• Uncategorized
  • 0

স্মরণ ২০০: গদ্য – আত্রেয়ী রায়

আদ্যন্ত রোমান্টিক বাঙালি। প্রথম প্রেম সাহিত্য। লেখালেখির শুরু কলেজ জীবনে। সংসারের কাজ আর পড়ানোর ফাঁকে ফাঁকে বন্ধুবান্ধব আর মেয়ের উৎসাহে নতুন করে লেখালেখির শুরু। ভালোলাগার ক্ষেত্র বিস্তীর্ণ নাচ, গান, নাটক, সিনেমা আর ভ্রমণেও।

ঈশ্বর

১৮৫৬ সালের ডিসেম্বর। শ্রীশচন্দ্র ন্যায়রত্নের বিবাহ। বাংলা তথা ভারতের প্রথম বিধবাবিবাহ। পাত্রীর নাম কালীমতি। ঈশ্বরচন্দ্রের সুকিয়া স্ট্রিটের বাড়িতে সাড়ম্বরে সুসম্পন্ন হলো বিবাহ কার্য। কলকাতার গণ্যমান্য ব্যক্তিরা প্রায় সকলেই উপস্থিত। বিবাহমন্ডপ পুলিশ দ্বারা সুরক্ষিত, যেকোনো মুহূর্তে গোলযোগ বাধতে পারে। রাধাকান্ত দেব এবং তাঁর অনুসারী ব্রাহ্মণবর্গ প্রচন্ড ক্ষেপে আছেন ঈশ্বরের বিরুদ্ধে। ঈশ্বরচন্দ্রের আবেদনে স্বাক্ষরকারীর সংখ্যা হাজারেরও কম, আর রাধাকান্ত দেবের পাল্টা আবেদনে স্বাক্ষরকারীর সংখ্যা তেত্রিশ হাজার। সারাদিনের পরিশ্রমে ক্লান্ত, অবসন্ন কিন্তু পরিতৃপ্ত ইশ্বরচন্দ্র দাঁড়িয়ে আছেন দ্বারের কাছে। এতটুকু পথ অতিক্রম করতে কতই না ঝড়ঝঞ্ঝা পার হতে হয়েছে তাঁকে। তাঁর মতো লৌহহৃদয় মানুষও একসময় হাল ছেড়ে দিয়েছিলেন। মানুষের কর্মক্ষমতারও তো সীমা আছে। একদিকে গ্রামে গ্রামে পদব্রজে ঘুরে বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেছেন, অন্যদিকে বেদবেদান্ত, ন্যায় নীতিশাস্ত্র খুঁজে খুঁজে বিধবা বিবাহের পক্ষে যুক্তি সাজিয়েছেন একটা একটা করে। বিধবাবিবাহ আইন পাস হওয়া সত্ত্বেও এতদিন একটি বিধবারও বিয়ে দেওয়াতে পারেননি তিনি। যারা কথা দিয়েছিল সাহায্য করবে, তারাও কিছু করতে পারেনি। এ পোড়া দেশের  বিধবা শিশুকন্যাগুলিকে বৈধব্যের নরক যন্ত্রণা থেকে মুক্তি দিতে তার এতকালের লড়াই আজ সাফল্যের মুখ দেখেছে।
বিবাহ বাটি ছেড়ে রাস্তায় বেরিয়ে আসেন তিনি। মনে পড়ে কালীকান্ত চট্টোপাধ্যায়ের কথা, বীরসিংহের পণ্ডিতমশাই। তিনিই তো প্রথম বুঝতে পেরেছিলেন বীরসিংহের সিংহশিশুটির মেধার অসাধারণত্ব। বাল্যকালের সেই পণ্ডিতমশাইয়ের প্রতিও শ্রদ্ধা রাখতে পারেননি ঈশ্বর। গ্রামে গিয়ে শুনেছিলেন নয় বছরের একটি বালিকাকে বিবাহ করতে চলেছেন সত্তর বছরের কালীকান্ত চট্টোপাধ্যায়। তিনি ভঙ্গ কুলীন, অন্যান্য গ্রামে তার অনেকগুলি স্ত্রী আছে। বছরে একবার করে তিনি সেসব গ্রামে যান সহবাস দিয়ে তাদের ধন্য করতে, বদলে তাদের পিতাদের কাছ থেকে নিয়ে আসেন অর্থ। ঘৃণায় মুখ কুঞ্চিত হয়ে যায় তার। নিজের পিতা-মাতার অনুমতিক্রমে সিদ্ধান্ত নেন বিধবাবিবাহ আইন চালু করে কচি মেয়েগুলির মুখে হাসি ফোটাবেন। একাদশীতে অভুক্ত মেয়েগুলির মুখের খাবার কেড়ে নিয়ে, অষ্টপ্রহর আচার-বিচারের অনুশাসনে বেঁধে রেখে, সমাজ নিজেই তলিয়ে যাচ্ছে পঙ্কিল অন্ধকারে। বিপক্ষীয়রা ঈশ্বরচন্দ্রের যুক্তি খন্ডন করতে পারেনি। হিন্দু বিধবাবিবাহে এখন আর কোন নিষেধ তো নেইই, এখন থেকে দ্বিতীয় বার বিবাহিত নারীর সন্তানও তার পিতার সম্পত্তির বৈধ অধিকারী হবে।
বিবাহসর্বস্ব জীবন থেকে বালিকাগুলিকে শিক্ষার আলোয় আনার প্রয়োজনীয়তা মহামতি বেথুন সাহেবের সাথে সাথে তিনিও তো বুঝেছেন। বেথুন সাহেবের স্কুলে তাঁরও অবদান কম নয়। অশিক্ষার অন্ধকারে মেয়েগুলিকে বন্দী করে রাখার জন্য সমাজের কতই না ষড়যন্ত্র, ধর্ম কে সামনে রেখে কতই না চোখরাঙানি। অথচ বৈদিক যুগে নারীরা শিক্ষায় ছিলেন অগ্রগণ্যা। অপালা, লোপামুদ্রা, গার্গী, আত্রেয়ী এমনকি কিছুকাল আগেই হটি বিদ্যালঙ্কারের উদাহরণ সামনে রেখেছেন তিনি। বেথুন স্কুলের মেয়েদের পালকিতে লিখে দিয়েছেন বেদের সেই অমোঘ বাণী, “কন্যাপেবং পালনীয়া শিক্ষনীয়তি যত্নতঃ”।
হাওড়া, হুগলি, চব্বিশ পরগনা,বর্ধমান, বাঁকুড়া, বীরভূম, মেদিনীপুর জেলাগুলিতে ঘুরে ঘুরে পঁয়ত্রিশটি বালিকা বিদ্যালয় স্থাপন করেছেন। কিন্তু শুধু স্কুল খুললেই তো হবে না, চাই পাঠ্যবই, উপযুক্ত শিক্ষিকা। ছেলেমেয়েদের পাঠ্যারম্ভের জন্য তিনি রচনা করে ফেলেছেন বর্ণপরিচয় প্রথম ভাগ ও দ্বিতীয় ভাগ, লিখে ফেলেছেন আখ্যানমঞ্জরী, কথামালা, বোধোদয়। খৃষ্টান মিশনারীরা মেয়েদের লেখাপড়া শেখানো আগেই শুরু করেছে, কিন্তু তাদের প্রধান উদ্দেশ্য ধর্মপ্রচার, শিক্ষাবিস্তার নয়। আর বিদেশী ভাষায় শিক্ষালাভের পক্ষপাতী নন তিনি। মাতৃভাষায় যথাযোগ্য পাঠ্যবই বা কোথায় ছিল এতদিন। একটি জাতির মেরুদন্ড হল তার মাতৃভাষা। মাতৃভাষাকে অবজ্ঞা করে কলকাতার নব্য বুদ্ধিজীবীরা পরস্পরের মধ্যে ইংরেজিতে বাক্যালাপ করে। তাঁর মনে পড়ে মধুসূদন দত্তের কথা। ইংরেজি ভাষার মোহে অমিত প্রতিভাধর এই কবি কাব্য রচনা করেছিলেন ইংরেজিতে। গ্রহণ করেছিলেন খ্রিস্টধর্ম। কি লাভ হল তাতে? স্বীকৃতি পেলেন তিনি ইংরেজি ভাষার কবি হিসেবে? অথচ তাঁর রচিত অমিত্রাক্ষর ছন্দের “মেঘনাদবধ কাব্য” বাংলা ভাষার শ্রেষ্ঠতম সম্পদ হিসেবে যুগে যুগে অমর হয়ে থাকবে। মধুসূদন তাঁর ‘বীরাঙ্গনা’ কাব্যখানি  ঈশ্বরচন্দ্রকেই উৎসর্গ করেছেন। বিলেতে থাকাকালীন কবির আর্থিক বিপর্যয় ইশ্বরচন্দ্রই তো সামলেছেন টাকা পাঠিয়ে। তাই তার কাছে কবি নানাভাবে ঋণী।
রাত্রির অন্ধকার গাঢ়তর হয়ে আসে। ফেরার পথ ধরেন ঈশ্বর। এখনো কত কাজ বাকি তার। নিজ পুত্রের সঙ্গে এক বিধবা বালিকার বিবাহ দেবেন মনস্থির করেছেন। বীরসিংহের গৃহে না জানি তা নিয়ে কতই ঝড় উঠবে। সংস্কৃত কলেজের অধ্যক্ষের পদ ছেড়েছেন অনেক দিনই, বই বিক্রির রয়ালটির টাকা এখন ভরসা। বড় চিন্তান্বিত তিনি। কত মানুষকে টাকা দিতে হবে, অকাতরে দানধ্যান করার এই এক জ্বালা! মানুষজন বড় পেয়ে বসে, সুযোগ নিতে চায়। শহুরে মানুষজনের প্রতি দিন দিন তার বীতশ্রদ্ধা বাড়ছে। এখনো কত কাজ বাকি! হঠাৎ ভাবনায় ছেদ পড়ল তার। হরিবোল ধ্বনি দিয়ে কিছু লোক একটি মৃতদেহ নিয়ে যাচ্ছে সৎকারের জন্য। শববাহী দলের মধ্যে কয়েকজন তাকে চিনতে পেরে ছুটে এসে প্রণাম করল। ঈশ্বর জিজ্ঞেস করলেন,
“কার দেহ নিয়ে যাচ্ছিস রে?”

“নোয়াপাড়ার হারাধন বাঁড়ুজ্জে, পণ্ডিতমশাই।”

আরেকজন বলল, “গত মাসেই বিবাহ করেছিলেন, আহা, পাঁচ বছরের মেয়ে বেধবা হল।”
শুনে পুনরায় ভারী হয়ে উঠলো তাঁর হৃদয়। সমাধান শুধুমাত্র বিধবাবিবাহ নয়, সমস্যার শুরু তো বাল্যবিবাহে। কি নির্বোধ, অন্ধকারাচ্ছন্ন সেই দেশ যেখানে পাঁচবছরের বালিকাও বিবাহযোগ্যা! মুখ ফিরিয়ে গৃহের পানে হাঁটতে থাকেন তিনি।
ধুতি চাদর পরিহিত খর্বকায় মানুষটির ছায়া দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হতে হতে ঢেকে ফেলে কুসংস্কারাচ্ছন্ন, কূপমন্ডুক, আত্মগরিমাহীন, পাপ-পঙ্কিলতায় আচ্ছন্ন হিন্দুসমাজকে। সেই ছায়া দু’শো বছর পরেও প্রাসঙ্গিকতা হারায়নি। আজও সরকারকে নিতে হয় “বেটি বচাও বেটি পঢ়াও” প্রকল্প। উত্তরপ্রদেশের গ্রামে মাসের পর মাস জন্ম নেয় না একটিও কন্যা শিশু। ধর্ষিতা হয় সদ্যোজাত কন্যা এবং ষাটোর্ধ্ব বৃদ্ধাও। প্রাথমিক পেরোনোর আগে স্কুলছুট মেয়ের সংখ্যা শুনে আজও আঁতকে উঠতে হয়। পণপ্রথা ও গার্হস্থ্য হিংসার বলি হয় প্রতিদিন শত শত মেয়ে। দুইশত বৎসর, কম সময় তো নয়, অথচ কতটুকু এগিয়েছে দেশ, কতটুকু আলো প্রবেশ করেছে জনমননে? স্বর্ণপ্রসবা সেই যুগের তিনিই শ্রেষ্ঠ পুরুষ,তার বজ্রকঠিন খড়ম আর পদ্মকোরকসম কোমল হৃদয়ের স্পর্শে জাগ্রত হয়েছিল, ধন্য হয়েছিল বাংলাদেশের মৃত্তিকা।
ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।