• Uncategorized
  • 0

অণুগল্পে শর্মিষ্ঠা সেন

সুখ

প্রথমদিনই লোকটাকে ভাল লাগেনি পরিতোষের ৷ পরিতোষ সদ্য কর্পোরেশনের চাকুরীতে ঢুকেছে ৷ ওর দপ্তর টি দোতলায় ৷ মোটামুটি বারো বাই বারো একটা ঘরে গোটা পাঁচেক টেবিল , পুরোনো গোদরেজ কোম্পানীর স্টীল আলমারী দুটো, কাগজ এবং ফাইল পত্র রাখা শোকেস আলমারী তৎসহ চেয়ার ৷ কি অদ্ভুত উপায়ে এত জিনিসপত্রের মধ্যেও জনাকুড়ি লোকের স্থান সংকুলান হয় ৷ মাথার ওপর চারখানা ফ্যান, যাদের রং কোন এক সময় সাদা ছিল এখন বয়সের সাথে সাথে হলদেটে ৷ ফ্যানের ব্লেডে জমে থাকা নোংরা ঝুল-ধূলো অন্য যে কোনো সরকারী অফিস কে লজ্জা দেবার জন্য যথেষ্ট ৷ এসবই পরিতোষ নিজের চেয়ারে বসে লক্ষ্য করেছিল ব্যাগ , ছাতা নামিয়ে রাখতে রাখতে ; আর লক্ষ্য করেছিল মুখোমুখি বসা লোকটাকে ৷ লোকটা চশমার ওপর দিয়ে পিটপিটিয়ে তাকিয়ে  তাকেই জরিপ করছিল ৷

লোকটার রোগা শরীর , পাতলা হয়ে আসা চুল, ঝ্যাটা গোঁফ, ঘোলাটে চোখে আরশোলা রং এর চশমা , গালে কাঁচাপাকা দাঁড়ি , নোংরা সাদা সার্ট ৷

এ লোক সমস্যা করবে৷

পরিতোষ তাকাতেই লোকটা জিজ্ঞেস করল , “তা বাওয়া , লাল্টুকুমার, কোথ্ থেকে আসা হচ্চে?”

পরিতোষ যা আন্দাজ করেছিল মিলে যেতে একটু নিশ্চিন্ত হল ৷ চরিত্রের আন্দাজ পেলে মানুষকে পেড়ে ফেলতে পরিতোষের সময় লাগেনা ৷ গাঁ মফস্বলের ছেলেমেয়েরা এমনিতেই পোড় খাওয়া হয়৷ পরিতোষ ধীরে সুস্থে উত্তর দিল , ” মছলন্দপুর দাদা,  স্কুল কলেজ থেকে ট্রেনই ঘরবাড়ি, এখনও লাল্টুকুমার আছি বলছেন ! বেড়ে তো !”
জবাব পেয়ে ঝ্যাঁটাগোঁফ খিকখিক করে হাসতে লাগল যেন এমন রসিকতা শুনতেই অফিস আসা ৷

একদুমাসের মধ্যেই ঝ্যাঁটাগোঁফের রকমসকম বুঝতে বাকী থাকল না ৷ নাম রসময় পাল , কাছাকাছিই থাকে, লঝজড়ে সাইকেল নিয়ে যাতায়াত করে৷  পরিতোষ একদিনও রসময়কে সাদা জামা কালো প্যান্ট ছাড়া অন্য কোনো পোষাকে দেখতে পায়নি ৷ অফিসে সকলের সাথে তার ইয়ারি দোস্তি ৷  সহকর্মির্ণীদের ম্যাডাম ছাড়া সম্বোধন করেনা , চকচকে মুখে তাদের সাথেও দুনিয়ার খোশগল্প ! বড়ই সুখী মানুষ  ! না হলে এত গল্প পরিতোষের তো আসেনা ! লিফ্টম্যানের সাথে খৈনী ডলে খেতেও দেখেছে ৷  দুপুরে খায় অফিস ক্যান্টিন এ ৷ খেয়েদেয়ে পান চিবুতে চিবুতে সীটে গা এলিয়ে বসে একমনে দাঁত খোঁচায় ৷ পরিতোষের গা গুলিয়ে ওঠে সেসময় ৷ পরিতোষের পাশে লোহার শো কেস এ ফাইল পত্র রাখা ৷ রসময় পানের রসমাখা আঙুলে ফাইল এগিয়ে দেয় পরিতোষের দিকে , ” ব্রাদার, ৪৫ নং ওয়ার্ড টা তুলে রেখে ২নং টা দাও ৷ ওদের ওদিকে কোনো কাজ হয়নি বলছে , এদিকে হাতা,ছাতা ,কার্ড সব বিলি করার রেকর্ড রয়েছে ! ডেঙ্গু তাড়ানোর এই তো  ব্যবস্থা ! লোয়ার ডিভিশনের দিদিদের দিয়ে বাড়ি বাড়ি গিয়ে জলের নমুনা সংগ্রহ করাবে,  কার্ডে সই করাবে সরকারের খেয়ালে , এদিকে রাস্তা ঘাটে নোংরা, পুকুরে মশার চাষ!” রসময় প্রতি সন্ধ্যায় টিভিতে বসা সুখের পায়রাদের  মতো উক্তি করে ৷

পরিতোষ আলগোছে ধরে , তবুও আঙুলে আঙুল ঠেকে যায় , রসময় পানের রস সামলে মুখ বাঁকিয়ে হাসে আর পরিতোষের মনে হয় রসময়ের রস ওর শরীরের কণায় কণায় মিশে যাচ্ছে ৷

লোকটা কোন ক্ষতি করেনি তবুও ওর উপস্হিতি , কথা বলার ধরণ , চাউনি সবকিছুই পরিতোষের গায়ে জ্বালা ধরায় ৷আচ্ছা, পরিতোষ মহিলা হলে কি যৌন হেনস্হার অভিযোগ আনত ?  সে সিগারেট খাবার অছিলায় নীচে নেমে আসে ৷

নীচে দেখা হয় জলকর বিভাগের পল্টুর সাথে ৷ পল্টু পরিতোষের সিনিয়ার হলেও দুজনার ভাব হতে সময় লাগেনি , ওই সুখটানের বন্ধুত্ব আরকি ! দিনে দু চারটে সিগারেট আর অফিসের কথাচালাচালি৷ কথায় কথায় রসময়ের কথা ওঠে ৷ পল্টু বলে রসময়ের বউএর পালিয়ে অন্যত্র সংসার পাতার কথা ৷ সাত বছরের মেয়েটিকেও সে সঙ্গে করে নিয়ে গেছে ৷ পুরোনো প্রেম চাগার দিয়ে ওঠায় রসময়ের সংসার ছেড়ে বউ ভাগলবা হয়েছিল ৷ বাড়িতে এখন বুড়ি মা আর রসময় ৷ রসময় নাকি ওখনও লুকিয়ে লুকিয়ে বউ মেয়েকে দেখতে যায় ৷ ডিভোর্স টিভোর্স কিছু হয়নি , শুধু রসময়কে ছেড়ে অন্য স্বামীর ঘর করছে তার আপন বিয়ে করা বউ ! একেবারে যা তা কান্ড ! অবশ্য এমন তো হয়ই আকছার ৷

পরিতোষ এবার লোকটির চরিত্রের ব্যাখ্যা খুঁজে নেয় ৷ এ জন্যই এমন অস্বাভাবিক লাগে ৷ নামে সত্যিই কিছু এসে যায় না ! নইলে ‘রসময়’এর বউ পালায় !

রসময়ের বেগতিক অবস্থা শুনে পরিতোষের মনটা বেশ ফুরফুরে হয়ে ওঠে ৷ মানুষের মন কি বিচিত্র ! সে ধোঁয়া নিভিয়ে ফিরে আসে চেয়ারে ৷ আড়চোখে রসময় কে লক্ষ্য করে  নিজে থেকেই একসময় খেজুর শুরু করে ৷ তিনটের পর কাজকর্ম ধীর লয়ে চলে প্রতিদিনই ৷ বাকী টেবিলের লোকগুলোও খোশগল্পে মেতে ওঠে কমবেশী ৷

*     *     *     *      *     *     *

মাঝে  রসময় বেপাত্তা হয়ে যায় হঠাৎ ৷ পরিতোষের চোখ  বার বার ফাঁকা চেয়ারটায় আটকে যায়, খালি খালিই লাগে৷ অন্য বিভাগ থেকে লোকজন খবর নিতে এসে ফিরে যায় ৷ তারপর কানাঘুষোয় শোনা যায় রসময় ঠ্যাঙানি খেয়ে হাসপাতালে ভর্তি ছিল ৷ আবার সে বউএর সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছিল , অফিসে আসবে শিগ্গিরি ৷

হপ্তা দুয়েক পর অফিসে এসে নিজের চেয়ারে বসে বেশ হাবভাব নিয়ে রসময় বলে , “বুইলে ব্রাদার , মেয়েটাকে দেখতে গেসলুম , তা , বউ বললে , ও নাকি আর আমার মেয়ে নয় , আমি চেঁচামেচি করতেই ওর ষন্ডা লোকটা মেরে পাট পাট করে দিল ! আট বচ্ছর ঘর করেছিলুম , বউএর মনের নাগাল পেলুম না ভায়া ! সে বুঝতেও যাওয়া ৷ নইলে আমার কী ? দিব্যি চাগরি কচ্ছি , খাচ্চি দাচ্চি , মাস গেলে বেতন পাচ্চি আর বগল বাজাচ্চি ! আমার আর কী !”

পরিতোষ শোনে আর দেখে ৷ চশমার ওপাশে রসময়ের চোখটা ভেজা ভেজা মনে হয় যেন ৷

ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।