(১১)
পুরানো অভ্যাসগুলো অনেকটা টিকটিকির মতো, তাড়ালেও যায় না! প্রত্যেক রবিবার আমার যাপনে সেই টিকটিকি ফিরে আসে, তাকে আমি চাইছি কিনা সেই বিষয়ে তার কোনো ধার ধারার বালাই নেই; আর নেই বলেই হয়ত আকাশ রৌদ্রাচ্ছন্ন থাকে। এই আকাশে আমিই একমাত্র পাখি হয়ে উড়ি। উড়তে উড়তে একসময় ক্লান্ত হয়ে যখন মাটিতে পা রাখি ঠিক তখনই শুরু হয় এক বৈমাত্রেয় কোলাহল।
যারা কোলাহল প্রিয় তাদের কোনো সমস্যা হবার কথা নয় কিন্তু আমি কোলাহলকে বরাবর এড়িয়ে যেতেই বেশি স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করি। এই অনুভূতির কথাটা একমাত্র আমার সাড়ে চার বছরের কন্যা শিঞ্চনী বুঝে ফেলেছে। সুতরাং রবিবার সে শান্ত থাকে।
ওই শান্ত থাকাটার মধ্যে আমি আলপনার শান্তি খুঁজে পাই। প্রতিদিন নিয়ম করে বাড়ির তুলসী মন্দিরের চারিদিকে যে আলপনা দেওয়া হয়, রবিবার যেন সেটা আরো উজ্জ্বল হয়ে আমার চোখে ধরা পড়ে। সেটার মধ্যেই জীবনের গোপন সমস্ত জলতরঙ্গ লুকিয়ে রাখতে গিয়ে এক এক সময় একটা কস্তুরী গন্ধ মন ছুঁয়ে যায়। মনে পড়ে যায়, জীবনই তো একটা আস্ত মৃগয়াক্ষেত্র, এক অবাধ চারণ ভূমি…
সবুজ ঘাসের ওপর নরম চাঁদের আলোয় মাথা রেখে মন গেয়ে ওঠে — “মন্দির বাহির কঠিন কপাট/চলইতে শঙ্কিল পঙ্কিল বাট…”
আর তৎক্ষণাৎ সেই অবাধ্য টিকটিকিটা কর্কশ স্বরে আবার ডেকে ওঠে!
(১২)
আজ দোল পূর্ণিমা। রং খেলছে সবাই। আমার জানলার বাইরে যে আকাশটুকু আমার নিকট আত্মীয়, সেখানেও রঙের ইশারা। গাছের পাতায় পাতায় আজ রঙের খেলা চলছে, উৎফুল্ল মেঘে মেঘে আজ উৎসবের আয়োজন…
এই দেহভাণ্ড ছুঁয়ে রং অনায়াসেই পৌঁছে যাচ্ছে পঞ্চেন্দ্রিয়ই। নদীর পলিতে যে বিশ্বাস থাকে তেমন বিশ্বাস পৃথিবী যেন ক্রমশই হারিয়ে ফেলছে! এখনো যেটুকু রয়ে গ্যাছে তাতেই ফুল আর নারীর সুষমা বাউণ্ডুলে বাতাসকে রঙিন আলিঙ্গনে মাতিয়ে দ্যায়; তবুও আমার মন আজ কিছুতেই যেন সায় দিচ্ছে না! যে রং অন্ধকারের হাতছানিতে নিজের জিভকে দ্বিখণ্ডিত করতে পারে সেই রঙে আর নিজেকে রাঙাতে ভালো লাগে না।
সব পাখি ঘরে ফিরলে কে যেন পরম মমতায় আমাকে গান শোনায়- ‘রূপের পাথারে আঁখি ডুবি সে রহিল…’
(১৩)
শুধুমাত্র একাকিত্বে কখনো কোনো জোড়াতালি থাকে না, কেউ এমন অভিযোগ কখনো করেছে বলেও শুনিনি; তাই মেঘেরা এমন নিশ্চিন্তভাবে ভেসে বেড়াতে পারে, ওদের কোনো একাকিত্বও নেই; নদীরও থাকে না।
যদিও ঠিক আমার মতোই গাছেদেরও একাকিত্ব থাকে, আর একাকিত্বে ভোগে দুপুরের নিশ্চয়তাগুলো। অথচ তোমাকে এত রেগে কথা বলতে আমি আগে কখনো শুনিনি, আজ যখন শুনলাম, তখনও ছিল ঠিক একাকীত্বে ভোগা এক অখণ্ড দুপুরবেলা; এটাই ব্যতিক্রম, অখণ্ডতার মধ্যেও যে একাকিত্বের মিশ্রণ, তার নিশ্বাসে একটা চোরাস্রোত থাকে, যেটা আজকেই প্রথম বুঝতে পারলাম, আর চিনলাম প্রতিটা মুহূর্তের সূচনায় লুকিয়ে থাকা এক ভোরের বাতাসকে। সেই বাতাসে খসে পড়া পাতারা যেমন উড়ে যায় তেমনই আজ তোমার রাগত কণ্ঠও সুর তুলেছিল, ‘সমুখে ওই হেরি পথ, তোমার কি রথ পৌঁছবে না এই দুয়ারে…’
এই অনুভূতি খসে যাওয়া পাতারা বোঝে তাই নিঃসঙ্গতা তাদের কষ্ট দেয় না, বরং অনাগামী বসন্তকে তারা আহ্বান জানাতে উদগ্রীব হয়ে উঠলে আবহ সংগীত ভেসে আসে- ‘বুঝি-বা ফুল ফুটেছে, সুর উঠেছে অরুণবীণার তারে তারে।’
(১৪)
মুহূর্তের মধ্যেই মানুষ কত বদলে যায়! প্রতিটা মন থেকে মনান্তরে এই বদলের রূপরেখা ঠিক যেন এক একজন প্রান্তিক চাষি! ওরা খুব সহজেই গান ধরতে পারে, আবার কখনোবা সেটা পারেও না, কেউ কেউ নিজের অজান্তেই আপনি আপনিই মনের খেয়ালে সম্পূর্ণ ভিন্নার্থে গেয়ে ওঠে- ‘না জানে আপন পর, সকল বসায়ে ঘর, কারো পানে ফিরিয়া না চায়…’ প্রতিটা পাখি ডানা ঝাপটে যদি একই কথা বলত তাহলে সেখানে নারী পুরুষ ভেদাভেদ হত না, মানুষের বেলায় হয়।
আজকাল ভোর বেলায় যতটা আলো বর্জন করি ঠিক ততটা আলো রাতের বেলা আমাকে শোষণ করতে হয়, এটা নাকি আমার নিছক একটা বদ অভ্যাস! এমন কথা তুমি মাঝে মাঝেই বলো, যেটা বলো না, সেটাও আমি জানি। আর জানি বলেই পর্ণমোচনে ভয় পাই! অথচ দ্যাখো, এই একই কাজে গাছ কতটা আমোদ উপভোগ করতে পারে। ঝরে যাওয়া পাতাগুলোই বসন্তে ওদের অগ্রদূত; আর আমরা…
প্রতিটা প্লাটফর্ম নিজের গল্প শোনাবে বলেই রেল আসার অপেক্ষায় উৎকণ্ঠা নিয়ে তাকিয়ে থাকে, কত কথা বলার থাকে তার। রেল আসে আবার চলেও যায়, কথার অধিকাংশটা বাতাস শুষে নেয়।অথচ আমার আলো শোষার মতো এরও কোনো বদল হয় না…
(১৫)
কখনো কোনো আতঙ্ক মেঘের থেকেও বেশি সতর্কতায় এড়িয়ে যেতে হয়, রোদের আলগা বাঁধন গাছের পাতাকে যেমন নতুনভাবে খাদ্য অন্বেষী করে তোলে তেমনই সতর্কতাও ভয়ের আগ্রাসী খিদেকে নিবারণ করে নরম স্পর্শে মাটির ধারণ ক্ষমতাকে আকাশচুম্বী করে তোলে; ওই আকাশেই মেঘেরা সতত সাবলীল।
রোজকার মতো আজও যখন প্রভাতফেরির শেষে একটা চায়ের দোকানে এসে ঢুকলাম তখন এমনই একটা আবাসনে আমি চুপচাপ স্বেচ্ছাবন্দী। সেলফ কোয়ারেন্টিন। অন্যদিন এমন সময় কথারা কবিতা হতে ছটফট করে, কিন্তু আজ করল না! এই পরিবর্তনে আবহাওয়া পরিবর্তিত হয়। মানুষ আর মন আলাদা আলাদা হৃদপ্রকোষ্ঠের অধিবাসী হতেই বেশি পছন্দ করে। নাভিমূল থেকে উত্থাপিত শাক্ততন্ত্রের প্রতিটা পর্বকে আমি পুষ্প স্তবকে বিন্যস্ত করতে গিয়ে দেখেছি প্রতিটা পুরুষালি মুদ্রাদোষ রাইসঙ্গ পাবার জন্য ঈষদুষ্ণ মশগুল থাকে। বিলম্বিত সুর জন্মান্তরের বংশীধ্বনিকে আজীবন খুঁজে ফেরে; তবুও বিচ্ছিন্ন দ্বীপগুলো এতটাই প্রবল স্বাতন্ত্র্যমণ্ডিত যে, তাদের অস্বীকার করার উপায় থাকে না; প্রতিবারই যমুনার জল তার সাক্ষী না থাকলেও পূর্ণিমার আকাশ প্রত্ন জোছনায় নিজেকে সাজাতে বেশি পছন্দ করে, সেখানে কোথায় আতঙ্কের করালগ্রাস?
শুধু কিছু সতর্কতা বিজন সমীরণে গেয়ে ওঠে, ‘ আপন আপন চিনেছে যে জন…’