• Uncategorized
  • 0

কবিতায় অনির্বাণ মুখপাধ্যায়

অক্ষররহস্য

সে সব অক্ষরের দল অবদংশভোজী হতে পারে, কিন্তু তারা কখনওই মদ্যপায়ি নয়। তারা পানশালায় হাজিরা দেয় প্রতি সন্ধ্যায়, বসে, সামনে রাখে চাটের প্লেট আর গেলাস ভর্তি জল। সন্ধের পানশালায় গেলে দেখবে, তারা সবাই রয়েছে, স্বর ও ব্যঞ্জন বর্ণ, চন্দ্রবিন্দু, বিসর্গ, অনুস্বর— সকলেই। কিন্তু তাদের এলোমেলো বসে থাকা আর মদ না ছুঁয়ে চাট চাখায় কিছুই উৎপাদিত হচ্ছে না। কোনও বাক্য নয়, কোনও শব্দ নয়, পানশালার গুঞ্জন এক নির্বোধ ধ্বনিমাত্রায় শুধু পাক খাচ্ছে। সিগারেটের ধোঁয়ার সঙ্গে, পাঁড় মাতালের জড়িয়ে যাওয়া প্রলাপের টাউরির সঙ্গে, শীতাতপ যন্ত্রের কির কির আওয়াজের সঙ্গে তারা পাক খাচ্ছে আর পাক খাচ্ছে…

এ পর্যন্ত এক নিঃশ্বাসে বলে আচার্য্য হাঁপান। সদ্য উঠেছেন অসুখ থেকে। হাঁপান আর হাতে টেনে নেন জলের বোতল। সামনে প্লেটে রাখা দুটো মেরি বিস্কুট। ঘরের ঘোলাটে পাখার শব্দ, সকাল এগারোটার ঝকঝকে রোদের শব্দ, ঘুলঘুলির ভিতরে চড়াইছানার কণ্ঠে মৃদু কলতান… এটাই কি পানশালা? আর আচার্য্যদেবই কি সেই সব অবদংশভোজী অক্ষরের কোনও একজন? প্রশ্ন মনে আসতেই আচার্য প্রসঙ্গ পাল্টান।

হাইওয়ের উপরে উল্কাগতিতে ধাবমান চারশো সাত দেখেছো তো? তার কেরিয়ারের পিছনে লেখা ‘জয় মা তারা’ বাক্যটিকে কি খেয়াল করেছো? ‘হর্ন প্লিজ’, ‘মেরা ভারত মহান’, ‘ট্রাফিক রুল মেনে চলুন’ইত্যাদি বাখোয়াজির মাঝখানে ইংরেজিতে লেখা ‘তারা’শব্দটিকে দেখো। মনে হবে, জগৎশ্মশানে তিনি নৃত্য করছেন। জটাধারিণী, লোলস্তনী, বিকট-উদরা, ব্যাঘ্রচর্মচবিলাসিনী তারা। কল্পান্ত কল্পান্ত ব্যাপী সুরাপানে তাঁরা আলীঢ়-প্রত্যালীঢ়ে যেন বান ডেকেছে নৃত্যরসমাধুর্যের। তিনি নৃত্যপরা, কিন্তু নর্তিণী নন।

আচার্য্য দম নেন। কড়ি-বরগার দিকে তাকিয়ে ভাবতে থাকি ‘নর্তিণী’ শব্দটাকে। এ কি আদৌ অর্থবহ? এ যেন সেই পানশালার এক কোনার টেবিলে বসে থাকা গুটি চার-ছয় উচ্ছিন্ন অক্ষর। এরা আছে, অথচ এদের থাকার কোনও অর্থ নেই। এই আছে ও নেইয়ের খেলায় যে ভাপ ওঠে, যে গুঞ্জন টাউরি খেয়ে আবার টেবিলে নেমে আসে, তার সঙ্গে নর্তিণী নর্তিণী বলে খিল্লি দেয় রোদ। ঘুলঘুলির ভিতর থেকেও যেন ভেসে আসে নর্তিণী নর্তিণী ডাক। দূরে কোন পরিত্যক্ত শ্মশানভূমে যেন ভরদুপুরে বান ডেকেছে ফুর্তির। কারা যেন আপাদমাথা ঢাকা এক যুবতীশব নামিয়ে চলে গিয়েছে ধেনোমদ কিনতে, ডালের ঝালবড়া কিনতে। দুপুরের রোদে পাখসাট মারছে ধুলোর ঘুর্ণি। গত রাতের চিতার কাঠে তখন লেপ্টে রয়েছে ছাইমাখা আগুনের রেখা। ফট ফট শব্দ হচ্ছে কাঠ ফাটার। শীর্ণ চেহারার এক শ্মশানপুরুত মায়াছন্দে পাক দিচ্ছেন সেই নিবন্ত চিতাকে। মুষ্ঠি মুষ্ঠি ছাই তুলে বাতাসে ছুড়ে দিচ্ছেন আর বিড় বিড় করে আওড়াচ্ছেন মহাভয়ঙ্করীর স্তব, ধূম্রতারার বীজমন্ত্র, ত্রৈলোক্যগ্রাসনাত্মিকার সংকেতকূট। আর কিছূটা দূরে চির-অশ্রুত নাদধ্বনির মতো পড়ে রয়েছে সেই আপাদমস্তক ঢাকা শব।

ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।