এখনো বসন্ত আসে ।পলাশের গৈরিক আভায় মন ভারী উদাস হয় ।শিমূলের উজ্জ্বল রক্তিমাভায় লুকিয়ে রাখা ইচ্ছে নদীতে জোয়ার আসে ।প্রকৃতিনারীর ঋতুপরিবর্তন তাঁর স্ব ইচ্ছা সাধিত ।কিন্তু নারী প্রকৃতির ঋতু পরিবর্তিত হয় সংসারের পাকচক্রে । আমার যেমন বেণী তেমনি রবে জলে ভিজাবো না ,এ বলবার বুকের পাটা কটা মেয়ের থাকে ! যাপনের ঝড়েজলে ভেজে তাঁর সত্বা ,তাঁর ইচ্ছে অনিচ্ছে , মায় ব্যক্তিত্বটিও ।
মেয়ে সে যতই শিক্ষিত বা দীক্ষিত হোক না কেন ,সংসারের চাবিকাঠিটি থাকবে তাঁরই হাতে ,এই বাজার চলতি ধারনা ।তেল নুন আলু চাল কিংবা রাঁধুনি ঠিকে বা আয়ার ছুটির হিসেব ,মাস মাইনে এসব ই বাড়ির মহিলামহলের জুরিসডিকশন ।কত্তামশাই এসবে নাক গলাবেন ?
নৈব নৈব চ !
অতএব স্কুল কলেজ বা অফিস ফেরতা তিনি কাউচে আধশোয়া হয়ে বিষ্ণুর একাদশাবতার রূপে অনন্তশয়ানে ।হাতে টিভির রিমোটখানি, সেন্টার টেবিলে চায়ের কাপ ,অ্যাস্ট্রেতে খান্ডবদাহের নমুনাসকল ।চোখ টিভির পর্দায় । ঘন্টাখানেক সঙ্গে সুমন বা বাহুবলী নতুবা আই পর এলের নীলামের মত মহান কর্তব্যে ব্যাপৃত ।অথচ গিন্নী ঐ একই রকম স্কুল কলেজ বা আপিস থেকে বাড়ি ফিরে রাঁধুনীকে রাতের ডিনারের ফিরিস্তি বুঝিয়ে ছেলে বা মেয়ের হোম ওয়ার্কে মনোনিবেশ করেন ।
এতসব কচকচির মধ্যে গিন্নীর যদি কিঞ্চিত মাথার ব্যামো অর্থাৎ কিনা লেখার বাতিক থাকে তবে তো কথাই নেই ।
প্রবল বসন্তদিনে যখন শব্দেরা আগল খুলে দাঁড়ায় তাদের মুখের ওপর কখনোসখনো দরজা বন্ধ করতে হয় কেজো সাংসারিক প্রয়োজনে ।কথা নিয়ে যাদের কারবার তারা খানিক হলেও সংবেদনশীল মানুষ হন । তবু কে ধারে ,তাদের সেই পেলব অনুভূতির ধার !
বরং কথার ধারে এবং ভারে জীবন কন্টকিত করাই বুঝিবা কাছের মানুষদের পূণ্যকর্তব্য হয়ে দাড়ায় ।
বুঝলে তো ,, ঘরের খেয়ে বনের মোষ তাড়ানো একেই বলে । এক পয়সা তো মুনাফা নেই ,চললেন ট্যাঁকের কড়ি খরচ করে সাহিত্য সভা করতে …কর্তা উবাচ ।
প্রতিটা ছুটির দিন ই যদি তুমি এভাবে বেরিয়ে যাও বৌমা , ছেলে মানুষ করবে কি ভাবে ! বুঝিনা বাপু আজকালের মেয়েদের রকমসকম ।কি না ,উনি কোবতে লিখে রবীন্দ্রনাথ হবেন ! আর আমার ছেলেটাও হয়েছে তেমন মেনীমুখো ! বৌকে কিভাবে তাঁবে রাখতে হয় ,কিছুই জানে নাকো ! মতামত টি মাননীয়া শাশুড়িমার ।
আরে সোমু ,তোর বৌ তো সারাক্ষণ ই ফেসবুকে কবিতা আর সাহিত্যসভার আপডেট দিচ্ছে ।বলি ,সংসার টংসার করে ,নাকি শুধুই হরিমটর ! পাড়ার ক্লাবে এই বন্ধুদের হাতে এহবিধ হেনস্হার পর স্বামীর হুহুংকারে পরবর্তী সাহিত্য সভাটি মাঠে মারা যেতে বাধ্য ।
ওদিকে সভার কর্তাব্যক্তিদের বিষনজর ! এর ভারী অ্যাটিটিউড তো ! ডাকলাম এলো না । একটু নাম করতে না করতেই পায়া ভারী হয়ে গেলো । বুঝলে তো ,,
সোমনাথদা ,পাখির ডানা ছাঁটতে হবে !
খাঁচার ভিতরে বন্দী পাখিটি ডানা ঝাপটায় নিস্ফল চেষ্টায় ।মনের দক্ষিণের বারান্দাটি বন্ধ করে দেওয়া হয় অন্তঃপুরের চিকের আড়ালে ।খিড়কী দুয়ার দিয়ে তবু অবুঝ শব্দের যাওয়া আসা ।চোরের মত সময় বাঁচিয়ে চুপিসারে লেখা আর পাঠিয়ে দেওয়া সম্পাদকের দপ্তরে ।তুমুল কাঁটাছেড়া তখন সেই নাড়ীছেঁড়া ধন থুড়ি লেখার । গভীরতা নেই ,নেহাত ই পানসে ,কোন চমক নেই ,ব্যঞ্জনার বড় ই অভাব ।
লেখাটি পাঠিয়ে উন্মুখ মেয়েটি অপেক্ষায় একটু স্বীকৃতির । নাহ, সবার ভাগ্যে সেই কাঙ্খিত সম্মান জোটেনা ।না পাওয়ার বোঝা ভারী হতে হতে একদিন আসে অবশ্যম্ভাবী উপসর্গ : ডিপ্রেসন ।
মনখারাপের ব্যালকনীতে বসে সেই মেয়ের শুধু কল্পউড়ান ।কখনো সমুদ্রের হাওয়ায় উড়ে যায় তাঁর নায়িকার মেঘরঙা চুল । বালুকাবেলায় সে ঘর গড়ে ,ঘর ভাঙে ।
পায়ের পাতা ছুঁয়ে ঢেউ এর শিরশিরানি ।
কখনো সে আবার দার্জিলিং পাহাড়ে । ক্যাভেন্টার্সের জানলায় পাইনের ছায়া ।
কফিকাপে আলতো ঠোঁটের ছোয়াছুয়ি ।
হাতে হাত ।অবাধ্য আঙুলে জলতরঙ্গ বাজে ।
কখনো দুচোখ বেয়ে নেমে আসে মেঘমল্লার ।
যত না পাওয়ারা শ্রাবণ আকাশে মেঘবতী হয় ।বৃষ্টিপায়ে পথ চলা কুর্চির গন্ধে উথালপাতাল হয়ে ।
মেয়েরা এভাবেই স্বপ্ন বুনে যায় ।ছড়িয়ে যায় স্বপ্নের বীজ । যদি কোন অবাধ্য কল্পবৃক্ষ শাখা মেলে দেয় নিষেধের বারান্দায় ।।