• Uncategorized
  • 0

প্রবন্ধে পার্থ সারথি গোস্বামী

হারিয়ে যাচ্ছে গ্রামের ‘শান্তির নীড়’ , ‘গরিবের এসি’ – পরিবেশবান্ধব, খড়ের ছাউনি মাটির ঘর 

গ্রামের কথা বলতে গেলে , প্রথমেই মনে আসে কবি বন্দে মিঞার খুব সহজ করে বলা কথাটি , ” আমাদের ছোট গাঁয়ে ছোট ছোট ঘর / থাকি সেথা সবে মিলে কেহ নাহি পর ” । গ্রাম মানেই সবুজের প্রাচুর্য , গ্রাম মানেই সহজ সরল মনের সাদামাটা মানুষজন , গ্রাম মানেই ‘ শান্তির নীড় ‘ আর সেই শান্তির নীড় মানেই ‘গরিবের এসি ‘ – মাটির দেয়ালে গড়া খড়ের ছাউনির ছোট ছোট ঘরগুলি । এঁটেল মাটি দিয়ে প্রস্তুত ‘গারা’র গাঁথনির মোটামুটি দুই থেকে তিন ফুট চওড়া , ১২-১৫ ফুট উঁচু দেওয়াল আর তার ওপর চারচালা খড়ের চাল । কনকনে শীত , প্রখর গ্রীষ্ম , অভদ্র বর্ষা সব ঋতুতে বসবাসের জন্য আদর্শ বাসস্থান ।
মাটির দেওয়ালের ওপর খড়ের চালের কাঠামোটিও বেশ আকর্ষণীয় , আড়াআড়ি ভাবে ঘরের সমান দৈর্ঘ্যের একটি মজবুত কাঠের ‘মুদুন’ থাকে ঘরের ঠিক মাঝামাঝি , মাটির দেয়ালের ওপরের অংশ থেকে মোটামুটি ৫-৬ ফুট উচ্চতায় । সেটি থেকে ঢাল তৈরি করে বেশ কয়েকটি কাঠের বাটাম ‘ভাগটান’ লাগানো হয়, যেগুলি এসে যুক্ত হয় দেওয়ালের ওপরের অংশে মাটির সঙ্গে মজবুত ভাবে আটকে রাখা হাল আকৃতির ‘পেলা’র সাথে , অর্থাৎ পুরো কাঠামোটি ওই পেলাগুলির ওপর ভর করে আটকে থাকে দেওয়ালে, দেখতে কিছুটা প্রায় ওল্টানো নৌকার মতো হয়ে । ভাগটান গুলির ওপর বাঁশের বাতা ঘন করে বিছিয়ে মজবুত করা হয় ছাউনিকে , তার ওপর সুন্দর ভাবে সাজানো হয় খড় । কোন কোন ঘর হয় আবার দ্বিতল , কড়ি বর্গা দিয়ে মজবুত মাটির মেঝে ঘরকে বিভক্ত করে দুই তলে । ওপরের তলে ওঠার জন্য কোথাও তৈরি করাহয় মাটির সিঁড়ি আবার কোথাও বা বাঁশের তৈরি মই, স্থানীয় ভাষায় মাটির বাড়ির দ্বিতলকে বলা হয় ‘কোঠা’ । মাটির দেওয়ালের ওপর খড়িমাটির প্রলেপ দিয়ে মসৃন করে তোলাহয় প্রতিটি দেওয়াল । উৎসব অনুষ্ঠানে নিজের নিজের ঘরকে আরো আকর্ষণীয় করে তোলার জন্য নানারকম কারুকার্য করা হয় ঘরের বাইরে দেওয়ালে ।
বাঁকুড়া পুরুলিয়া তথা প্রায় সমস্ত রাঢ়বঙ্গের ঐতিহ্যবাহী অতি পরিচিত এই খড়ের চালের মাটির ঘর । গ্রামীন পরিবেশে, হাতের কাছে পাওয়া সহজলভ্য নানান সামগ্রী দিয়েই তৈরি হয় ঘরগুলি । পরিবেশবান্ধব ও নানান ঋতুর আবহাওয়ার সঙ্গে মানানসই এই মাটির ঘরগুলির আরামদায়কতার সত্যি জুড়ি মেলা ভার ।
কালের গতির সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখেই দিন দিন পাল্টে যাচ্ছে মানুষের জীবনযাত্রার মান । তাই আজ পাল্টে গেছে এককালের সেই ‘পল্লব ঘন আম্রকানন’এর গ্রামগুলি । যুগের সঙ্গে তাল মিলিয়ে গ্রামীন মানুষ আধুনিকতার দিক দিয়ে প্রায় স্পর্শ করে ফেলেছে শহরকে । শাল পলাশের জঙ্গলকে সরিয়ে গ্রামেও আজ ভিড় করে দাঁড়িয়ে কংক্রিটের জঙ্গল । গ্রামে গ্রামে এখন ইঁট সিমেন্টের বাড়ির সংখ্যা চোখে পড়ার মত , আর তাই এই বিবর্তনে আজ বিলুপ্ত হতে চলেছে গ্রামের শান্তির নীড় ছোট ছোট মাটির ঘর গুলি ।
আধুনিক জীবনযাপনে অভ্যস্ত হয়ে ওঠা গ্রামের মানুষজন আজ পাকাবাড়িতে নিজেদের খাপ খাইয়ে নিলেও, প্রায় হারিয়ে যেতে বসেছে এই ঘর তৈরির সাথে অঙ্গাঙ্গি ভাবে জড়িয়ে থাকা পেশাগুলি । মাটির ঘরের সাথে সাথে অবলুপ্তির পথে এই পেশাগুলিও । মাটির দেওয়াল ভেঙে গড়ে উঠছে ইঁটের দেওয়াল , পাকা ছাত । খড়ের চালের জায়গায় কোথাও কোথাও করগেট বা এডভেস্টারের ছাউনি । ফলে এককালীন ব্যস্তবাগীশ পেশাগুলি আজ অবলুপ্তপ্রায় । এই ধরনের বাড়ি তৈরির সঙ্গে মোটামুটি ভাবে জড়িয়ে ছিল তিনধরনের পেশা । যারা দেওয়াল বা কাঁথ তৈরি করে তাদের বলা হয় ‘কেঁথো’,যারা ছাউনির কাঠামো প্রস্তুত করে তাদের বলা হয় ‘বাড়ুই’ এবং যারা খড়ের ছাউনির কাজ করে তাদের বলা হয় ‘ঘরামী’ । একটা সময় ছিলো, যখন এই ধরনের বাড়ি তৈরির সঙ্গে যুক্ত পেশার লোকজন বছরভরই ব্যস্ত থাকতেন নতুন বাড়ি তৈরি বা পুরানো বাড়ি মেরামতের কাজে । কিন্তু আজকের দিনে জীবনধারণের তাগিদে তাঁরা যুক্ত হতে বাধ্য হয়েছেন নানান অন্য পেশার সঙ্গে ।
সমস্যার কারণ জানতে গিয়ে এই পেশার সাথে এককালীন যুক্ত মানুষদের কথা বলে উঠে আসে নানান কথা । তাঁদের কথায় , মাটির দেওয়াল টিকিয়ে রাখার ঝঞ্ঝাট অনেক , নিয়মিত ভাবে পরিচর্যা করা প্রয়োজন দেয়ালগুলির , বৃষ্টির জলে বা অন্য কোন কারনে মাঝে মাঝেই ক্ষতিগ্রস্ত হয় ঘরগুলি, তাই নিয়ম করে বাড়ির দেওয়ালের ক্ষতিগ্রস্ত স্থানে মাটি ভরাট করে গুছাটি, ছঁচ, লাতা দিয়ে মেরামত করে তুলতে হয় দেওয়াল , এই সব কাজের উপকরণ পরিবেশবান্ধব এবং সহজলভ্য হলেও , এ সব কাজে শ্রম লাগে বেশি । তাই মানুষজন আজকাল এই সব ঝঞ্ঝাটের মধ্যদিয়ে না গিয়ে পাকাবাড়ির কথা ভাবছেন । তাছাড়া সবচেয়ে বড়ো সমস্যার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে খড় , আগে বাঁকুড়া পুরুলিয়ায় ‘বড়ান’ ধান চাষের প্রাচুর্য ছিলো , যে ধান গাছের উচ্চতা হত প্রায় পাঁচ ফুট , ফলে বড়ান ধানের খড়ের আঁটি হত লম্বায় বড়ো, এবং কান্ড ছিলো বেশ মজবুত , যা ছিল খড়ের চালের ছাউনির জন্য আদর্শ । বড়ান ধানের খড়ে একবার ছাউনি তৈরি করলে দু তিন বছর আর সেদিকে ফিরে তাকাতে হোত না । কিন্তু বর্তমানে উচ্চফলনশীল ধান চাষের প্রবণতা বেড়েছে , যে ধানের গাছ উচ্চতায় মেরে কেটে দুই থেকে তিনফুট , ফলে এইসব ছোট ছোট আঁটিতে ছাউনির কাজ করা বেশ কঠিন ও সময়ও লাগে অনেক বেশি । তাছাড়া এই সব খড়ের চাল মোটেই দীর্ঘস্থায়ী হয় না , অল্প দিনের মধ্যেই পচন ধরে এই সব ধানের খড়ে , ফলে বছর বছর ছাউনি পরিবর্তন লেগেই থাকে । তাছাড়া সমস্যা আরো প্রকট হয়েছে গ্রাম বাংলায় ধানকাটা মেশিনের ব্যবহারে । এই সব মেশিনে ধান কাটার পদ্ধতি এমনই যে, খড়ের আঁটি প্রস্তুত করা আর সম্ভব হয়না, গাছ থেকে ধানের শীষ কেটে বাকি খড় মাঠেই পড়ে থাকে , কেউ কেউ আবার এই কাটা, নষ্ট হয়েযাওয়া খড় মাঠেই আগুন জ্বালিয়ে পুড়িয়ে ফেলেন , ফলে গ্রামে গঞ্জে খড় এখন অমিল । মানুষজন সবাই এখন চিরস্থায়ী ব্যবস্থায় বিশ্বাসী, তাই বছর বছর এত ঝঞ্ঝাট করে কেউ আর এ সব বাড়ি আর টিকিয়ে রাখতে চাইছেন না , ফলে দিন দিন অবলুপ্তির পথে গ্রামের এই শেকড়ছোঁয়া ঐতিহ্য।
সভ্যতার ক্রমবিকাশ আর আধুনিকতার ছোঁয়ায় গ্রামবাংলার অনেক ঐতিহ্য ই এখন বিলুপ্তির পথে।
গ্রাম আজ আধুনিক , বদলে গেছে মানুষের আচার-আচরন, ভুলে যাচ্ছি আমাদের পুরাতন ঐতিহ্য। আমাদের আজ ভাবা উচিত, কিভাবে বাংলার এই হারিয়ে যাওয়া ঐতিহ্যগুলি লোকচক্ষুর অন্তরাল থেকে তুলে এনে সকলের সামনে তুলে ধরা যায়, সংরক্ষণ করা যায় । নইলে আগামী প্রজন্মের কাছে দায়ী হবো আমরাই, চিরাচরিত ঐতিহ্য থেকে তাদেরকে বঞ্চিত করার ।
ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *