• Uncategorized
  • 0

‘কফি পাহাড়ের রাজা’ সাপ্তাহিক ধারাবাহিক উপন্যাসে তুষ্টি ভট্টাচার্য (পর্ব – ১ ।। খন্ড – ৯)

কফি পাহাড়ের রাজা

প্রথম পর্ব:

৯)

   অটহাসিতে ফেটে পড়েছে মুরুগান। নুলপুট্টু নিয়ে ঘরে এসে বিদ্যা অবাক। ‘কী হল আবার! এত হাসির কী হল?’ ‘বুঝলি বিদ্যা, আজ শ্রীনির কথা মনে পড়ছিল। আমি সেদিন ট্রাকের ভেতর থেকে আসা ওর গলার স্বর ঠিক চিনে নিয়েছিলাম’। গম্ভীর মুখে বিদ্যা বলল, ‘তা আজ আবার ওসব নিয়ে পড়লে কেন শুনি!’ ‘রাগ করিস না! সেদিন হাসপাতালের সিনটা মনে পড়ে এত হাসি পাচ্ছে এখন……’ এই বলে আবার হেসে নিল মুরুগান। হাসি সামলে বলল, ‘ঠিক যেন কোন হিন্দি সিনেমার ক্লাইম্যাক্স! আমার জ্ঞান এলে দেখলাম, আমি হাসপাতালের বিছানায়। উঠে বসতে গিয়ে দেখলাম শরীরে অসহ্য যন্ত্রণা আর আমার একটা পা বাদ গেছে! সেই সময়ে পায়ে হাত দিয়ে ওই শূন্যতা অনুভব করার আকস্মিকতা আমাকে অবশ করে দিয়েছিল। অন্যান্য যন্ত্রণা অনুভব করার ক্ষমতাও চলে গেছিল। সেই হতভম্ব, করুণ মুখটা কল্পনায় দেখছি আর হাসি পাচ্ছে এখন। মুখের চেহারাটা যা হয়েছিল আমার……’ আবার হাসতে থাকল মুরুগান। এবার বেশ রাগি গলায় ধমকে উঠল বিদ্যা। ‘থামবে তুমি?’ মুরুগান চুপ করে খাওয়ায় মন দিল।
   ঘরের ভেতরে একটা চাপা গুমোট ভাব খেলা করছে আজ। দুজনেই যেন দুজনের থেকে মুখ লুকোচ্ছে। যে যার নিজের ভেতরে ডুব দিতে দিতে ভেসে উঠছে এক লহমায়, আবার যে কে সেই! বিদ্যা ভাবছিল ওর মরদের কথা। লোকটাকে বারান্দায় বসিয়ে দিয়ে এসেছিল ও, আর তাকিয়া পিঠে গুঁজে দিয়েছিল যাতে একটু আরাম পায় অন্তত। হাল্কা রোদপিঠ করে বসেছিল সে বিদ্যা যাওয়ার সময়ে। এইটুকুতেই তার মুখে তৃপ্তির ছোঁয়া লেগেছিল। চলে যাওয়ার সময়ে পিছন ঘুরে একবার দেখেছিল নিজের মরদকে…লোকটাও ওর যাওয়ার দিকে তাকিয়ে ছিল……সেই ছিল তাদের শেষ দেখা, কে জানত! বিদ্যা যখন ফিরেছিল, দেখল, কয়েকজন জটলা করছে ওখানে, লোকটার মুখ দিয়ে গ্যাঁজলা উঠছে, চোখ বেরিয়ে এসেছে আতঙ্কে। গোখরোয় কাটা লোক অনেক দেখেছে বিদ্যা। ওর পরিস্থিতি বুঝে নিতে দেরি হল না। ছুটে গিতে দেখে কপালে ছোবলের দাগ। বিষে নীল হয়ে এসেছে শরীর। নিঃশ্বাস নিতে পারছে না ভাল করে, বিদ্যা ডাকলেও শুনতে পেল না, মাথা ঢলে পড়ল বুকের ওপর। এখনও ভাবলে গায়ে কাঁটা দেয় বিদ্যার। চোখের সামনে সাক্ষাৎ মৃত্যুকে দেখে সেই লোকের কী অবস্থা হয়েছিল, ভাবতে বসলে থমকে যেতে হয়। ধীরে ধীরে এগিয়ে আসছে যম, কাছে এসে দুরন্ত হচ্ছে তার গতি। লোকটা পিছোতে পারছে না, নড়তে পারছে না একচুল। লাঠিটা মারতে গিয়ে লক্ষ্য ভ্রষ্ট হয়ে দূরে পড়ে আছে। ফলে লাঠি ধরে যে উঠে দাঁড়াবে, সেই শেষ উপায়ও আর নেই ওর। ভয়ে, আতঙ্কে, ত্রাসে ওর নিশ্চই কলিজাটা বুক ফুঁড়ে বেরিয়ে আসতে চাইছিল, চোখদুটোর ভয়াল বিস্ফারিত দৃষ্টি দেখে সেরকমই মনে হয়েছিল বিদ্যার। নাহ! এসব ভেবে কী লাভ! চর্বিতচর্বন শুধু। লোকটা বোধহয় মরে বেঁচে গেছে সেদিন। নইলে অমন এক শা জোয়ানের কী ওই অবস্থায় দিনের পর দিন বিছানায় পড়ে থাকতে হয়। বিদ্যা কী ভুলে গেছে ওর জোয়ান বেলার কথা?
   বিদ্যার সঙ্গে বিয়েটাও প্রায় দৈবাৎ ঘটে গেছিল ওর। কুপিল্লা রঙ্গনাথন পিল্লাই জন্মসূত্রে কন্নড়। যদিও কোরাবা টাক্‌ কুপিল্লার মাতৃভাষাই। দক্ষিণ কন্নড় থেকে কোন সময়ে ওদের আদিপুরুষ এই কোরাবায় এসে থাকতে শুরু করেছিল। কোরাবাদের সংস্কৃতিই এখন ওদের সবকিছু জুড়ে রয়েছে। কুপিল্লার মা অবশ্য ছিল খাঁটি কোরাবা। দক্ষিণ কোরাবা অঞ্চলকে এখানে ওরা বলে কিগগাত নাড়ু। আর এখানের ভাষাকে কিগগাত। আর উত্তরে ও মধ্য কোরাবার ভাষাকে বলে মেন্ডেলে। কুপিল্লার পরিবার ছিল জাতিতে ব্রাহ্মণ। পুজোপাঠই ছিল ওদের জীবিকা। বিদ্যার সঙ্গে কুপিল্লার দেখা হলেও হতে পারত কোন মন্দিরে বা পুজো আর্চার সময়ে। কিন্তু বিয়ে হওয়ার কথাই আসত না সাধারণ ভাবে। বিদ্যার তখন আর কতই বা বয়স! ১৭/১৮ হবে। পুট্টারি’র দিন সাতেক আগে থেকে যেমন সাজো সাজো রব পড়ে যায়, এবারেও ওরা কয়েকজন সখি মিলে খুব হইচই করছিল। নাচের তালিম নিচ্ছিল মন দিয়ে। এছাড়া খেতের আল, চারিদিকের রাস্তা সাজানো, আলো তৈরি, প্রদীপ বানানো…সে যে কত্ত কিছু কাজ তখন ওদের! আর ছিল অকারণ খিলখিল হাসিতে ভেঙে পড়া। খুশির ঢেউ উপছে পড়ত ওদের বুকে। সে একটা বয়স ছিল বটে! এখনকার এই পোড় খাওয়া বিদ্যাকে দেখলে সেই মেয়েটাকে আর মেলাতে পারবে না কেউ। এমনই হয় হয়ত অভিজ্ঞতার বোঝা মাথায় চাপলে। সে যাই হোক, পুট্টারির দিন ভোরবেলা ওরা স্নান সেরে, নতুন শাড়িতে সেজেগুজে রেডি হয়ে গেছিল। অঘ্রাণ মাসের প্রথম দিকে তখন বাতাসে একটা হাল্কা শিরশিরে ভাব এসেছে। গায়ে কাঁটা দিচ্ছিল বিদ্যার। তাড়াতাড়ি ওরা আইনে ঢুকে পড়ল। এই একটা সময়ে গ্রামের সকলে, সপরিবারে আইনে এসে জড় হয়। এ এক যৌথ বাড়ি বলা যেতে পারে। সেদিন যে কী আনন্দের দিন ওদের, সবাই মিলে একসঙ্গে জোট বাঁধার আনন্দ যে কী, যারা জানে, তারাই শুধু জানে। আইন সাজিয়েছে আগের দিন থেকে ওরা সবাই মিলে। আমপাতা ঝুলিয়েছে দরজায়। কলাপাতা আর কলাগাছ রেখেছে দোরে। হাতে তৈরি ফুলের মালা ঝুলিয়েছে, পাতা হয়েছে মঙ্গলঘট। একধারে রান্না হচ্ছে থামবুট্টু, পুট্টারি, কারি আর পোলি পোলি। এইদিন এই স্পেশাল পদ রাঁধতেই হয় ওদের। পিঠে জাতীয়, ভাপা বেশির ভাগই, চাল এবং চালের গুঁড়ো দিয়ে তৈরি ওসব। এরপর আসে সেই মোক্ষম সময়। গাঁও বুড়ো একজন মরদের হাতে কাস্তে তুলে দেয়, আর তাকে পথ দেখিয়ে, জ্বলন্ত প্রদীপ হাতে এগিয়ে নিয়ে চলে একজন মেয়ে। পুরো রাস্তা ফুল দিয়ে সাজানো থাকে। আর এই সময়ে মন্ত্র বলতে বলতে পাশে পাশে চলে পুরোহিত। তো, সেবার কুপিল্লা এসেছিল। ওর বাবাই এতদিন ধরে আসত এই গ্রামে। ছেলে বড় হয়েছে বলে এবারে তাকে দায়িত্ব দিয়েছে ওর বাপ। কুপিল্লার চেহারা বেশ খোলতাই। ওকে দেখে ওরা নিজেরা গা ঠেলাঠেলি করেছে, ওকে নিয়ে ফিসফিস করে আলোচনাও করেছে। সে ছিল ওদের সখিদের ভেতরের ব্যাপার। কিন্তু স্বপ্নেও ভাবেনি যে, কোন ব্রাহ্মণের ছেলের ওকে পছন্দ হবে।
  খেতের ধারে এসে একজন বন্দুক ছুড়ল হাওয়ায়। এই ওদের পোলি পোলি দেবতার উদ্দেশ্যে অর্ঘ্য। এরপর শুরু হয়ে ফসল কাটার উৎসব। সেই ফসলকে বিজোড় সংখ্যক আঁটিতে বেঁধে ঘরে নিয়ে যায় ছোটরা। ঘরে ঘরে দেবতার পায়ে ঠেকিয়ে তবে নিজেদের জন্য জমিয়ে রাখে ওরা। ততক্ষণে চারিদিকে বাজি ফাটার শব্দে কান ঝালাপালা হয়ে উঠেছে। বিদ্যা আর ওদের সখিদের এবার সময় এসেছে নাচ দেখানোর। ওরা অল্পবয়সী মেয়েরা এই সময়ে ঘরে ঘরে গিয়ে যে যার মতো নাচ দেখায়। আর সেই নাচের পরে সবাই পয়সা দেয় ওদের। একটা নতুন কাপড়ে সেই টাকা তোলা তোলে ওরা। সেই কাপড়ে বেঁধে রেখে দেয় পরবর্তী সময়ের ভোজের জন্য। এরপর জমা সেই টাকা দিয়ে আইনে এসে ওরা সবাই মিলে ভোজ খায়। সেদিন অবশ্য নিরামিষ নয়। শুয়োর বা খাসির মাংস থাকেই। আর মদ খায় অঢেল ওরা। নাচ দেখিয়ে সেবার বেশ ভালই টাকা জমা করছিল ওরা। আর কুপিল্লা হাঁ করে দেখছিল ওদের। প্রথমবার এই গ্রামে এসে, এদের উৎসবে সামিল হয়েছে ও। ফলে নতুন বিস্ময়ে ও একটু বেশিই আগ্রহ দেখিয়ে ফেলেছিল। আর কেন জানি, ওর বিদ্যার নাচই সবথেকে পছন্দ হয়েছিল। সেদিন বিদায়ের সময় বিদ্যাকে একান্তে পেয়ে সেকথা প্রকাশ করেও ফেলেছিল কুপিল্লা। আর তাতে লজ্জা তো দূর, সেই মেয়ে খিলখিলিয়ে হেসে উঠে তার সখিদের ডেকে বলেছিল, ‘দেখ রে তোরা, এই টিকিধারী কী বলছে! আমার নাচ নাকি খুব মনে ধরেছে ওর!’ কথা শেষ হতেই একঝাঁক মেয়ের সম্মিলিত হাসির তোড়ে কুপিল্লার মনে হচ্ছিল লজ্জায় মাথা কেটা গেল ওর। কেন যে মুখ ফুটে এই বাচাল মেয়েটাকে এই কথা বলল ও! মুখের কথা আর তির ফেরানোর যখন উপায় নেই, তখন নাস্তানাবুদ হওয়া ছাড়া আর কিছু করার ছিল না ওর তখন। ওদের ঠাট্টাতামাশার মাঝখান থেকে সরে পড়ছিল কুপিল্লা গুটি গুটি। গ্রামের প্রায় শেষপ্রান্তে এসে গেছিল ও, সেই সময়ে পেছন থেকে কে যেন ডাকছিল ওকে। ঘুরে দেখে সেই মেয়েটা ছুটতে ছুটতে ওর দিকেই আসছে। এবার ভীষণ ভড়কে গেল কুপিল্লা। ভয়ে ওর গলা শুকিয়ে আসছিল। মারধোর করবে নাকি? বুকের ভেতর ধকধক শব্দটা নিজের কানেই বড় বেশি করে বাজছিল তার। সেই সময়ে মেয়েটা কাছে এসে ওকে বলল, ‘শোন গো বাউনের পো! কিছু মনে কর না যেন আমাদের কথায়। আমরা এমনিই হাসি মস্করা করি সবার সঙ্গে। তুমি লোকটা একটু হাঁদা বলে, মজা আজ বেশি জমেছিল। যাক্‌, ভোজের দিন আবার চলে এস। সেদিন আরও বেশি মজা করব’। এই বলে যেমন ছুটে এসেছিল মেয়েটা, তেমনিই ছুটে চলে গেল। মেয়েটার নাম পর্যন্ত জানা হল না ওর। বাড়ির দিকে যেতে যেতে কুপিল্লা ভাবছিল, ভোজের দিন ওখানে কি যাওয়া উচিত হবে ওর? বিশেষ করে ওরা ব্রাহ্মণরা যেখানে শুদ্ধ নিরামিষাশী।

ক্রমশ….

ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *