পরের দিন সকাল সাতটায় আর্যমাকে ফোন করে একটা অ্যাপয়েন্টমেন্ট নিয়ে এলাম। ও সকাল দশটায় ওর অফিসে যেতে বলেছিল । কিন্তু আমি জানালাম আফিসে না বাইরে কোথাও দেখা করতে চাই। সকাল নটায় একটা ক্যাফেতে দেখা করব আমরা, ঠিক হল। আমি জানতাম আর্যমা আমাকে ফেরাবে না। সেই ভরসাতেই লোকাল থানায় এইসব ঘটনার কিছুই জানাইনি। একই কারনে কাল শ্রেয়ানের বাইকটাও ধাপাতে ফেলে আসার সাহস পেয়েছি। শ্রেয়ান কাল রাত থেকে খুব আপসেট। ঘটনার আকস্মিকতায় ও খুব বিব্রত হয়ে পড়েছে। বাইকটা ফেলে আসতে হওয়ায় ওর মনটা খুব খারাপ। তাই ওকে আজ আর সঙ্গে নেব না। ও থাকলে আর্যমাও হয়তো পুরোপুরি সহজ হবে না। খোলাখুলি আলোচনা করতে অসুবিধা হবে।
আমি পৌনে নটা নাগাদ নির্দিষ্ট যায়গায় পৌঁছে গেলাম। গড়িয়াহাটের একটা ক্যাফেতে ঢুকে কোণার টেবিলের একটা চেয়ারে বসে পড়লাম। ঠিক নটায় দেখি আর্যমা ঢুকল, চেনায় যায় না। চুলগুলো ছোট করে কাটা। আগের থেকে আনেক বেশি স্মার্ট এবং ফিট লাগছে। ঢুকেই চারপাশটা একবার দেখে নিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে হাত তুলল। আমিও উঠে দাঁড়ালাম। না সত্যি পার্সোনালিটিটা আমূল পরিবর্তন করে ফেলেছে মেয়েটা। ভাবতে বেশ কষ্ট হচ্ছে যে একদিন এই মেয়েটাই আত্ম হত্যা করতে গিয়েছিল। হ্যাঁ সে অনেক দিন আগের কথা। আমরা তখন কলেজ সেকেন্ড ইয়ারে পড়ি। আমি কলেজ লাইব্রেরি থেকে ফিরছি। বেশ রাত হয়ে গেছে। দুদিন পরেই পরীক্ষা। তাই এত পড়ার তাগিদ। দেখি ওপেন এয়ার অডিটরিয়েমে কেউ একজন বসে আছে। দূর থেকে দেখে কেমন একটা খটকা লাগে। মনে হচ্ছে কোন একটি মেয়ে সবচেয়ে ওপরের সারির চেয়ারে বসে বসেই একটার পর একটা চেয়ার পাল্টাচ্ছে আর পাশাপাশি এগোচ্ছে। আবার মাঝে মাঝে দাঁড়িয়ে টলছে। মানে ও স্বাভাবিক অবস্থায় নেই। ভেবে অবাক হলাম একা একটা মেয়ে এত রাতে এই পরিবেশে মত্ত অবস্থায় কি করছে? আমি মেয়েটির আগোচরেই উপরের দিকে উঠতে থাকলাম। ওর ঠিক পিছনে গিয়ে দাঁড়াতেই বুঝলাম যে মেয়েটির হাতে একটি মাংস কাটার ছুড়ি। মনে হচ্ছে হস্টেলের কিচেন থেকে জোগাড় করা। আমি আর অগ্রপশ্চাদ কিছু না ভেবেই মেয়েটিকে পেছন থেকেই জড়িয়ে ধরলাম। ছুরি দিয়ে ও যাতে কিছু না করতে পারে সেটাই ছিল উদ্দেশ্য। আমি চাপা গলায় তীরস্কার সুরে বললাম, “হোয়াট দা হেল আর ইউ ডুয়িং?’ মায়েটি ডুকরে উঠে তেজ ভরা গলায় বলে উঠল, “লিভ মি ইউ বাস্টার্ড। লেট মি ডাই”। বলেই কনুই দিয়ে আমাকে একটা মোক্ষম গুঁতো মারল।
যাই হোক মেয়েটিকে আমি মরতে দিইনি। মেয়েটি আমার অল্পস্বল্প পরিচিত। তাই ওকে একা ফেলে রেখে যেতে পারিনি। সাররাত ওকে অডিটরিয়ামের সীটে শুয়িয়ে রেখে ওর অবিরাম মাতলামি সহ্য করেছি আর প্রলাপ শুনেছি। মশার কামড়ে প্রাণ ওষ্টাগত হয়ে উঠেছিল। পরদিন ওকে নিয়ে আবার গাইনোকোলজিস্টের কাছে যাই ওর কথানুসারে। তারও এক সপ্তাহ পরে ওর গর্ভপাত করানো হয়। কিন্তু মেয়েটির কাছে কথা দিয়েছিলাম, আমি আর ও ছাড়া এসব কথা কেউ কোনদিন জানবে না। সেই মেয়েটিই হল আজকের আর্যমা। আর্যমা পরে আমার প্রতি আসক্ত হয়ে পড়েছিল বুঝেছি। কিন্তু আমি আমার স্বভাব অনুযায়ী কৌশলে অ্যাভয়েড করে গেছি। যাই হোক সেদিনের সেই ঘটনার পর মেয়েটির নতুন জন্ম হয়ে আজকের আর্যমাতে পরিণত হয়েছে, যে আর্যমা একজন আই. পি. এস. অফিসার। একথা ভেবে আমার গর্ববোধ হচ্ছে যে ওর এই কৃতিত্বের পেছনে আমরাও কিছু অবদান আছে।