• Uncategorized
  • 0

গল্পে মুক্তা রহমান

“সুখ-দুঃখ” 

পয়ালী গ্রামে বাস করে পাটওয়ারী পরিবার, একটি চারচালা টিনশেডের বাড়িতে। শোনা যায়, বাড়িটি তৈরী করতে পরিবারটিকে প্রায় নিঃস্ব হতে হয়েছিল। পাটওয়ারী গিন্নীর নাম জুলেখা। কর্তা আদর করে ডাকতেন জুলি বলে। একসময় বাড়ির কর্তা হাবীবুল্লাহ পাটওয়ারী ও জুলেখার প্রেমকাহিনী গ্রামে মানুষের মুখে মুখে ফিরতো। এখন সেই প্রেমময় ভালোবাসা আর তাদের ভিতর নেই। সময়ের স্রোতের ভালোবাসা চাহিদায় পরিনত হয়েছে। হাবীব আর জুলেখার সংসার প্রায় সতের বছরের। সে পেশায় একজন ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী। হাট বাজারে তার নিজস্ব দোকান আছে। পাশাপাশি নিজের একখন্ড জমি দেখাশোনা করে। এক ছেলে এক মেয়ে। খুব শীঘ্রই তৃতীয় সন্তানের মুখ দেখবে পরিবারটি। জুলেখা চায়নি তাদের আর কোন সন্তান হোক। কারন তিনটি সন্তানের খরচ মেটানোর সাধ্য পরিবারটির নেই।
জুলেখা রোমান্টিক মনের মানুষ। শিক্ষিত, ধর্মভীরু । পয়ালী গ্রাম থেকে তার বাবার বাড়িটি বেশ দূরে। বাবা মায়ের আদরের মেয়ে জুলেখার বিয়ে হয় সতের বছর বয়সে। দেখতে লম্বা, সুগঠিত। হাবীবের সাথে তার প্রথম দেখা হয় একটি বিয়ে বাড়িতে। হাবীবের ঢেউ খেলানো চুল তার দৃষ্টি কাড়ে। সুরেলা হাসিতে মন মজেছিল জুলেখার। বিয়ে বাড়ির আনন্দ আয়োজনে সেদিন অনেকের সাথে হাবীবও নেচেছিল। হাসিখুশি দিলখোলা মানুষ বলতে যা বোঝায় তাই ছিল সে। জুলেখা হাবীবের মত ওতো মিশুক ছিল না বলে প্রথম পরিচয়ে তেমন কথা বলতে পারেনি। কিন্তু হাবীব দেরি করেনি। জুলেখার বাবার কাছে বিয়ের প্রস্তাব পাঠায়। জুলেখা লেখাপড়ায় ভালো ছিল বলে তার বাবা বিয়েতে প্রবল আপত্তি জানায়। ছেলে বিদেশে থাকে, এটাও আপত্তির আরো একটি কারন। কিন্তু হাবীব ছিল নাছোড়বান্দা । প্রতিদিন জুলেখার বাবার সাথে কথা বলতে যেত সে। বোঝাতো জুলেখাকে কতোটা সুখে রাখবে সে। একসময় হাবীবুল্লাহর স্বপ্নপূরণ ঘটে।
বিয়ের প্রথম তিনটি মাস কিভাবে কেটে যায়, টেরই পায়নি জুলেখা। হাবীব তিন মাস পর বিদেশ চলে গেল। সে বছরই জন্ম নিল হাবীব জুলেখার ভালোবাসার প্রথম সন্তান হাসিব। একসময় সুখের সংসার কালো মেঘে ঢেকে গেল। বিদেশ থেকে ফেরত এলেন ভাগ্য বিড়ম্বিত স্বামী। তার চাকুরি চলে যায়। দেশে ফেরত আসতে বাধ্য হয় হাবীব। দেশে ফিরে বাড়িটি তৈরি আর দোকান সাজাতে গিয়ে জমানো সব অর্থ ফুরিয়ে গেলো। শুরু হলো অশান্তির মেঘ। দিনকে দিন বদলে যেতে লাগলো হাবীব। ভগ্নহৃদয়, হতোদ্যম হাবীব ব্যবসায়ও বেশি ভালো করতে পারলো না। জমানো টাকা শেষ হয়ে যাওয়ায় ধার কর্জ বাড়তে লাগলো। ধীরে ধীরে সে একজন ব্যর্থ মানুষে পরিনত হলো। এতে প্রথমে হাবীব মেজাজ হারাতে লাগলো। অতি সামান্য ঘটনায় যেমন রান্নায় ঝাল বেশি হলো কিংবা দুপুরে দোকানে খাবার পাঠাতে দেরি হলো, ক্ষেপে উঠে রাগারাগি কখনো গালাগালিও করতে শুরু করল। এরপর ধরলো জুয়া। সন্ধ্যায় দোকান বন্ধ করে চলে যায় জুয়ার আড্ডায়। চলে রাতভর। স্বামীর বদমেজাজ আর জুয়াড়ী প্রীতি প্রথম দিকে এড়িয়ে চলত জুলেখা। নিজেকে নিয়ে, হাসিবকে নিয়ে সংসারের কাজ নিয়ে ব্যস্ত রেখে দুঃখ ভুলত জুলেখা। মনে পড়ত হাবীবের সাথে তার কাটানো প্রেমময় সময়গুলো। একদিন আর এড়িয়ে যাওয়া হলো না। জুলেখার গর্ভে তখন দ্বিতীয় সন্তান লাভলী। জুয়া খেলে ভোর তিনটায় বাড়ি ফিরেছে হাবীব। দরজা খুলে স্বামীকে ঘরে ঢুকতে দিল। তারপর শান্ত স্বরে বলল, আজও জুয়া খেলে ফিরলে। কত টাকা হারলে আজ? হাবীব প্রায়ই জুয়ায় হেরে বাড়ি ফিরে। খোঁচা টা লাগলো জায়গা মত। হাবীব তর্জন করে বলল, কি বলতে চাও? বলতে চাই তো অনেক কিছু। যেকটা টাকা তুমি আমাকে দাও সেগুলো দিয়ে সংসার চালাতে আমার কষ্ট হয়। আর তুমি কিনা সব টাকায় জুয়ায় উড়াচ্ছ? বেশ করেছি। আরো করব। আমার টাকা আমি যেভাবে ইচ্ছা খরচ করব। তোর ভালো না লাগলে বের হয়ে যা তুই। বলে দৌড়ে এসে জুলেখার চুল ধরে ধাক্কা দিয়ে ঘর থেকে বের করে দিল। দারিদ্র্য, অশান্তি আর অসুখী দাম্পত্য জীবনের সাথে লড়তে লড়তে ক্লান্ত হয়ে পড়া জুলেখা সেদিনই স্বামীর উপর শ্রদ্ধা হারালো।
ডিসেম্বরের কালি গোলা রাতে অসহায়ের মত দাঁড়িয়ে রইল জুলেখা। ঠান্ডা আর উত্তেজনায় সারা শরীর কাঁপছে । গর্ভের সন্তানের জন্য দুঃশ্চিন্তা হচ্ছে তার। আঁধারে হাসনাহেনার গন্ধ ভেসে আসছে। কোথাও কোন সাড়া শব্দ নেই। বহুদূর থেকে ট্রেনের হুইসেল ভেসে আসছে। নিস্তব্ধতায় কান্না পেল জুলেখার। প্রবল ভাবে গুমড়ে গুমড়ে কাঁদতে লাগলো সে। হঠাৎ করে জুলেখা অনুভব করল, ছোট্ট দুটি হাত তার মাথাটি টানছে। মুখ তুলে চেয়ে দেখে হাসিব। মা’কে সান্ত্বনা দিতে তার স্নেহের হাত দুটি বাড়িয়ে দিয়েছে। আচমকা এক উষ্ণ ভালোবাসার স্রোত বয়ে গেলো জুলেখার সারা শরীরে। বুকে চেপে ধরল হাসিবকে।
হাসিবের চোখ দুটো জুলেখার মত। বাদামী। স্বভাবেও মায়ের মত, নিষ্পাপ, পবিত্র। ছায়ার মত মায়ের গায়ের সাথে লেগে থাকে সে। বাবাকে ভয় পায় বলে দূরে থাকে। শান্তশিষ্ট বাচ্চাটি বাবার কোলে গেলেই কেন যেন আড়ষ্ট হয়ে যায়। হাসিবের বয়স যখন তেরো হলো, তার মা বাধ্য হলো পড়াশোনার পাশাপাশি তাকে কাজে লাগিয়ে দিতে। বাজারের একটি কম্পিউটারের দোকানে কাজ করে হাসিব। এর থেকে যে আয় হয় তা দিয়ে তার পড়ার খরচ কিছুটা চালানো সম্ভব হয়েছে। বিজ্ঞানের প্রতি প্রবল ভালোবাসা হাসিবের। ও ইচ্ছে ও বিজ্ঞানী হবে। হাবীব চেয়েছিল ছেলে বাবার দোকানে বসুক। জুলেখা সাফ জানিয়ে দেয় সেটি সম্ভব নয়। জুলেখার ভয় পাছে ছেলে বাবার মত নিষিদ্ধ জুয়ার প্রতি আকৃষ্ট হয়ে পড়ে। ছেলেকে নিয়ে খুব গর্ব মায়ের। তার বিশ্বাস বাবার মত হবে না ছেলে। মনখোলা আর বুদ্ধিমান হয়েছে হাসিব। স্কুলে সব পরীক্ষায় ভালো ফলাফল করে। খেলাধুলায়ও ভালো। বাতাসের গতিতে ছুটতে পারে। বারো বছর বয়সে একবার এক দৌড় প্রতিযোগিতায় প্রথম হয়েছিল।
ভোরে বাড়ি থেকে বের হয়ে স্কুলে যায় হাসিব। স্কুল শেষ করে বাজারে দোকানে তার কাজে যায়। বাড়ি ফিরতে সন্ধ্যা। সন্ধ্যায় বাড়ি ফিরে ছোট দুভাই বোনকে নিয়ে পড়তে বসা। মধ্যরাত অবধি পড়ে সে। অনেক পরিশ্রম কিন্তু নিজের কাজকে উপভোগ করে হাসিব। জীবনে বড় হতে চায়। তার মায়ের স্বপ্ন পূরন করতে চায়। প্রদীপের লালচে আলোয় একা একা বসে থাকে জুলেখা। চুলোয় চাপানো পাত্র থেকে ধোঁয়া উঠে। টেবিলে সাজানো থাকে থালা বাসন। গোটা পরিবারটি যেন কারো অপেক্ষায় থাকে। জুয়ায় নিঃস্ব হয়ে কপর্দকশূণ্য অবস্হায় বাড়ি ফিরে সবার উপর তর্জন গর্জন করবে কেউ, এ যেন তার অপেক্ষায় বসে থাকা।
দিন গড়ায়। উচ্চাকাঙ্খী হয়ে পড়ছে হাসিব। দোকান থেকে তার যা রোজগার হয় সব দিয়ে বই কিনে। নিজের মনে বই পড়তে ভালোবাসে সে। ভালোবাসে গান শুনতে। মায়ের রাজ্যের গল্প শুনতেও ভালোবাসে। মাই তো তার সব। সে বোঝে মা তাকে কতোটা ভালোবাসে। জুলেখাও তার সব ভাবনা গুলো খুলে বলে হাসিবকে। হাসিবকে শুধু ছেলে হিসেবে নয় একজন বন্ধু হিসেবে দেখে জুলেখা। আর হাসিবও যথাসাধ্য গুরুত্ব দিয়ে মার কথা শোনে। একটা সময় দেখা গেল মা-ছেলে শ্রেষ্ঠ বন্ধুতে পরিনত হয়েছে।
অবশেষে জুলেখার সংসারে বহুদিন পর একটি সুসংবাদ এলো। ঢাকার একটি নামী বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সুযোগ পেয়েছে হাসিব। আনন্দের বন্যা বয়ে গেল জুলেখার সংসারে। এমনকি হাবীবও খুশিতে আটখানা। আগষ্টের এক চাঁদি ফাটা সকালে ঢাকার উদ্দেশ্যে রওনা দিল মা ছেলে। ভয়ানক নার্ভাস বোধ করছে হাসিব। মাকে মুখ ফুটে না বললেও তিনি খানিকটা আঁচ করলেন। বাসে চেপে তারা ঢাকায় পৌছল। বিশ্ববিদ্যালয় চত্বরে হাটার সময় তারা রোমাঞ্চ অনুভব করছিল। ঢাকায় থাকার পড়ার খরচ অনেক। কাজ জুটিয়ে নিল হাসিব। ছাত্র পড়াবে। মানে বলল দুঃশ্চিন্তা করতেনা। জুলেখার এখন দিন কাটে বাকি দুটি সন্তানের দেখাশোনা করে আর হাসিবের ফোনের অপেক্ষা করে। মাকে প্রতিদিন ফোন করে হাসিব। মায়ের সাথে মন খুলে কথা বলে। নিজের পড়াশোনা, ছাত্রদের পড়াশোনা শেষে বন্ধুদের সাথে বেড়াতেও যায় হাসিব। সব নিয়ে মার সাথে গল্প করে সে। ছেলের নানা গল্প শুনতে মন ভরে যায় জুলেখার।  ইদানীং এক মেয়ের কথা বলছে। মেয়েটির নাম নীলা। সুন্দরী ফ্যাশানিস্তা। পুরুষরা নাকি তার খুব ভক্ত। মনে কষ্ট পেলেও ছেলেকে কিছু বলেনি জুলেখা। মনে আশংকা ছেলে তার ভুল পথে পা বাড়াচ্ছে নাতো। পরে নিজেই নিজেকে প্রবোধ দেয়, ছেলেকে চিনি আমি। সর্বক্ষন নিজের উন্নতির চেষ্টা করছে সে। সে জানে তার পরিবার তার উপর নির্ভর করে আছে।
ঈদের ছুটি ঘনিয়ে এলো। এক সপ্তাহের ছুটিতে বাড়ি আসবে হাসিব। উৎসবের ঢেউ বয়ে গেলো জুলেখার সংসারে। বাড়িটি সাজানো হলো রঙিন কাগজ কেটে। জুলেখা ছেলের পছন্দের খাবার তৈরি করলো। মোরগ পোলাউ, চিংড়ির মালাইকারি, ডিমের পুডিং। বাড়িতে সাজ সাজ রব। মোগলাই গন্ধে পুরো বাড়ি ম ম করছে। পুরো পরিবারটি যখন অপেক্ষায় আছে প্রিয় সন্তানের বাড়ি ফেরার, তখনি ফোনটি এলো। হাসিবের এক বন্ধু জানালো বাড়ি ফেরার উদ্দেশ্যে হাসিব যে বাসে উঠে রওনা দিয়েছিল সেই বাসের সাথে আরেকটি দ্রুতগামী ট্রাকের মুখোমুখি সংঘর্ষ ঘটে।
জুলেখা বিশ্বাস করে, তার হাসিব মারা যায়নি। তাকে হত্যা করা হয়েছে। একটি পরিবারকে খুন করা হয়েছে। জুলেখার একটিই দাবী এই হত্যাকান্ডের বিচার হোক।
ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।