• Uncategorized
  • 0

সাপ্তাহিক ধারাবাহিকে বিতস্তা ঘোষাল (পর্ব – ৯)

কু ঝিক ঝিক দিন

৯.

আমাদের ছোটোবেলায় অজস্র জামা ছিল না।প্রচুর আত্মীয় স্বজন থাকলেও পুজোর সময় হাতে গোনা দুটো, তিনটে জামা হত।আর পয়লা বৈশাখ একটা।অনেক সময় সেটা সুতোর কাজ করা টেপফ্রকেও দাঁড়াতো।জামাগুলো মা একটা থানকাপড় কিনে এনে নিজেই বানাতো।এবং তিনটেই একই রকম স্টাইলের।মনে হত ব্যান্ড পার্টি কিংবা স্কুল ইউনিফর্ম।
কিন্তু তা নিয়ে কখনো কোনো মন খারাপ ছিল না।কারন জামা কাপড় সেকেন্ডারি বিষয়।আসল জিনিস হল নতুন কিছুর মজা।এই মজাটা হতে পারে বাবার সঙ্গে আউট্রামঘাটে গিয়ে পয়লা বৈশাখ, পয়লা জানুয়ারি আইসক্রিম পার্লারে বসে মন পসন্দ আইসক্রিম খাওয়া,তারপর অম্বর,সোনালী, গ্রান্ড ওবেরয় কিংবা জিমিস কিচেনে ডিনার সেরে বাড়ি ফেরা,অথবা এ্যডমিনিসস্ট্রেটিভ ট্রেনিং ইনস্টিটিউট (এ টি আই)এ গিয়ে সেই বিশাল লনে নানান খাবার খাওয়া,ব্যাট মিন্টন খেলা,অথবা এসব কিছুই না, ষষ্ঠীর ভোরে বাক্স প্যাটরা বেঁধে আজিমগঞ্জ যাওয়া।সেখান থেকে সোজা রামপুরহাট।
এসব দিনে জামা কটা হল আর কি জামা হল সেটা পরোয়াও করতাম না।মাসতুতো,খুড়তোতো ভাইদের সঙ্গে, এমনকি আশেপাশের সবার সঙ্গে এমনি মেতে থাকতাম যে কি জামা কবে পড়েছি কতবার পড়লাম তা নিয়ে মাথা ব্যথা ছিল না।
তবু মাঝে মাঝে হয়তো বছরে একবার একটা অন্য রকম জামা পরার শখ হতো।সেই দিনটা ছিল বাবার ঘনিষ্ঠ বন্ধু আই এ এস সুজিত জ্যেঠুর মেয়ে বা ছেলের জন্মদিনে।আমরা সবসময় ফ্রকই পরতাম।কিন্তু জয়তী ছোট স্কার্ট টপ, প্যান্ট টি শার্ট,ড্রেস, হাফ প্যান্ট আরো কত নাম না জানা পোশাক পড়ত।মর্ডান হাই স্কুলেতে পড়া সে বাংলায় কদাচিত কথা বলত।আমরা পাতি বাংলা মিডিয়ামে পড়ি।দু একটা কথা বলেই চুপ করে যেতাম।সে আর তার বন্ধুরা,যাদের বাবারা সবাই প্রায় প্রশাসনের সর্বোচ্চ স্তরে, তারা আমাদের খুব যে পাত্তা দিত তা নয়।কিন্তু বাবাকে খুব ভালোবাসত।আর জ্যেঠুও আমাদের খুব ভালোবাসত।তাই আমাদের যেতেই হত।
তিনবোনের প্রায় একই রকম পোশাক,পায়ে লাল ভেলভেটের চটি আর মাথায় জাপানি ক্লিপ।এই ক্লিপগুলো জ্যেঠুই এনে দিয়েছিল জাপান থেকে।
জয়তী আমাদের সঙ্গে বাংলায় দু একটা কথা বলে নিজের বন্ধুদের সঙ্গে ব্যস্ত হয়ে যেত খেলায়,গল্পে।আমরা তখন সেই বিশাল বাংলোতে খুঁজে নিতাম আমাদের মতই কোনো বাংলাভাষী বন্ধুকে।
আর সেই একটা দিনই মনে হত ইস্ এমন যদি জামা থাকত আমাদের! তবে এই মন খারাপ এতটাই সাময়িক ছিল যে বাড়ি ফেরা মাত্র তা ভুলে যেতাম।
আমাদের খুব সুন্দর জামা দিত মম দিদি।বাবার বন্ধুর মেয়ে।অবশ্য তা স্কার্ট বা প্যান্ট জাতীয় কিছু না।চুড়িদার।কিন্তু সেগুলো দেখতে খুব সুন্দর হত।সে সব পোশাক তোলা থাকত বিশেষ বিশেষ দিনের জন্য।আর একটু বড় হয়ে বিশেষ দিনে আমার জন্য শাড়ি বরাদ্দ হল।কখনো মায়ের,কখনো মাসির,কখনো কাকিমার শাড়ি।
তখন ক্লাস সিক্স।আমি লেডি।কাজেই শাড়ি পরাটাই বাঞ্ছনীয়। ব্লাউজ কিন্তু মায়ের গায়ের,সেলাই করা। অথবা নাচের জন্য বানিয়ে দেওয়া লাল ব্লাউজ।
জুতোর কথা তো আগেই বলেছি।অবশ্য সেটা চটি।স্কুলের জন্য কালো আর সাদা জুতো,আর হাওয়াই চটি সবসময়ের জন্য। তাতে অবশ্য কোনো সমস্যা ছিল না।কারন স্কুল থেকে ফিরে খেলতে নেমে গেলে সব জুতোই রাস্তার এক ধারে। পিট্টি,ডাংগুলি,কুমির তোর জলে নেমেছি,চু কিত কিত,ক্রিকেট, এল ও ডি ও এন লন্ডন, এক্কা দোক্কা, কিম্বা রুমাল চুরি,চোর ধরা,ধাপ্পা এসব কোনো খেলাতেই চটির দরকার ছিল না।ফালতু চটি পড়ে খেলার অসুবিধা ঘটানোর কোনো মানে নেই।
আর একটা জিনিস ছিল।কোনো জেন্ডার ভাগ ছিল না।ছেলে মেয়ে সবাই একসঙ্গে খেলতাম।কারোর কোনো আপত্তি ছিল না।অবশ্য কেউ কেউ আমাকে দেখিয়ে বলত বটে এত বড় ধিঙ্গি মেয়ে কেমন ছেলেদের সঙ্গে খেলে।তাতে আমার কিছুই যায়ে আসত না।কারন মা কখনোই এগুলো নিয়ে বকাবকি করত না।
এছাড়াও ছিল ব্রতচারী।সাড়ে চারটে থেকে সাড়ে পাঁচটা পাড়ার সব ছেলে মেয়ে কালিতলা মাঠে ব্রতচারী শিখতাম।তারসঙ্গে বাঁশি, ডাম্বেল,ড্রাম,লাঠির খেলাও শিখতাম।উৎসবের দিনে আমরা কুচকাওয়াজ করতে করতে পাড়া প্রদক্ষিণ করতাম।
একবার ঠাকুর বিসর্জনে আমাদের নিয়ে যাওয়া হয়েছিল।তখন আর কত বড়!ক্লাস ফাইভ হবে।সিঁথি থেকে ডানলপ হয়ে গঙ্গার ঘাট।হেঁটে হেঁটে ড্রাম আর ঝুমুর বাজিয়ে চলেছিলাম আমরা।ফেরার পথে পেয়েছিলাম শুকনো লুচি,আর আলুর দম।তা তখন পচে গেছে।
সেদিনই ছিল আমাদের ব্রতচারী শেখার শেষ দিন।কারন বাবা দূর থেকে দেখেছিল তার মেয়েরা এভাবে রাস্তায়। বাড়ি ফিরে পা ফুলে ঢোল হয়ে গেছিল।সেদিনের পর আর কখনো ক্লাবে যাওয়া হয়নি।শুধু মাত্র ছাব্বিশে জানুয়ারি বা ১৫অগস্ট পতাকা তোলার সময় যাবার ছাড়পত্র মিলেছিল।
অবশ্য ধীরে ধীরে সে সব বন্ধ হয়ে গেল।পাড়ার মধ্যেই খেলতে খেলতে কেটে গেল ছোটো বেলা।
তবে আমি সন্দিহান আজও দুই বোনের বড় দিদি আমি,আমার কী কোনো ছোটোবেলা ছিল!নাকি সবটাই ছিল বড় বেলা!কে জানে!

ক্রমশ…

ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।