে লাইভের সংখ্যা।বড়,মেজ, সেজ কত্তা বা গিন্নি সকলেই আসছেন লাইভে। যিনি কবিতা লেখেন তিনি লাইভ কবিতা পাঠ করছেন, যিনি গান জানেন বা জানেন না তিনি লাইভ গান নিয়ে আসছেন।বাচিক শিল্পীরা আসছেন প্রিয় কবিতা নিয়ে।সাধারণ মানুষ অনেকেই লাইভ করছেন। আসলে, জোর করে ‘এই বেশ ভালো আাছি’ দেখানোটা জরুরি বলেই হয়তো তারা মনে করছেন! ভেতর ভেতর কী অস্থিরতা কাজ করছে আমাদের সকলের মনে সেটা সহজেই আন্দাজ করা যায়। স্বাভাবিক জীবনযাপন স্তব্ধ হলে মানুষ কী আর ভালো থাকতে পারে!ক্রমশ এক হতাশায় আমরা ডুবে যেতে যেতে সকলেই আমরা চাইছি অন্তর্জালের ভেতরে জীবনকে খুঁজে নিতে। তাই এই লাইভ, এই সতর্কতার বাণী শোনানো। আসলে সেসব নিজেকেই আমরা শোনাচ্ছি। আমরা তো পাতি পাব্লিক,নেট অন করে সোশ্যাল মিডিয়ায় দুটো বাণী, চারটে লাইভ, ছটা ছবি,পাঁচটা খিস্তি ঝাড়তে পারি কিন্তু আমরা দেখছি সকাল থেকে রাত অব্দি যে মানুষগুলো মহল্লায়, বস্তিতে জটলা বেঁধে আড্ডা দিচ্ছে, তাস খেলছে, তাদেরকে ঘর থেকে চেঁচিয়ে বলতে পারছি না,ভাই ঘরে থাক।ঘরে থাক। ঘরেই থাক! বললে লক্ষ্মণরেখা আঁকার আধলা ইটটা যে উড়ে এসে পড়বে না,এই গ্যারান্টি কি কেউ দিতে পারবেন?
এই লকডাউনে কিছু ব্যবসায়ীর পোয়া বারো হলেও সামগ্রিক ভাবে অধিকাংশই ক্ষতির মুখে দাঁড়িয়ে আজ চুল ছিড়ছে। সামান্য একটা গুমটি করে সংসার চালাতো, একটা ফুচকার বা চায়ের বা চপের বা ফার্স্ট ফুডের বা মনোহারি দোকান দিয়ে যারা সংসার চালাতো তারা তারা সকলেই আজ এক কঠিন সমস্যার মুখে দাঁড়িয়ে। একই কথা প্রযোজ্য অটো,টোটো,রিক্সা,ট্রেকারওয়ালাদের জন্য। এদের অনেকেরই বিপিএল কার্ড নেই, ওদের কথাও নিশ্চয়ই সরকার বাহাদুর ভাববেন।
ব্যবসায়ী,বিশেষ করে বস্ত্র ব্যবসায়ীরা চৈত্র সেলের বাজারে প্রচুর ক্ষতির মুখোমুখি দাঁড়িয়ে। শহরের মিষ্টি দোকানগুলো খোলার ব্যাপারে এখনো কোনো সদর্থক ভাবনা জানা যাচ্ছে না।দুগ্ধ ও দুগ্ধজাত সামগ্রীর ব্যবসায়ীরাও লোকসানের মুখে। এই দুটোকে নিত্যপ্রয়োজনীয় হিসেবে বিবেচনা করলে এদের বাঁচানো যায়।ক্রেতা ও বিক্রেতা, দু’পক্ষই এতে উপকৃত হবেন। মিষ্টান্ন শিল্পের সঙ্গে যুক্ত কর্মীরাও বিপর্যয়ের হাত থেকে রক্ষা পাবেন। আশাকরি উপযুক্ত কতৃপক্ষ বিষয়টি নিয়ে ভাববেন।
ভারতে লকডাউন আপাতত ১৪ এপ্রিল অব্দি। পরে যে এটা আবার বাড়বে না,একথা কেউ বলতে পারবেন না। ১৪ এপ্রিল, ১বৈশাখ, দেশের নানা জায়গায় উৎসব হয়, সরকার কি সেদিনই মুক্তির ঘোষণা করবেন! মনে হয় না। যাই হোক, মনে মনে মেনে নিতেই হবে, ‘চাচা আপন প্রাণ বলে কতা’!
আজ তো সবে মার্চের ২৮, এখনো অনেক পথ।
ধৈর্য ধৈর্য ধৈর্য! আমরা পারবো তো! আমরা কি পারছি সবখানে! পারছি না।হেরে যাচ্ছি অনেক জায়গাতেই। টিভিতে আজ দিল্লির অবস্থা দেখে পাতি পাব্লিকরা সব বাকহারা।লকডাউনের পর দিল্লিতে একসঙ্গে এত মানুষ এসে ভিড় জমালেন বাস ধরে উত্তর প্রদেশ ফিরে যাবেন বলে! কাজ হারানো এইসব মানুষ বাড়ি ফিরে কী কৈফিয়ত দেবেন তাদের পরিবারকে কে জানে! আচ্ছা, লকডাউন উঠে গেলে এই মানুষগুলি তাদের কাজ,তাদের রুজিরোজগার আবার ফিরে পাবেন তো?আন্তর্জাতিক অর্থ ভাণ্ডার (আই এম এফ) বিশ্বে এক ভয়ংকর অর্থনৈতিক বিপদের সংকেত দিয়ে রেখেছেন। আর্থিক মন্দা তো ভারতে এসে গেছে কবেই!এজদিকে জিডিপির পতন অপরদিকে শেয়ারবাজারে সেনসেক্সের উত্থানের রহস্য উন্মোচনের জন্য তো আর ব্যোমকেশ বা ফেলুদা হতে হয় না!
পাতি পাতি সব পাব্লিক আজকাল আর কোনো কিছুতেই আতঙ্কিত হচ্ছে না। ‘দিল্লি বহুত দূর ভাইয়া, তুম একবার ঘুমকে তো আও হামারা রাজাবাজার! ‘
কী বলবেন, সুইসাইডাল?
(চলবে)
(তাং ২৮ /০৩ / ২০২০, রাত ১১-৪০)