সাপ্তাহিক ধারাবাহিকে অর্ঘ্য রায় চৌধুরী (পর্ব – ৬)

মুনকে লেখা চিঠিগুলোর থেকে

(ছয়)

মুন,
কিকউয়ী গ্রামটা লম্বাটে, দশ থেকে বারোঘর লোকের বাস।সবারই জীবিকা ওই বন থেকেই নির্বাহ হয়।ওরা ওই বন পাহাড়ের গভীর ভেতরে কাঠ পাতা কুড়ায়, মৌচাক খুঁজে বের করে।তারপর সপ্তাহ শেষ হয়ে এলে হাট বসে, সেখানে বিক্রি করে আসে।ওই হাটে পঙ্গারি, পাসুরে, শিরি এসব ছোট ছোট গ্রাম থেকেও মানুষ জড় হয়।বর্ষার সময় হাট বন্ধ থাকে।ওইসব বন পাহাড়ের মানুষ তখন ঘাসের বীজ সিদ্ধ বা বনের ফল খেয়ে বেঁচে থাকে।
ওইসব মাওয়ালী গ্রামের আরাধ্যা দেবী তুলজা ভবানী।গ্রামের একপ্রান্তে একটা ছোট্ট পাথরের মন্দির।মুখিয়া ব্রাহ্মণ, উনিই পুজো করেন, ছোট ছোট বাচ্চারা জড়ো হয়, খড়ি ওঠা খালি গা, ছেঁড়া প্যান্ট, ওখানকার ওই শীতে বা প্রবল বর্ষাতেও ওদের কোনও সেরকম পোষাক নেই।রুক্ষ চুল, বড়বড় চোখে পুজো শেষ হলে হাত পেতে দাঁড়ায় দুটো প্রসাদের আশায়।প্রসাদ বলতে দুটো মিছরির দানা, একটা খেয়ে একটা রেখে দেয় পরে খাবে বলে।ওরা চকোলেট দেখেনি কখনও, ওই সব বন পাহাড়ের শিশুরা ওটুকু পেয়েই লোভাতুর হয়ে ওঠে।খুশীতে চকচক করে ওঠে চোখ। আর আমরা? শহুরে মানুষ? প্রাচুর্যের চাপে আমাদের খুশিটাই হারিয়ে গেছে।
আমি ওদের জন্য একবার পুনে থেকে চকোলেট, আর পুজোয় প্রসাদ হবে বলে মিস্টি নিয়ে গেছিলাম।মুন, ওই চকোলেট পেয়ে ওদের সেই বিস্মিত আনন্দ, সেই উল্লসিত হাসিমুখ আমার দুচোখে বড় স্থায়ী হয়ে আছে।একটা শিশু আধো আধো বুলিতে বলেছিল, “তু উদয়া ভি আইছে কা সাহেব? মানে তুই কালকেও আসবি সাহেব?”
আমি বোঝাতে পারিনি আমি কোন সাহেব নই।ওদের শেখানো হয়েছে আমি পুনের সাহেব।পুনে অনেক দূরের বড় শহর।আমি ভদ্রলোক।আমাকে সাহেব বলতে হয়।
মুন, ভদ্রলোক! এইসব বন পাহাড়ের অভুক্ত, ক্ষুধার্ত দেবশিশুদের কাছে আমি এদের মতোই হতে চেয়েছি।এ আমার দেশ, এইসব প্রান্তিক মানুষের মধ্যে আমি আমার ভারতবর্ষকে বারবার খুঁজে পেয়েছি।যেভাবে চিনেছি তাতে কোন মেট্রোপলিটান সিটির শহুরে কেতা নেই, কিন্তু প্রাণ আছে, ছোট ছোট প্রাপ্তিতে ভরে ওঠা আছে।
গ্রামের এক প্রান্তে ছিল বিঠঠলের সেই ছোট্ট পাতার বাড়ি।সামনে একটু এগিয়েই বন, তারপর ধাপে ধাপে পাহাড় উঠে গেছে।ডানদিকে তাকালে সুনীল পাহাড় চোখ জুড়িয়ে দিত।সেইসব বৃষ্টিভেজা বনের ভেতর যে আমি কি খুঁজতাম বা কেন খুঁজতাম জানিনা।কিন্তু মনে হত, এই নির্জন উপত্যকা জুড়ে যে অপার্থিব সৌন্দর্য, যে প্রশান্তি, সে আর কোত্থাও নেই।আমি ওই বৃষ্টিভেজা বনের সুগন্ধে, তার রূপে, তার মাদকতায় আচ্ছন্ন হয়ে থাকতাম।
যখন পুরন্দর দূর্গ ঢেকে যেত মেঘে, দিগন্ত জুড়ে বৃষ্টি নেমে আসত।মনে হত যেন বহুদূর থেকে তার নুপূরের সেই ছন্দ বেজে উঠছে।সে আওয়াজ এখনও এইখানে বসে আমি শুনতে পাই।সমস্ত উপত্যকা জুড়ে নয়নাভিরাম সবুজ তার হৃদয় হরণ রূপটুকু নিয়ে যেন কার প্রতীক্ষায় বসে আছে।সেই বন পাহাড় উপত্যকার শ্রাবণ রাতের আলাদা ভাষা আছে, ছন্দ আছে।
যেন মনে হত সেই উপত্যকার বুকে কে যেন আমাকে ডেকে বলছে

“তুমি আমার রাত্রি হতে পার?
একটা গোটা রাত?”

বিঠঠল ঘুমাত, আমি ওই বৃষ্টিভেজা রাতের দরজা খুলে বাইরে এসে দাঁড়াতাম।ভিজতে ভিজতে মনে হত, আমার এক নতুন জন্ম হল।আমি মানুষ নই, এই বন পাহাড়ের কোন প্রাচীন বৃক্ষের মতো অনন্তকাল ধরে এখানেই দাঁড়িয়ে আছি।আমি ওই শ্রাবণ বনের রাতের ভেতর আমার বহুজন্মের প্রেয়সীকে পেয়েছিলাম।

চন্দ্রতাড়িত।

ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।