সাপ্তাহিক ধারাবাহিক উপন্যাসে শ্রীপর্ণা বন্দ্যোপাধ্যায় (পর্ব – ২৩)

ইচ্ছামণি

পর্ব ২৩

রুমার বারো মাসে তেরো পার্বণের মতো সারি দিয়ে অসুখ। সারা বছর নাকে সাইনাস, হাঁচি, গলায় ফ্যারেঞ্জাইটিস আর অ্যালার্জির জ্বলুনি তো রয়েইছে, তার ওপর সেদিন বাজার থেকে ফেরার পর বারান্দায় মাথা ঘুরে পড়ে গিয়েছিল। বাড়িওয়ালার বৌ পাড়ায় সুখবরের কথা রটিয়ে দেয় আর কি? কিন্তু মাথা ঘোরার কারণ যে পেটে প্রাণ সঞ্চার নয়, ঘাড়ের কশেরুকাগুলোর মধ্যে ফাঁক কমে যাওয়া, তা জানার পর ভদ্রমহিলার কী আফসোস! প্রায় ঘণ্টা দেড়েক ধরে ডাক্তারের কাছে যেতে না দিয়ে ভাড়াটে আর তার বৌকে এক সন্তানের সমস্যা ও দুটি সন্তানের সুফল সম্পর্কে বক্তৃতা দিয়ে গেল। ওঃ! কী সমাপতন! সমীরদাও ঠিক সেই সময় হাজির হয়েছিল। ইদানিং শালার বৌয়ের সঙ্গে বিশেষ বাক্যালাপ করে না। কিন্তু পছন্দের টপিক ও তার সমর্থক পেয়ে গেলে কে না উৎসাহিত হয়? শম্পা রায়চৌধুরী আর সমীর ঘোষ মিলে সেদিন রুমাকে আর একবার প্রসূতী বানিয়েই ছাড়ে আর কী?
মাথা ঘুরে পড়ে গেলেই তো চুকে যায় না। পড়ে গিয়ে রুমার বাঁ হাত-পা এবং কোমরে চোট লেগে বেশ ব্যাথা হয়েছে। সমীরদার পরিচিত এক হোমিওপ্যাথ ডাক্তার প্রাথমিক ভাবে দেখে আর্নিকা মন্ট আর কী একটা ওষুধ দিতে কিছুক্ষণ ব্যথাটা বাগে ছিল। কিন্তু রাতে যন্ত্রণা এমন বাড়ে যে সকালেই অর্থোপেডিকের কাছে নিয়ে যেতে হয়। তাঁরই পরামর্শে ঘাড়ের এক্স-রে করে সার্ভাইকাল স্পন্ডেলিসিস ধরা পড়ল। দুটি কশেরুকার মধ্যে ফাঁক কমে গেছে, হাড়ও কিছুটা ক্ষয়ে গেছে। ফিজ়িওথেরাপির পরামর্শ দেন। প্রতি সিটিং-এ একশো কুড়ি টাকা। ব্যায়াম দেখিয়ে দেওয়া হয়। তিন দিন নেওয়ার পরই ব্যস্‌! অত খরচ করা চলবে না। সরকারি নিয়ম ও তালিকাভুক্তি অনুযায়ী যে ডাক্তারকে দেখালে অফিস থেকে চিকিৎসার খরচ পাওয়া যাবে, তাকেই দেখাতে হবে।
এইসব নিয়ম-কানুনের চক্করে পড়তে চায় না বলে অতীন হয় পছন্দ মতো ডাক্তার দেখানোর পক্ষপাতী, না হয় নিজে নিজে অসুখ সারিয়ে ফেলার। কতবার রুমাকে কতগুলো মামুলি যোগ ব্যায়াম দেখিয়ে নিয়মিত করে যেতে বলেছে; সে কথা শুনলে এই বয়সে এমন সমস্যার সম্মুখীন হতেই হোত না। না শুনে অসুখ বাধিয়েছ যখন, তখন অতীন তো খরচের কথা ভেবে পিছিয়ে আসছে না; কিন্তু রুমার এ কেমন বেয়াড়া জেদ। সরাকরি নিয়ম মেনে তারাই পুরো লাভবান হয়, যারা নকল কাগজপত্র প্রেসক্রিপশন, ক্যাশমেমো ইত্যাদি  যথাযথ ফর্ম ফিল আপ করে জমা দেয়। সোজা পথে চলতে গেলে সেটা যে কী মারাত্মক ঘুরপথ হয়ে দাঁড়ায়, তা পাগলিকে কে বোঝাবে? সুতরাং বনহুগলির অস্থি বিকলাঙ্গ হাসপাতালে কিছুদিন দৌড়-ঝাঁপ চলল। শেষমেষ ব্যায়ামটাই কিন্তু চিকিৎসা, ওষুধপত্র সবই উপসর্গের সাময়িক নিবৃত্তির জন্য। কিন্তু সেটা অতীন বলতে গেলে ব্যাপারটা দাঁড়াবে, ও অফিস থেকে খরচ পায় না বলে বৌয়ের চিকিৎসা করাতে চায় না। রুমা চিকিৎসা বলতে বোঝে শুধু ওষুধ গেলা।
খিটিমিটির দিনগুলোয় এসব তুচ্ছ পারিবারিক ব্যাপার মনে পড়ে। তার ওপর যদি ট্রেনে বসার জায়গা পাওয়া যায় কিন্তু কোনও পরিচিত মানুষের দেখা না হয়। ধীরেধীরে মনটা বেলঘরিয়া ছাড়াতেই অফিসের ঝামেলায় নিমগ্ন হল। রুমা কয়েকদিন থেকেই মনে করাচ্ছে শেষবার অসুখ করার সময় এএমএ-কে দেখিয়ে সরকারি স্পেশালিটি হাসপাতালে দেখানো হয়েছে। চিকিৎসায় মোটা খরচও হয়েছে। সুতরাং অফিস থেকে মেডিকেল রিইমবার্সমেন্ট ফর্ম তুলে নিয়ম মতো আবেদন করে প্রেসক্রিপশন ওষুধের রসিদ ইত্যাদি জমা দিতে হবে। অফিসে হাজার কাজের ভিড়ে কখন যে এসব করবে অতীন? সাড়ে ছ’ হাজার লেবার পেমেন্টের কথা, তাদের যথাযথ ওটি বোনাসের কথা ভাবতে ভাবতে ফর্ম তুললেও ব্যাগে ঢোকতে ভুলে যায়। ফর্ম তুললেই তো হল না, আবার ডাক্তারের কাছে গিয়ে এনডর্স করানো আছে। ডাক্তারের দক্ষিণা দুশো টাকা হলেও সরকারি রেট প্রথম দর্শনি পঁয়ত্রিশ টাকা, দিত্বীয় বারে কুড়ি টাকা। এসব করে খরচ দাবি করার এক বছর পর আসল খরচের সিকি ভাগেরও কম হয়ত পাওয়া যায়। কোনও মানে হয় এসব ক্লেম-টেম করার? তবু বাড়িতে শান্তিরক্ষার জন্য বছরে কুড়িবার প্রাইভেট ডাক্তার দেখালে একবার সরকারি নথিভুক্ত অথোরাইজ়ড মেডিকেল প্র্যাকটিশনারকে দেখাতে হয়। আর দেখানো মানেই বৌয়ের গুঁতো, “ক্লেম করো”। দূর!!
অফিসে এখন কত কাজ। তার ওপর কন্ট্রোলার সকাল থেকে ডেকেছে। মেইন অফিসে গিয়ে ওদের পেপ্যাকেজ চালাতে কী অসুবিধা হচ্ছে তার সমাধান করতে হবে। গত সপ্তাহে পুনেতে যাওয়ার কথা ছিল একটা অফিসে অডিট করতে, আর কার্কির অফিসে প্যাকেজ শিখিয়ে আসতে। সেই অনুষ্ঠানসূচী বাতিল হয়ে গেছে। কিন্তু টিকিটটা ক্যানসেল করা হয়নি। সময় পেলে সেটাও করতে হবে। নইলে বাড়ি ঢুকেই জেরায় জেরবার হতে হবে। নিজে তো সারাটা দিন এলে গড়িয়ে ঘুমিয়ে কাটিয়ে দেয়। অথচ অতীনকে সব ঠিকঠিক করে যেতে হবে। ভালো লাগে? একটা ছুটির দিনও আরাম করে খবরকাগজ পড়তে পায় না। সংসারে এতরকম কাজ পড়ে থাকে। বাজার করা, মেশিনে কাপড় কাচা, একটু আধটু রান্নাতেও হাত লাগানো, রবিবার সকালে গুবলুকে নাচের স্কুলে নিয়ে যাওয়া। আচ্ছা এই কাজটা তো রুমাও করতে পারে। না হয় মেয়েকে ক্লাসে নিয়ে গিয়ে খানিকটা আড্ডা মেরে আসত। কিন্তু রুমা বেরোতেই চায় না। আর বেরোলেই ফিরে এসে ঢিকিস-ঢিকিস করে এত দেরি করবে যে, নাওয়া খাওয়া সারতে অনেক বেলা হয়ে যায়। মা ঠিকই বলে, এসব মেয়ের সংসার করার কোনও যোগ্যতা নেই। মায়েরা খেটে খেটে সংসারের ধকলে অসুস্থ হয়ে পড়ত; আর রুমা কুঁড়েমি করে করে শরীরে হাজারটা আধিব্যধি ডেকে আনছে। তাই মেয়েকে সকালে নাচ শেখাতে নিয়ে যাওয়ার দায়িত্ব অতীনের ঘাড়ে। যেদিন বিকেলে ক্লাস থাকে সেদিন ভাগ্যিস ওর অফিস, তাই মেয়ের মাকেই নিয়ে যেতে হয়।
আজ অযথা দেরি হয়ে গেল। ঠিক বেরিয়ে আসার মুখে প্রিন্সিপাল কন্ট্রোলারের তলব। এদের ধারণা কম্পিউটার ম্যাজিক করতে পারে। এমন এমন সব রিপোর্ট  চায়, যেটা ঐ আকারে কিছুতেই তৈরি করা সম্ভব নয়। বেশ কিছু ফিল্ড আছে যার জন্য ফ্যাক্টরি ইনপুটের প্রয়োজন। সেটা হাতে না পাওয়া পর্যন্ত জেনারেল রিপোর্টই জেনারেট করা সম্ভব নয়, তার ওপর আরও চারটে ফ্যাকড়া জুড়তে চাইছে। এগুলোর জন্য আলাদা প্রোগ্রাম লিখতে হবে এবং সেটা যে কোনওভাবেই মূল প্যাকেজের সঙ্গে লিংক করা সম্ভব নয়, তাই রিপোর্টও হবে আলাদা, এসব কে বোঝায়? দত্তদা আর সিং-কে তো উড়িয়েই দিচ্ছিলেন প্রিন্সিপাল কন্ট্রোলার। অতীনকে একটু পাত্তা দেন। অতীন ঘরে ঢুকতেই বললেন, “অতীন, তুম মুঝে সমঝাও ইয়ে ক্যায়সে নেহি হোগা?”
ভাগ্যিস ডেপুটি কন্ট্রোলার শুভ্র সামন্ত ওখানে ছিল। লোকটা সরাসরি সিভিল সার্ভিস পাস করে অফিসার হয়ে এলেও শুধু ছড়ি ঘোরানোর বদলে বাস্তবতাটাও বোঝে। প্রোগ্রামিং না হলেও সামান্য কিছু প্রসেসিং-এর জ্ঞান আছে। অতীনের চেয়ে আট বছরের ছোট। কিন্তু সরাসরি আই.এ.এস অ্যালায়েড উৎরে ক্লাস ওয়ান অফিসার হিসাবে ডিপার্টমেন্টে অ্যাসিটেন্ট কন্ট্রোলার হয়ে এসে অতীনদের বস। তবে ছোকরা আসা অব্দি অতীনদের অফিসে আমলাতন্ত্রিক গেরো খুলে নতুন যুগের প্রযুক্তিগুলো দ্বার ক্রমশ প্রশস্ত হচ্ছে। শুভ্র অতীনকে পাশে পেয়ে নিজের জায়গা থেকে অতীনের ব্যাখ্যাটা বড়সাহেবের কাছে কিছুটা গ্রহণযোগ্য করে তুলতে পারল শেষ পর্যন্ত। এতক্ষণ অতীনের অনুপস্থিতিতে প্রিন্সিপাল কন্ট্রোলারকে বোঝনোর চেষ্টা চালিয়ে শুভ্র সামন্তর মুখেও ফেনা উঠে গিয়েছিল। অতীন মিটিং-এ আসার পর বড়কর্তাও একটু নরম হলেন। কিন্তু কাল এই ব্যাপারটাই আবার দিল্লি থেকে আসা দুই মুরুব্বিকে বোঝাতে হবে। তার মানে কাল এই অফিসের কাজ গুছিয়ে মেইন অফিস যেতে হবে।
বাড়ি ফিরতে বিকট দেরি হল। সাধারণত দেরি হলে অতীনের রুমাকে ফোন করে জানানোর কথা, না হলে রুমা অকারণ দুশ্চিন্তায় ভোগে। কিন্তু নিজের মোবাইলটা ভুলে বাড়িতেই ফেলে গিয়েছিল, আর অফিসের ফোনে ব্যাক্তিগত কথা বলা অতীনের নীতিবিরুদ্ধ। রুমার মতে যখন কেউ অফিসের কাজেই আটকে যায় তখন অফিসের ফোন থেকে জানিয়ে দেওয়াটা অন্যায় নয়। কিন্তু অতীন পারতপক্ষে সেটা করে না। কাজের চাপে ভুলেও যায়। বাড়িতে ঢুকে রুমার মধ্যে উদ্বেগের বদলে একটু চনমনে ভাব দেখে মনে হল ও নিশ্চয়ই সেকশনে ফোন করে ওর হঠাৎ মিটিং-এ আটকে পড়ার খবরটা পেয়ে গেছে। বছর পাঁচেক আগে নিজেদের ফোন ছিল না, রুমা এসটিডি বুথে গিয়ে ফোন করত, আর অতীন না ফেরা পর্যন্ত রাস্তায় উদ্বিগ্ন হয়ে পায়চারি। আগে আগে বৌয়ের এই ব্যাকুলতাটা উপভোগ করত অতীন। এখন বাড়াবাড়ি মনে হয়, বিরক্ত লাগে।
বাড়ি ফিরে সাধারণত দেখে অগোছালো সংসার। আজ মনে হল একটু ব্যত্যয় হয়েছে। রুমা নিশ্চই হেঁচে-টেচে অ্যাভিল খেয়ে কাহিল হয়ে আছে। কোনো কোনো দুর্লভ তিথিতে ওর কাজে উৎসাহ জন্মায়। নয়তো বিমর্ষ হয়ে সারা দিন শুয়ে কাটিয়ে দেয়, আর রাত জেগে ওপাশ ওপাশ করে।
“গুবলুর জন্য যে মডেল কোঅর্ডিনেটরকে যোগাযোগ করেছিলাম, সে আজ ফোন করে আমায় অডিশন দিতে বলছে। কাল যোধপুর পার্কের এক জায়গায় যেতে হবে।”
মাথাটা গরম হয়ে গেল অতীনের। মেয়েকে দিয়ে মডেলিং করানোর শখের কথাই শুনেছে। রুমার নিজের শখই যে মেয়ের মাধ্যমে পূরণ করতে চায় তাও জানে অতীন। কিন্তু সে নিজে সংসার ফেলে মুখে রং মেখে শুটিং করতে যাবে এমনটা তো জানা ছিল না আগে। এর আগেও ও একবার অডিশন দিয়েছিল। সেদিন অতীন অফিসে সিএল নিয়ে বাড়িতে বসেছিল গুবলু স্কুল থেকে ফিরলে তাকে বাড়িতে এনে নাওয়ানো-খাওয়ানো করার জন্য। দোষে খালাস থাকা যাক। সত্যিই কি আর ও সুযোগ পাবে? কিন্তু রুমা একটা বিজ্ঞাপনের কাজ করে এল। দিনটা রবিবার ছিল বলে তেমন আপত্তি করতে পারেনি। বহু চরিত্রের ভীড়ে এক্সস্ট্রা বলে সেবার অতীন বিদ্রূপ করলেও খবরের কাগজে ছাপা বিজ্ঞাপণে দেখা গেল সবার মাঝে রুমার মুখখানাই বেশি স্পষ্ট। গত পুজোর সময় শ্বশুর শাশুড়ি এখানে থাকা কালে আবার একটা হিন্দী টিভি সিরিয়ালে পরপর তিন দিন কাজ করে রাত করে ফিরল। অসুবিধা না হলেও ভালো কি লাগে? তার ওপর এমন অপরিণত মেয়ে, যেখানে যাবে একটা ঝামেলা পাকিয়ে আসবে। ঐ কাজটার জন্য এখনও পারিশ্রমিক পায়নি বলে অতীনেরই মাথা খাবে। অতীন কি বলেছিল কাজ করতে?
কিন্তু এখন? নাও এবার ছুটির দিনে বাচ্চা সামলাও। এ আবার কী আপদ? এরকম ডাক মাঝেমাঝেই আসবে নাকি?
“তোমার মাথা ঘোরা সেরে গেছে? লাম্বার রিজিয়নেও তো ডিজেনারেশন ধরা পড়েছে। খুব ইমার্জেন্সি না হলে শরীরকে ধকল দেওয়ার কোনও মানে হয়?” ঘর গোছানোয় উৎসাহের কারণটা এতক্ষণে বোঝা গেল।
“বাড়ির কাজ সেরে সারাদিন তো শুয়ে বসেই কাটাই। এক-আধ দিন বাইরে গেলে কী হবে? সংসারের প্রয়োজনেও তো যেতে হয়, হয় না কি? আমার বদলে যদি শুধু গুবলুকে ডাকত, তহলেও তো তার মাকেই ছুটতে হোত।”
“আমায় কী করতে হবে? বার বার তো ছুটি নেওয়া সম্ভব নয়।”
“বিকেল চারটে নাগাদ যেতে বলেছে। আমি বলেছি বাচ্চার স্কুল থেকে ফিরতে আড়াইটে বাজে। খাইয়ে দাইয়ে ওখানে পৌঁছতে পাঁচটা বাজবে। বিমলদা বললেন ছটার মধ্যে পৌঁছলেই হবে। গুবলুকেও লাগবে। আমি চাবি রেখে যাব শম্পাদির কাছে। তোমার অসুবিধা হবে না।”
“যা ইচ্ছা করো। আমায় জিজ্ঞাসা করবে না। অফিস থেকে ফিরতে না ফিরতেই বসতে, জিরোতে একটু জল খেতে পর্যন্ত বলনি। তার বদলে নিজের হাবিজাবি খামখেয়ালের কথা বলছ। সত্যিই! ব্যাগটাও কি কাঁধ থেকে নামাতে দেবে না?”
“ও, স্যরি স্যরি। তুমি বসতে বসতেই শোনো। আর চাওমিন রান্না করা আছে, এক্ষুনি গরম করে দিচ্ছি। হাবিজাবি বলছ কেন? আশি বছরের বুড়িও মডেলিং করে। সুযোগ পাচ্ছি যখন হাতছাড়া করা কি উচিৎ? তাছাড়া এই কাজটা করলে হয়ত আগের পেমেন্টগুলো দিয়ে দেবে। বলেছিল পনেরো দিন পর পেমেন্ট করবে, একটা কাজ বছর পেরোতে চলল, আর একটা দুমাস হয়ে গেল। ফোন করলেই বলে একসাথে বেশ কয়েকটা কাজ করে এক সাথে মোটা টাকা হাতে নাও।”
“ ওসব আমার জেনে কাজ নেই। যতসব ছ্যাঁচোড় পাবলিকের খপ্পরে পড়া। চাওমিনটা কালকের না?”
“হ্যাঁ, আমি তো ইচ্ছা করেই দুদিনের মত করে রেখেছি।”
“যা জোটে। তুমি ব্যস্ত হয়ে গেলে তো …”
অতীন বাথরুমে ঢুকে পড়ল। দরজাটা একটু শব্দ করেই বন্ধ করল মনে হয়। এত দিন চাকরি চাকরি করে মাথা খাচ্ছিল, এখন মাথায় ঢুকেছে অভিনয় মডেলিং। বিয়ের আগে থেকে করলে এক রকম হত। এখন বাচ্চা ফেলে, সংসার ফেলে… ওহ্ আর ভালো লাগেনা। গুবলুর কাজ হলে তাও একরকম। মেয়েটা বছরখানেক বয়সে দুটো কাজ করেছে। তারপর আর কেউ ডাকেনি। পরে যখন আবার রুমা উঠে পড়ে লাগল, তখন মেয়ে কয়েকটা অডিশন ভালো দিয়েও কাজ পেল না। উল্টে তার মাকে অডিশনে শ্যুটিং-এ ডাকাডাকি শুরু হয়ে গেল! এখন গুবলু লাজুক হয়ে গেছে। ও আর ক্যামেরার মুখোমুখি হতে চায় না। মেয়েই যদি কাজ না করে, মা এই বয়সে কী করবে, কত দূর যাবে? যতসব পাগলামি! আর অতীন, সে কি ছুটি নিয়ে ঘরে বসে থাকবে? রুমার মা-বাবা ছোট মেয়ের চাকরির জন্য তাদের ছেলেকে দেখার জন্য কুঁদঘাটে আছেন। বড় মেয়ের সংসারের দায়িত্ব কি তাঁরা নেবেন? এখনও পর্যন্ত কোনও চাকরির ক্ষেত্রেও তো তাঁদের সহযোগিতা পাওয়া যায়নি।
বাথরুম থেকে বেরোনো মাত্র রুমা আবার শুরু করল। “কিছু পরিস্কার করে বললে না যে।”
অতীন নিরুত্তর। রুমা কথা না বলিয়ে ছাড়বে না, ঘ্যান ঘ্যান করে যাবে।
“আমি কী বলব? তুমি তো ডিসিশন নিয়েই নিয়েছ।”
“কাল গিয়ে দেখি না। গুবলুর যদি নতুন কোনো কাজ হয়।”
“গুবলুর অজুহাতটা না দিলেও চলবে। তোমার শখ হয়েছে, তাই মেয়েকে কষ্ট দিয়ে ধকল দিয়ে নিয়ে যেতে চাও। শ্যুটিং-ফুটিং হলে আমার পক্ষে অফিস কামাই করে ঘর আগলানো সম্ভব নয়, এখন থেকে বলে দিলাম।”
“দুজনকেই লাগলে তো তোমায় ছুটি নিতে লাগবে না। আমার একার কাজ হলে উইক-এন্ড ছাড়া মুশকিল।”
“হ্যাঁ, আমার কাজ তো সারা সপ্তাহ অফিসে ঘাড় গুঁজে খেটে যাওয়া, আর ছুটির দিনে সংসার আর বাচ্চা সামলানো। তাও যদি বুঝতাম ভালো কোনো রোল।”
“ভালো রোল পেতে গেলে তো লেগে থাকতে হয়। আমার মা-বাবা কেউ এই লাইনের নয়, তোমার নিজের মাসতুতো দাদা প্রতিষ্ঠিত আর্টিস্ট। তিনি সহযোগিতা করবেন না। তাহলে এভাবে এগোনো ছাড়া উপায় কী বল?”
“এই বয়সে এগোনোর দরকারটাই বা কী বল? এখন মেয়েটার কথা ভাবাটাই প্রায়োরিটি হওয়া উচিৎ।”
“ মেয়েটা যাতে এখন থেকে এই দিকে কেরিয়ার তৈরি করতে পারে তার জন্যই তো এসব করা।”
“পড়াশুনোটা ঠিক মতো শিখলে বাকি সব অটোমেটিক্যালি হবে। আচ্ছা, আমার কিন্তু প্রচণ্ড খিদে পেয়েছে। জলখাবার খেয়ে আর কাজ নেই। একেবারে রাতের খাবার দিয়ে দিয়ো। নাকি সেটাও জুটবে না?”
“সে কী! তোমার সামনেই তো টেবিলে চাওমিন রাখলাম। চা বসিয়েছি। সেটাও হয়ে গেল। এখন তো আটটাও বাজে নি।”
“খাবারটা ছুঁড়ে দিলেই হল, না? বলার দরকার নেই। তখন থেকে শুধু নিজের কথা বলে যাচ্ছ। আমার যে কিছু বলার থাকতে পারে, আমার যে ক্লান্ত লাগতে পারে, এগুলো কখনোই তোমার মাথায় থাকে না”। অতীন ব্যাজার মুখে জলখাবারের প্লেট টেনে নিল।
রুমা দীর্ঘশ্বাস ফেলল। অতীন কি খেয়ালই করল না, আজ ঘর দোর তক-তক করছে? অডিশনে ডাক পাওয়াটায় এত বিরক্ত! অনেক দিন পরে একটু ভালো মেজাজে ছিল মনটা। আবার কেমন বিষন্ন হয়ে গেল। কাল বেরোনোর আগ্রহটাও যেন ফুরিয়ে গেল। বরং অ্যান্টি অ্যালার্জির জন্য সদ্য আরাম পাওয়া অনুভূতিটা ঝিম ধরা ঘোরের পরিবর্তে কেমন যেন আনচানানিতে পরিণত হল।
অতীন ঝকঝকে আসবাবগুলোতে চোখ বুলিয়ে গুবলুর আলমারির অগোছালো ধূলোধূসরিত মাথাটা দেখল। বুঝল, শ্যুটিং-এর ডাক পেলে ওটার পালা আসবে।

ক্রমশ….

ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *