• Uncategorized
  • 0

দৈনিক ধারাবাহিক উপন্যাসে সিদ্ধার্থ সিংহ (পর্ব – ৯)

২০১২ সালের 'বঙ্গ শিরোমণি' সম্মানে ভূষিত সিদ্ধার্থ সিংহের জন্ম কলকাতায়। ১৯৬৪ সালে। ক্লাস নাইনে পড়ার সময়ই তাঁর প্রথম কবিতা ছাপা হয় 'দেশ' পত্রিকায়। প্রথম ছড়া 'শুকতারা'য়। প্রথম গদ্য 'আনন্দবাজার'-এ। প্রথম গল্প 'সানন্দা'য়। যা নিয়ে রাজনৈতিক মহল তোলপাড় হয়। মামলা হয় পাঁচ কোটি টাকার। ছোটদের জন্য যেমন সন্দেশ, আনন্দমেলা, কিশোর ভারতী, চির সবুজ লেখা, ঝালাপালা, রঙবেরং, শিশুমহল ছাড়াও বর্তমান, গণশক্তি, রবিবাসরীয় আনন্দমেলা-সহ সমস্ত দৈনিক পত্রিকার ছোটদের পাতায় লেখেন, তেমনি বড়দের জন্য লেখেন কবিতা, গল্প, উপন্যাস, নাটক, প্রবন্ধ এবং মুক্তগদ্য। 'রতিছন্দ' নামে এক নতুন ছন্দের প্রবর্তন করেছেন তিনি। এ পর্যন্ত প্রকাশিত বইয়ের সংখ্যা দুশো চুয়াল্লিশটি। তার বেশির ভাগই অনুদিত হয়েছে বিভিন্ন ভাষায়। বেস্ট সেলারেও উঠেছে সে সব। এ ছাড়া যৌথ ভাবে সম্পাদনা করেছেন লীলা মজুমদার, রমাপদ চৌধুরী, নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী, মহাশ্বেতা দেবী, শংকর, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়, সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়, সুচিত্রা ভট্টাচার্য, নবনীতা দেবসেন, রঞ্জন বন্দ্যোপাধ্যায়দের সঙ্গে। তাঁর লেখা নাটক বেতারে তো হয়ই, মঞ্চস্থও হয় নিয়মিত। তাঁর কাহিনি নিয়ে ছায়াছবিও হয়েছে বেশ কয়েকটি। গান তো লেখেনই। মিউজিক ডিরেক্টর হিসেবেও কাজ করেছেন বেশ কয়েকটি বাংলা ছবিতে। তাঁর ইংরেজি এবং বাংলা কবিতা অন্তর্ভুক্ত হয়েছে কয়েকটি সিনেমায়। বানিয়েছেন দুটি তথ্যচিত্র। তাঁর লেখা পাঠ্য হয়েছে পশ্চিমবঙ্গ মধ্যশিক্ষা পর্ষদে। ইতিমধ্যে পেয়েছেন পশ্চিমবঙ্গ শিশু সাহিত্য সংসদ পুরস্কার, কবি সুধীন্দ্রনাথ দত্ত পুরস্কার, কাঞ্চন সাহিত্য পুরস্কার, সন্তোষকুমার ঘোষ স্মৃতি সাহিত্য পুরস্কার, দক্ষিণ চব্বিশ পরগনা লোক সাহিত্য পুরস্কার, প্রসাদ পুরস্কার, নতুন গতি পুরস্কার, ড্রিম লাইট অ্যাওয়ার্ড, কমলকুমার মজুমদার জন্মশতবর্ষ স্মারক সম্মান, কবি সামসুল হক পুরস্কার, সুচিত্রা ভট্টাচার্য স্মৃতি সাহিত্য পুরস্কার, অণু সাহিত্য পুরস্কার, কাস্তেকবি দিনেশ দাস স্মৃতি পুরস্কার, শিলালিপি সাহিত্য পুরস্কার, চেখ সাহিত্য পুরস্কার, মায়া সেন স্মৃতি সাহিত্য পুরস্কার ছাড়াও ছোট-বড় অজস্র পুরস্কার ও সম্মাননা। পেয়েছেন ১৪০৬ সালের 'শ্রেষ্ঠ কবি' এবং ১৪১৮ সালের 'শ্রেষ্ঠ গল্পকার'-এর শিরোপা।

এইবার লিখব

নয়

বৃন্দাবনদা চাকরি পেয়েছেন। কেন্দ্রীয় সরকারের। দারুন চাকরি। ভাল মাইনে। কোয়ার্টারও পাচ্ছেন। আপাতত পোস্টিং আদ্রায়। সেই চিঠিতেই বৃন্দাবনদা লিখেছিলেন— এইবার লিখব।
কী লিখবেন তিনি? উপন্যাস? তিনি তো একবার চিঠিতে লিখেছিলেন, তাঁর একটি দীর্ঘ কবিতা পড়ে, কে নাকি তাঁকে বলেছিলেন, তাঁর হাতে উপন্যাস আছে। উনি যদি উপন্যাস লেখেন, অনেক তাবড় তাবড় লেখকদের ঘুম কেড়ে নেবেন। বৃন্দাবনদা নিজেও বলেছিলেন, তাঁর পরিকল্পনা আছে বড় বড় কাগজে উপন্যাস লেখার। তিনি কি সেই উপন্যাস লেখা শুরু করে দিয়েছেন?
চিঠি দিয়ে আর জানা হয়নি প্রতাপের। সে তখন ওই পত্রিকার দপ্তরে বুধবার-বুধবার যায়। আড্ডা মারে। ওখানেই নতুন নতুন আরও অনেকের সঙ্গে আলাপ হয়েছে। শুধু আলাপই নয়, কারও কারও সঙ্গে গড়ে উঠেছে বন্ধুত্বও। এর-ওর বাড়িতে যায়। তারাও আসে। সেই সুবাদেই এখানে কবিতা পাঠের আসর, ওখানে কবি সম্মেলনে যায় কিংবা অমুকের তমুক কাগজে লেখা দেয়।
বাড়ির কোনও কাজই  তাকে দিয়ে হয় না। এই নিয়ে তার মাও তাকে কম কথা শোনায় না। খালি ঘুরে ঘুরে বেড়ালে হবে? অনার্স নিয়েছিস, একটুও পড়তে বসিস?
প্রতাপ খুব কম কথাই বলে বাড়িতে। এই সব ক্ষেত্রে চুপ করে থাকলে মায়ের বকাবকির পারদ ক্রমশ চরে। তাই ও প্রথমেই বলে দেয়, রেজাল্টে দেখো।
ওর বাবা অবশ্য ওকে কখনও এ সব নিয়ে কিছু বলেন না। উল্টে প্রতাপ দেখেছে, উনি আড়ালে ওর মাকে বলেন, ও তো বড় হয়েছে, ওকে ওরটা বুঝতে দাও না…
প্রতাপের জগৎ গড়ে উঠেছিল নতুন নতুন আলাপ হয়ে ওঠা এই সব লেখালিখির লোকজনদের সঙ্গে। তাঁদের বয়স যাই হোক না কেন, তিনি বস্তি বা প্রাসাদ, যেখানেই থাকুন না কেন কিংবা তিনি ভবঘুরে বেকার বা যত বড় আমলাই হোন না কেন, তার সঙ্গে আলাপ থাক বা না-ই থাক, তার মনে হত, যাঁরা লেখে তাঁরা সবাই আসলে একটা তাঁবুরই লোক।
তাই বৃন্দাবনদার চিঠি পেলে ওর খুব ভাল লাগত। বৃন্দাবনদার চাকরি পাওয়ার চিঠিটা পেয়ে ও উত্তর দিয়েছিল। তার জবাব আসেনি। সাত আট কি দশ মাস হবে, একদিন সিঁদুর-হলুদ মাখানো একটা খাম এসে হাজির। কারিকুরি করা কার্ডের ভিতরে ছোট্ট একটা চিরকুট— এখানে দেখার কেউ নেই। হোটেলে খেতে হয়। পেটের অবস্থা বারোটা বেজে গেছে। এর মধ্যে একবার জন্ডিস হয়েছিল। মা এসে মাসখানেক ছিলেন। কিন্তু মা আর কত দিন থাকবেন? বাবাকেও তো ওখানে করে দেওয়ার কেউ নেই। এখনই বিয়ে করার ইচ্ছে ছিল না। কিন্তু কী করব! মা-বাবা যে ভাবে উঠেপড়ে লেগেছেন…  তোমাকে কিন্তু আসতেই হবে। কোনও কথা শুনব না। আর হ্যাঁ, এত দিন নানান ঝামেলায় ছিলাম, লেখাটা শুরু করতে পারেনি, এইবার লিখব।
বৃন্দাবনদার বিয়েতে ওর আর যাওয়া হয়ে ওঠেনি। আসলে যারা তখন কবিতা লিখছে, গল্প লিখছে, ছবি আঁকছে, নতুন কিছু করার কথা ভাবছে, তাদের সঙ্গে ও তখন ওতপ্রোত ভাবে মিশে গেছে। তাদের ছেড়ে একটা দিন থাকার কথাও ও ভাবতে পারে না। পাশাপাশি ঝাপসা হয়ে আসছে পাড়ার বন্ধুদের মুখ। স্কুলের বন্ধুদের মুখ। কলেজের সহপাঠীদের মুখ।
মাঝে মধ্যে ইউনিভার্সিটির ছেলে-মেয়েদের সঙ্গে কলেজ স্ট্রিটে দেখা হয়। কে কী নিয়ে রিসার্চ করছে কথা হয়, কে কোন কলেজে চাকরি পেল, জানতে পারে। কে গ্রিনকার্ড হোল্ডারকে বিয়ে করে আমেরিকায় ঘর বসিয়েছে, তাও কানে আসে।
কিন্তু প্রতাপ কোনও দিনই আহামরি কোনও ডিগ্রি চায়নি। বড় কোনও চাকরিরও প্রত্যাশীও নয়। সে শুধু চায় তার নিজের মতো করে লিখতে। সবাই যা লেখে, তার থেকে একটু আলাদা লিখতে। সেটা যদি খারাপ হয়, খারাপ। ভাল হলে, ভাল।
মাঝে মাঝে মনে পড়ে স্কুলের ম্যাগাজিনে লেখা দেওয়ার কথা। কার্তিকের কথা। কার্তিক যদি সে দিন গল্প লিখে স্কুলের ম্যাগাজিনে জমা দেওয়ার জন্য তাকে নিয়ে না যেত, তাকে যদি কবিতা লেখার জন্য উৎসাহ না দিত, তা হলে কি তার এই জগতে আর আসা হত! সেই কার্তিক এখন ওর বাবার দোকানে বসে। ওদের তিন পুরুষের ব্যবসা। শুধু ঘি আর মাখন বিক্রি করেই ওদের রমরমা। আজকাল আবার পাঁউরুটিও রাখা ধরেছে। অল্প বয়সেই বিয়ে-থা করে কেমন যেন লোক-লোক হয়ে গিয়েছিল। আর লেখালেখি? সে সব পাঠ ও স্কুল লাইফেই চুকিয়ে দিয়েছিল।
কিন্তু বৃন্দাবনদা! তিনি তো লিখেছিলেন, এইবার লিখব। শুরু করেছেন কি? সেই তো বিয়ের চিঠি পেয়েছিলাম! কেমন আছেন উনি? ঠিক তখনি এসে পৌঁছল তার আর একটা চিঠি— ছেলে হয়েছে, আগেই জানতাম। কিন্তু একটার পর একটা ঝামেলায় এমন আটকে থাকি যে, একটা চিঠি লেখারও সময় পাই না। সামনেই ওর অন্নপ্রাশন। চিঠি দেব। তুমি তো বিয়েতে আসোনি। এ বার কিন্তু তোমাকে আসতেই হবে।

ক্রমশ…

ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।