পর্ব – ৫০
১৪৯
বোনাসের টাকাটা কারখানার মজুরদের নিজের হাতে বিলিবণ্টন করে দিতে পেরে নিজেকে বেশ ঝাড়া হাত পা লাগছিল শ্যামলীর। এমন সময়ে হেডমিস্ত্রি বলল, হিসাব গুছিয়ে ফেলেছি।
এবার স্টক মেলান।
এবার লোকটি ধরা ধরা গলায় বলল, ছোড়দি, সবাই পয়সা নিয়ে কেনাকাটা করতে বাড়ি চলে গেল, আর আপনি শুধু আমায় আটকে রেখেছেন।
আপনি ভুল করছেন। আমি আপনাকে আটকাই নি। আপনাকে আটকে দিয়েছে আপনার দায়িত্ববোধের অভাব। আমাদের কারবার তো ডুবিয়ে দেওয়া হয়েছিল। তাই থেকে কত কষ্ট করে আবার গড়ে তুলতে হচ্ছে। আপনার হিসাব আপনি মেটান আগে।
শেষে দেখা গেল দুটি গাড়ির সারানোর পয়সা ক্যাশে জমা পড়ে নি। সে বাবদে কয়েকটি পার্টস ও গিয়েছে।
এবার লোকটি কেঁদে ফেলল। গাড়ি সারিয়ে পরে পয়সা দেব বলে যদি চলে যায়, তাহলে আমি কী করব?
শ্যামলী শক্ত গলায় বলল, যা হয়েছে লিখে দিতে হবে।
লোকটি বলল, কালকে আমি ওদের বাড়ি থেকে মেগে আনব।
সেই কথা শুনে শ্যামলী চিৎকার করে উঠল, শাট আপ! আমাদের পাল অটোর লোক হয়ে আপনি কাজ করে দেবার পর ভিক্ষা চাইতে যাবেন?
শ্যামলীর চিৎকার শুনে যে দু একটা শ্রমিক তখনো একটু আধটু কাজ করছিল, এসে দাঁড়িয়ে গেল।
শ্যামলী জোরালো গলায় বলল, শুনুন, খুব ভাল করে শুনে রাখুন, আমি কাউকে ঠকাই না, কিন্তু কেউ আমায় ঠকাবে, সেও আমি সহ্য করব না। আপনি লিখে দিন, ক্যাশ ছেড়ে পার্টসের দেরাজ আলগা রেখে আপনি বাইরে চলে গিয়েছিলেন, সেই সময় এইসব হয়েছে।
দিদি, সব অপরাধ আমার। আপনি আমার মাইনে থেকে কেটে নেবেন।
শ্যামলী ধমকে উঠল। একটাও কথা নয়। যা বলছি, আগে লিখে দিন। আপনার মাইনের প্রশ্ন অনেক পরে।
আমি ও কথা লিখে দোষ স্বীকার করলে আমায় বাড়ি যেতে দেবেন তো?
শ্যামলী অস্বাভাবিক শান্ত গলায় বলল, হ্যাঁ দেব।
শ্যামলী হেডমিস্ত্রিকে দিয়ে লিখিয়ে নিল যে, সে কাজের সময়ের মধ্যে কাউকে কিছু না বলে বাইরে চলে গিয়েছিল, আর সে সময় তহবিল তছরূপ হয়েছে।
এবার উদার গলায় শ্যামলী বলল বোনাসের হাফ টাকা নিয়ে যান, কাল টাকার হিসাব বুঝিয়ে দিলে বাকি টাকাটা দেব।
আলমারি খুলে হেডমিস্ত্রির লেখা মুচলেকা টা যত্ন করে গুছিয়ে রাখে শ্যামলী।
হেডমিস্ত্রি বলে আমাকে আপনি কাজ থেকে তাড়িয়ে দেবেন, না?
কেন, বীরুবাবুর কাছে যাবার সময় সে কথা মনে আসে নি?
আমি বীরুস্যারের কাছে নিজের ইচ্ছায় যাই নি। আমায় লোক পাঠিয়ে ডেকে নিয়ে গিয়েছিল।
শ্যামলী বলল, তো সে কথাটা আগে ভাঙতে কি হয়েছিল? আমি কি বুঝিনি, বীরুবাবু ছাড়া আর কারো কাছ গেলে এত গোপনীয়তার কোনো কারণ থাকত না!
তারপর বলল, নিন, বোনাসের টাকাটা আপনি নিয়ে যান।
না দিদি, আমি নিজেকে নির্দোষ প্রমাণ করে তবে টাকা নেব।
সে তো খুবই ভালো কথা। কিন্তু সে লোকটা কি বলছিল?
আপনার বাবার গুরুদেবের টাকা দরকার। সেই জন্যে আপনি যদি কারবার থেকে কিছু দেন।
তা ভাল কথা। গুরুদেব তিনি বাবার। তা বাবার কাছে না গিয়ে বাবার চাকর বাকরের কাছে হাত পাতা কেন?
ছোড়দি, আমাকে আপনার বাবা কিন্তু চাকরবাকর মনে করতেন না। আপনার কথায় খুব দুঃখ পেলাম।
এই যে শুনুন, আপনি পাল অটোয় চাকরি করেন। চাকরি। চাকরি কথাটার মধ্যে “চাকর” কথাটা বেশিরভাগ জায়গা দখল করে আছে। এখানে আপনি পরামর্শদাতা বা উপদেষ্টা হয়ে আসেননি।
লোকটি ঘাড় নিচু করে কপালে হাত দিয়ে বসে থাকে। শ্যামলী বলল, বোনাসের হাফ টাকা নিয়ে যান। আগামী কালের মধ্যে হিসাব বরাবর করতে পারলে বাকি টাকা পাবেন।
তবু লোকটি কিছু বলে না।
শ্যামলী ধমক দিয়ে বলে, এই যে শুনুন, আমি একটা কলেজ ছাত্রী। কাল ক্লাস আছে। ক্লাসের জন্য আমাকে তৈরি হতে হয়। সারাক্ষণ এখানে বসে সময় নষ্ট আমার করার কথা নয়। বোনাসের হাফ টাকা নিয়ে না গেলে বিপদে পড়বেন।
লোকটি অর্ধেক বোনাস বুঝে পেয়েছে বলে লিখে দেয়।
তার পর শ্যামলী ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দ্যাখে রাত নয়টা বেজেছে। কারখানা বন্ধ করে বাড়ি যাবার আগে অনসূয়া চ্যাটার্জিকে ফোন করে। দিদি, আগামীকাল কোর্টে আপনার সঙ্গে একটু দেখা করব।
বাড়িতে ফিরে এসে শ্যামলী দেখল, জামাইবাবুর গাড়ি গেটের সামনে দাঁড়িয়ে আছে।
মুখে চোখে জল দিতে দিতেই শ্যামলীর ডাক পড়ল।
কি ব্যাপার বলো তো, তোমার জন্য হাপিত্যেশ করে বসে আছি, আর তোমার দর্শন মেলেনা।
অরুণদা, বাড়িতে তো আর সবাই আছে। আমার মতো অতি সাধারণ একটা মেয়ের জন্য আপনার এ অহৈতুকী করুণা।
তা তুমি এত দেরি করলে কেন বলোতো?
কারবারের অনেক কাজ ছিল অরুণদা। নিজের হাতে হিসাব না মেলালে বড্ডো চুরি চামারি এ লাইনে।
শশাঙ্ক পাল এসে ঢুকলেন।
বললেন, কি ব্যাপার বলতো মা! এতখানি দেরি করলি। একটা ফোনও তো করিসনা।
হাসিমাখা মুখে শ্যামলী বলল, আজ তোমার কারখানায় বোনাস পেমেন্ট সেরে ফেললাম বাবা। সেই কাজের উপর আরো ছুটকো ছাটকা ঝামেলা।
অরুণ বললেন, হ্যাঁ, আমিও খবর পেয়েছি, তুমি আজ বোনাস দিয়েছ। খুব ভাল। মজুররা বেশ খুশি তো?
কানে হাত দিয়ে জিভ কেটে শ্যামলী বলে, আমি বোনাস দেবার কে? বোনাস দিয়েছেন পাল অটোর মালিক, আমাদের বাবা। আমি তাঁর পেটভাতায় খাটা মজুর মাত্র।
শ্যামলীর কথাটা শুনে শশাঙ্ক পাল মাথা নিচু করে বসে থাকেন।
সবিতা পিসি ঝামরে ওঠেন, নিজের বাবার কারবার থাকলে, দায়ে বিপদে দেখাশুনা করতে হয়। তার জন্যে নিজেকে পেটভাতায় মজুর বলা ঠিক না।
শ্যামলী বলল, জানো পিসি ডাক্তারের কাছে আমাশার রুগী পেট কেমন আছে, পায়খানা কতটা হয়, বলতে লজ্জা পায় না, বরং কতক্ষণে বলবে, তার জন্যে আঁকপাক করে। কিন্তু স্টেজে গান গাইতে উঠে সে সব বলে না। অরুণদা ব্যাঙ্কের কর্মকর্তা । আমার এখনকার স্ট্যাটাসটা অরুণদাকে নিখুঁত ভাবে বলা দরকার। আজ আরো একজনকে ওই একই কথা অনেক সময় ধরে বুঝিয়ে দিতে চেয়ে ফেল মেরেছি।
অরুণ বললেন, ওইজন্যেই আমি এসেছি শ্যামলী। ওই আরো একজনকে তুমি এভাবে অপমান করেছ যে, তুমি ক্ষমা না চাইলে সে আর এ বাড়িতে ঢুকবে না বলেছে।
শ্যামলী বলল, তা সে তো ভাল খবর, রোজ নিজের বাবার বাড়ির ডাল ভাত খেতে খেতে মুখে অরুচি ধরেছে। এখন দিদির আদর খাক কদিন। তারপর ঠিক ফিরে আসবে। এখানে না ফিরলে মায়ের থেকে দু ভাই রোজ দশটা করে টাকা হাতখরচ আদায় করবে কিভাবে? দিদির কাছে রোজ রোজ হাতখরচ চাওয়া শক্ত।
ক্রমশ…