স্মৃতিচারণায় শুভ্রশীল চট্টোপাধ্যায় 

পারিবারিক শ্যামাপূজা

আমার একটা রঙ রাখার জীর্ন,ভঙ্গুর প্রায় বাক্স আছে , বেশ পুরোনো , বয়স প্রায় পঁয়তাল্লিশ। আর আছে একটা বিবর্ন ক‍্যানভাস – অযত্নেই রেখেছি তাদের বা যতনে রাখার মত ইচ্ছের ফল্গুধারা উন্মুক্ত হয়নি তাই । সেই ভাঙাচোরা রঙ বাক্সের মধ্যে অনেক রঙ আছে – কি চিত্তগ্রাহী উজ্জ্বল আভা , কি অপরূপ  মনে রঙ লাগানো তাদের বর্ণ ; আর নাম ? কর্ণকুহরে প্রবেশ করলে- স্বর্গের দেবীর নূপুরের রিনিঝিনি , রিনিঝিনি শোনা যায়। একটার নাম ধূসর,কোনোটা ছায়া ধূসর,কোনোটা ঈষৎ ধূসর কোনোটা বা বিষাদ ধূসর। আমি অতীব প্রিয়তমার মত তাদের আঁকড়ে ধরে নিথর রাত্রি জাগি , আবেদনময়ী সেই রাত গুলোর এত আনন্দঘন উপস্হিতি-কখন যে অবসান হয়ে সন্ন‍্যাসী ভোরে ধ‍্যানস্হ হয় ,ধরার মাঝে অধরাই রয়ে যায়। আমি নূতন উদ‍্যোমে দিনের প্রতিটি প্রহর সেই বর্নময় রঙ গুলি কে নাড়ানাড়ি করি , সাজায় এলোমেলো , রাতের প্রতীক্ষায় জাগি দিন – ধোঁয়া ধোঁয়া ছায়ার মতো প্রিয়তমাকে ছোঁয়ার অনাবিল সেই স্পর্শের আবেশের আশায় ।
 আর সেই বিবর্ণ ক‍্যানভাস ! সেই বিবর্ণ ক‍্যানভাস বড়ই শীর্ন , ব‍্যবহারে স্বল্পতা অথচ আজীবন বার্ধক্যের অমলিন পেলবতা , এতো মেদুর পেলব যে রঙ  ধরেনা , যত সখ‍্যতা , প্রগাঢ় প্রণয় ,গহন আকর্ষণ- সবই ওই বিষাদ-ধূসরের সাথেই , কারুকেই চেনেনা , জানার ইচ্ছেও মৃত্যুর আলিঙ্গনে নীল , বোঝার বাসনা হতাশার অতলান্তিকে নিমজ্জিত – যেন এক সাগর গভীরে ডুবে যাওয়া ধ্বংসপ্রাপ্ত দূর্গের ক্ষয়ে আসা অনিন্দ‍্যসুন্দর তোরণ বিশেষ , স্বাগত আড়ম্বরের উচ্ছ্বাস , উন্মাদনার আবেশে জড়িয়ে , বিদায়-বিষাদের  গ্লানি , ভার সর্বাঙ্গে মেখে  আজ ও জেগে আছে । জীবন্ত অথচ মৃত। কিন্তু সেই বিবর্ন ক‍্যানভাসেও রঙ লেগে যায় , সবুজ রঙ , কাঁচা সবুজ । ইচ্ছের বিরুদ্ধে , সাময়িক হলেও রাঙিয়ে দিয়ে যায় , অল্প হলেও রঙের ছিটে লাগে – হেমন্ত  এলে । যেভাবে কোনো এক  সময়ের হৈমন্তী বিকেলের ক্ষনিক গোধূলিতে দেখা হওয়া বিশেষ এক বন্ধুর এক বুক অকৃত্তিম ভালোবাসা গ্রহণ করে ; ভরসা উজাড় করে – একসাথে পথচলার অঙ্গীকারের শপথ গ্রহণ করে স্বপ্নালু আবেশে ডুবে শ্রান্ত হলে পর – রঙ লাগে , বৈশাখী সাঁঝের নীরব আধাঁরে কালবৈশাখীর অকস্মাৎ ঝড়ে বিসর্জিত হয়ে , বঞ্চনার স্রোতের টানে জীবন্ত মৃত্যুর ভয়াল ঘূর্নিপাকে আজীবন আবদ্ধ হবে জেনেও আমরণ বন্ধুত্বের অন্তহীন শুভকামনায় ধ‍্যানমগ্ন হয় , অসম্মানের ক্লেদাক্ত গ্লানি ত্বকের ত্রিস্তর পেরিয়ে হাড় মজ্জা রক্তরসে সোহাগ মাখিয়ে অস্তিত্বের বিপন্নতায় নিমজ্জিত হবে জেনেও – তবুও তো ক্ষণকালের জন্য হলেও লাগে রঙ , রঙ লেগে যায়  কিন্ত্ত লাগে তো – যখন হেমন্ত এসে চৌকাঠে দাঁড়ায়। নরম হিম ঝরা পিচ রাস্তার বুক চিরে দুচাকার একঘেয়ে ঘূর্ণনের আওয়াজ ছাপিয়ে ডাঁসা শাল গাছের ভরাট শরীর রসস্থ তন্বীর মত হাতছানি দিয়ে ডেকে , লজ্জার অবগুন্ঠন ছুঁড়ে ফেলে গোপন অভিসারের প্রণয়বানী সদর্পে সর্বসর্ম্মুখে উন্মোচন করে – যখন ই হেমন্ত এসে শরীর ছুঁয়ে যায় । উদাসীন উপবাসের মায়া ত‍্যাগ করে প্রতিজ্ঞার উপবাসে কঠোর সংকল্পে  ডুবে নিজেকে নিবেদনের ইচ্ছা জাগ্রত হয় শুধুমাত্র ব‍্যাখ‍্যাহীন মহাশক্তির কাছে গৃহীত হবার বাসনায় , প্রতিটি অনুক্ষণ তার ই মুখাবয়বের দিকে তাকিয়ে অদম্য উৎসাহে সজাগ উদ্বেগে অপেক্ষারত -ঐতিহ‍্যবাহী প্রাচীন প্রথার নির্বিঘ্ন সমাপনের ঐকান্তিক কামনায় ; জেগে থাকার অদম‍্য বাসনায় নিশি হয়ে আসে ভোর। হাড়িকাঠ সমূলে উৎপাটিত হয় ধরিত্রীর গর্ভ হতে , হাতে রক্তের দাগ শুকিয়ে জমাট – মিলিয়ে যায়, তবুও আবছা হয়ে বেঁচে থাকে স্মৃতির উজ্জল ছেঁড়া খাতায় , যখন হেমন্ত আসে , এসে চিরে দিয়ে যায় বুক – রঙ লেগে যায় , হোক না জমাট বাঁধা রক্তের মতো কালচে নীল –  লাগে তো । কাটা ধান মাঠেই বাঁধা , মরামের ধুলো পথ বেয়ে তাকেই আনতে যাওয়া বা তাকেই ভাসিয়ে আসা । কত ছোটো স্মৃতি ! কত ক্ষুদ্র আশা ! যাদেরকে জড়িয়ে সেসব , শৈশব ; তাদেরই সাথে তর্ক বিতর্ক , যত কথকতা। বয়ে যায় সময় , থেমে যায় মন ,বয়স যায় পিছিয়ে।ভেসে ওঠে ছায়া ছায়া ছবি – অগ্রজদের সেই অনুশাসনের চোখ , চোখের তারায় বেনিয়মের প্রচ্ছন্ন প্রশ্রয়ের ইঙ্গিত কালের গর্ভে গেছে হারিয়ে , তবুও সে আবেশের ভাঙে ঘুম – বহমান – আমাদের ইশারায় সঞ্চারিত হয়ে গড়িয়ে পড়ে – অনূজরা গেয়ে ওঠে বাঁধন ছেঁড়ার গান।  অকাজের ভিড়ে কাজের অবিরাম অসহনীয় ভার বিস্মৃতির অতলে যায় ডুবে , শরীর আর শরীরের ক্ষিদে যায় মরে , নিয়ে যায় বয়ে , বয়ে যায় সেই শব – মননের  গোপন কুঠরিতে জমাট বাঁধা অভিলাষে সজ্জিত খাটে চেপে – জেগে ওঠে হৃদয় , যখন ই হেমন্ত এসে কড়া নাড়ে , অন্তরের অন্দরে প্রবেশ করে। কুয়াশা মাখা তৃপ্ত ক্ষনিক দুপুর গিলে খায় – অকস্মাৎ নেমে আসা হেমন্তের আদুরী বিকেল , চুঁইয়ে নামে সমূদবাঁধের কালো জলে , ক্ষনিকের গোধূলি চিরন্তন অভিমান ছিটিয়ে দিয়ে যায় , মৃত্যুর আলিঙ্গনে যায় নির্বাসনে , আকাশটাকে রাঙিয়ে – রেখে যায় ছাপ, দিয়ে যায় দাগ , ক্ষণস্থায়ী সেই দাগ যায় মুছে , কিন্তু যায় কি মুছে ? যায় কি মোছা একেবারেই ? সে থেকেই যায় , চালসে চোখে বর্ন  র মতো জলের দাগ হয়ে , নয়নের কোল ঘেঁসে আদরে জড়িয়ে। যখন হেমন্ত এসে হেমন্তেই হয় নিথর । শিকারির দৃষ্টি সজাগ , শিকারের প্রতীক্ষায় শকুনের মত চোখ মেলে ফাৎনার ওপর , উষ্ণতার পারদ চড়তেই থাকে , স্নায়বিক উত্তেজনায় পড়েনা চোখের পাতা , টান টান শরীর , যেন প্রথম দেখা তরুণীর নিস্পাপ ডাগর শরীর পবিত্র রহস‍্যের অপার বিস্ময় উন্মোচনে  বিবশ করে , বিহ্বলতা নিয়ে থমকে আছে স্পর্শ পাবার কামনায়। ঘন বর্ষার আকাশের মত আঁধার গড়িয়ে এলেও , বুক চিরে ভেসে যাওয়া বকের মত জেগে থাকে তবু  , পুকুরের ঈষৎ শীতল জলে – কখন শিকার এসে দিয়ে টান , নিয়ে যাবে ডুবিয়ে নিস্তরঙ্গ জলের ভিতর , নিস্তব্ধতা ভেঙ্গে আচম্বিতে ।
সময় পেরিয়ে গেলে,
প্রয়োজনে কাছে টানা,
দরকারি সবকিছু
সবাই তো ছুঁড়ে ফেলে
কেউ কেউ সযতনে
সে সময় মনে রেখে
আলগোছে কুলুঙ্গিতে
তবু ও তো তুলে রাখে
আকুলতা মাখা লেখা চিঠি
পেয়ে কোনো এক হৈমন্তী বিকেলে ।
পালা বদলের সময় যায় এসে জীবনের অমোঘ নিয়মে, শেষ অব্দি ভেঙ্গেই যায়,যায় না রাখা আটকে।শিমুল তুলোর লেপের মত আলতো সোহাগে জড়িয়ে মানস পটে জেগে থাকে তবু সেই ছোট্টো ঘর ,সেই সরু তক্তপোশ ,খাবার ঘরের খুনশুটি। স্নানঘরের জলের ধারার তোড়ের সুরেলা ক্ষনিক তীব্র শব্দ বিরামহীন মূর্ছনায় গান হয়ে যায় মিশে রক্তে। পালা যায় পাল্টে, এক ই রঙ্গমঞ্চে মঞ্চস্থ হয় জীবনের নবযাত্রা  ,শুধু পরিবর্তিত হয় কূশীলব -সেই ঘরে, সেই সরু তক্তপোশে – অবসন্ন হেমন্ত  শেষে হেমন্তের জাগরণে। জীবন কি অবর্ননীয় বর্নময়,অসহনীয় দূর্ভীক্ষের কি অপরূপ  নগ্ন মাধূর্য তার – ফুসফুসে যে গরম শলাকা ফুটে যায়। যে ঘর ,যে তক্তপোশ হতে ফেলে দেওয়া হয় প্রিয়জনের দেহ – মৃত্যু হলে পর, সেখানেই রচিত হয় মাসের পর মাস মধুমাস,সে কি দিতে পারে বাধা?বাধো বাধো লাগে, তাইতো সয়েই যায় অবিরত ব‍্যাথা। সে তো জানে শুধুমাত্র ব‍্যবহৃত হতে।যেভাবে ফুল বোঝেনা তার মাপ,তার অধিকার,ছড়াবে কোথায় সুবাস – শেষ শয‍্যায়,না ফুলশয্যায়?  বিদায় বেলার মিলন অধরা রেখেই অন্ধকারের যাত্রা হয় শুরু , দু চাকার অন্তহীন ঘসটানির আওয়াজ রনক্লান্ত করে , অবসন্ন প্রানে শালপাতার ফিসফিসানি কূহকিনীর আহ্বান বলে মনে হয় না আর। স্বাদ সব বিষাদের বিস্বাদে ভরে ওঠে। আবার আমি সেই রঙ বাক্সের অল্পজমে ওঠা ধূলোর আস্তরন  – নববধূর ঘোমটার মত অনাবৃত করে বেদনার শর্পিল পথ ধরে মৃত্যুর হাত ছূঁতে চেয়ে  – ছুঁতে হবে বলে ছূঁতে চেয়ে জীবনের ক্লেদাক্ত শিলারথ টানতে থাকি , টানতেই থাকি। বর্নময় ধূসরের নাড়াচাড়া , নাড়াচাড়া – নাড়িছেঁড়া ধনের মত , আমি বড়ই ভালোবাসি , প্রিয়তমাষুর ন‍্যায় আকার করে আঁকড়ে ধরে  তমসাঘন অমাবস্যার গোপন গভীরে ক্রমশঃ নিমজ্জিত হতে থাকি হেমন্তের অবসানে – হেমন্তের ই আগমনের আশায় ; কোজাগরী র মেদূরতায় মাখামাখি করে ভেসে উঠে হেম এর আকাশে বসন্তের এক বুক বাতাস নেবার উচ্চাশায় ,পরের বার শ‍্যামা আসার উদগ্রীবতায়।
ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।