• Uncategorized
  • 0

দৈনিক ধারাবাহিক উপন্যাসে মৃদুল শ্রীমানী (পর্ব – ৬১)

পর্ব – ৬

৬০

মিস শ‍্যামলী পাল, আপনার এই কারখানার তথাকথিত হেডমিস্ত্রিকে আপনি কোনো অ্যাপয়েন্টমেন্ট লেটার দিয়েছিলেন?
বিপক্ষ উকিলের কণ্ঠে প্রশ্ন করেন অনসূয়া চ‍্যাটার্জি।
না। উনি অনেক দিন ধরে কাজ করছেন। আগে গ্রাম থেকে গাড়ির বডি সাফসুতরো করার কাজ করতেন। পরে অন‍্যের দেখে দেখে নাটবল্টু খুলে পার্টস আলগা করে তেলে ধুতেন। বাবার শরীর খারাপ হয়ে যেতে উনি ক‍্যাশ আর পার্টস এর স্টক সামলাতেন। শ‍্যামলীর গলায় প্রায় আত্মসমর্পণের সুর।
আমার প্রশ্নের টু দি পয়েন্ট উত্তর দিন মিস পাল। সহজ সরল প্রশ্ন আমার। মিস্ত্রিকে ক‍্যাশ আর স্টক সামলানোর জন‍্য কোনো অ্যাপয়েন্টমেন্ট লেটার দিয়েছিলেন?
 আপনি প্লিজ হ‍্যাঁ বা না বলবেন।
শ‍্যামলী বলল, না ও কাজটা করতে পারত। খুশি মনে কাজ করত।
আমি হ‍্যাঁ বা না জানতে চেয়েছিলাম।
অনসূয়ার গলাটা বেশ কড়া শোনায়।
শ‍্যামলী বলল, এই লাইনে কেউ কোনো ইন্টারভিউ দিয়ে চাকরি পায় না। অ্যাপয়েন্টমেন্ট লেটার কেউ চায় না। দেবার প্র‍্যাকটিশ নেই।
পায়চারি করতে করতে অনসূয়া বলেন, মিস পাল, আপনার কারখানার এই তথাকথিত হেডমিস্ত্রির শিক্ষাগত যোগ্যতা কি আপনি বলতে পারেন?
শিক্ষাগত যোগ্যতা দিয়ে তো উনি কাজ পান নি। বাবার পাশাপাশি গ্রামের লোক। খেতে পেত না বলে বাবার কাছে এসে দাঁড়িয়ে ছিল। বাবা ফেরান নি। আমাদের বাড়িতে থাকত খেতে পেত। গাড়ি সাফাইয়ের কাজ করত।
আপনি থামুন! উল্টাপাল্টা বকেই চলেছেন। আপনি আদালতে দাঁড়িয়ে আছেন। পথসভায় মাইক ফুঁকছেন না।
শ‍্যামলী হঠাৎ অস্থির হয়ে তাকায়।
অনসূয়া হেসে উঠে বললেন, খুব খারাপ লাগছে না রে?
বয়স্কা কাজের মেয়েটি এসে দাঁড়ায়। দিদি, তুমি গা ধোবে না? গা ধুয়ে কাপড় ছাড়ো।
অনসূয়া ধমকে উঠে বললেন, দেখছ, কাজ করছি।
মহিলা বলল, তা তুমিই পরে বলবে, আমায় কাপড় ছাড়ার কথা মনে করিয়ে দিলে না। গা ধুতে বললে না।
অনসূয়া বললেন, দিদি, দ‍্যাখো, তোমাকে অনেক দিন বলেছি, কাপড় বদলানো বলবে। কাপড় ছাড়া বলবে না। শুনতে খারাপ লাগে।
গজগজ করতে করতে মহিলা চলে যায়। তার পরেই ঢোকে রান্নার লোক। বলে, দিদি, আজও কি রাতে দুধ রুটি খাবে?
অনসূয়া বিরক্ত স্বরে বললেন, না, আজ আমি মুর্গমুসল্লম, চিকেন দো পেঁয়াজা আর কাটলেট খাব!
রাঁধুনি মেয়েটি ঘাবড়ে গিয়ে বলল, ওসব কি জিনিস আমি জানি নি বাপু।
অনসূয়া শান্ত হয়ে বললেন, তোমরা এখন যাও। আমি এখন জরুরি কাজ করছি।
তাহলে, মিস পাল, আপনি একটা ক্লাস ফোরে পড়তে পড়তে পড়া ছেড়ে দেওয়া, মানে প্রাথমিক বিদ্যালয়ের গণ্ডি না টপকানো একটা লোককে টাকা পয়সার হিসাব রাখার দায়িত্ব দিয়ে সে অঙ্ক পারে না বলে, শাস্তি দিয়েছেন।
শ‍্যামলী অবাক হয়ে বলল, সে তো ওই কাজটা বেশ কিছুদিন ধরে করছিল।
মিস পাল, আপনার কারখানায় পুরুষ ও মহিলার আলাদা আলাদা বাথরুম আছে?
আমাদের কারখানায় মহিলা শ্রমিক নেই। শ‍্যামলী উসখুস করছে। এই স‌ওয়াল জবাবের খেলাটা শেষ হলে সে বাঁচে।
আমি প্রশ্ন করেছি, পৃথক শৌচাগার আছে না নেই। টু দি পয়েন্ট কথা বলুন মিস পাল।
না । নেই। শ‍্যামলী একটু মনমরা।
শুনেছি, আপনার কারখানায় একটি শিশুকে দিয়ে কাজ করানো হয়?
শ‍্যামলী চমকে উঠল।
দিদি, একথা আপনি কি করে জানলেন?
মিস পাল, আপনি আদালতে দাঁড়িয়ে আছেন। বলুন আপনি, কোনো বাচ্চা ছেলে আপনার কারখানায় কাজ করে কি না।
কাজ সেভাবে করে না। ভারি কাজ, বিপজ্জনক কাজ ও করে না। ফাই ফরমাশ খাটে। শ‍্যামলী যেন কোণঠাসা হয়ে পড়েছে।
তাহলে আপনার পাল অটোমোবাইল এ শিশু শ্রমিক আছে। তাইতো।
শ‍্যামলী ঘাড় নিচু করে মাথা নাড়ে।
মিস শ‍্যামলী পাল, আপনার কারখানায় শ্রমিকদের বিপদ আপদ রোগ ব‍্যাধি মোকাবেলায় কোনো ইনশিওরেন্স এর ব‍্যবস্থা আছে?
শ‍্যামলী মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে থাকে।
অনসূয়া চ‍্যাটার্জি বিপক্ষের উকিল সেজে বলেন, তাহলে মিস শ‍্যামলী পাল, আপনি কলেজে ভাল ছাত্রী, মাধ‍্যমিক উচ্চ মাধ‍্যমিকে এই জেলার মুখ উজ্জ্বল করা ছাত্রী , আপনার নিজের পরিচালিত কারখানায় শ্রমিকদের সুরক্ষা নিয়ে কিছু মাত্র সচেতন নন। অথচ আপনি বিতর্ক সভায় রম‍্যাঁ রলাঁ, বার্ট্রান্ড রাসেল, বার্নার্ড শ এইসব মহান ব‍্যক্তিত্বের বাণী আউড়ে হাততালি পেতে লজ্জা বোধ করেন না। আপনি নিজেকে স্বৈরতন্ত্রের বিরুদ্ধে বলে প্রচার করেন, অথচ নিজের কারখানার চৌহদ্দির মধ‍্যে আপনি একজন পাক্কা সাম্রাজ্যবাদী।
ইতিহাস আপনাকে আস্তাকুঁড়ে ছুঁড়ে ফেলবে!
শ‍্যামলী আর পারে না। মাটিতে বসে পড়ে দুই হাতে মুখ ঢেকে কেঁদে ফেলে।

ক্রমশ…

ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।