কখনো বা শীতের মনোরম শহরের এস্প্ল্যানেডে অথবা কখনো বা ভরা বর্ষার কলকাতার ক্যাকোফনি আর ছবি গোছানোর নেশায়। বারবার খুঁজে যেতাম, এখনো খুঁজি, হয়তো পেতে পেতে হারিয়ে ফেলি, আবার হারাতে হারাতেও টুপ্ করে মুহূর্তগুলো খসে পরে দু-হাতের ভাঁজের ফাঁকে। ‘অ্যালবাম’-হ্যাঁ। কখনো বা সোনালী-রুপোলি তবকে কোণাগুলো সযত্নে মুড়ে রাখা কালো অ্যালবাম পেপার আবার কখনো বা সাম্প্রতিক ডিজিটাল প্রিন্টে জীবন্ত হওয়া রক্তগোলাপ আর খাঁজকাটা স্যাফ-গ্রীন রঙের পাতা-অ্যালবাম সেই চিরন্তন। অ্যালবাম যদি হতো(হয়ও)দার্জিলিং প্রিন্ট তবে তো কথাই নেই, সেটা কয়েকদিন ঘষা- মাজা করে রাখার পর, মলাট খুলে সোজা বইয়ের তাকের ফাঁকে ফেভিকল দিয়ে আটকে দেওয়া।
কোন ছবিটায় আমি, বাবা আর মা থাকবো (সেটা অবশ্যই অ্যালবামের প্রথম পাতায় থাকবে, কারণ তখনও ছোট বোনকে বেশ গুণ্ডামিতে পরিপক্ক একটি বিচ্ছু বলে মনে করি, ফলত তার ছবি বেশ পরে!), পোষা টিয়াপাখির ছবিটা কেন একদিকে হেলে আছে, কিংবা আমার ব্যাঁকা ঝুঁটি করা ছবি আপ্রাণ লুকিয়ে রাখার প্রচেষ্টা, আসলে ছোটবেলায় অ্যালবাম মানে আমার কাছে প্রবল একটি অন্বেষণের বিষয়! প্রিয় মিসের ফটো থেকে শুরু করে ‘টিচার্স ডে’র গানবাজনার ফটো, টিফিনে মায়ের বানিয়ে দেওয়া পাটিসাপ্টা আর চিঁড়ের পোলাও, ঠাকুমার ছবি, অন্নপ্রাশনের নেড়িমুন্ডি আমি, বেলুনওয়ালার কাছ থেকে বেমালুম বায়নাক্কা করে কেনা লাল প্লাস্টিকের টেলিফোন-এই সবই তখন আমার অ্যালবাম-এ শোভা পেতো।
আসলে অ্যালবাম বললেও কম বলা হয়, কারণ বাবা মায়ের সাথে নেহরু চিলড্রেন্স মিউজিয়ামে ঘুরতে যাওয়া মানে আমি জানতাম একটা অ্যালবাম সেইদিন অন্তত কেনা হবেই। অ্যালবাম যদিও বা না পাওয়া যায়, অন্তত স্কুলের ক্রাফটের কাজের জন্যে কেনা স্ক্র্যাপবুকটা তো ড্যাবডেবিয়ে তাকিয়ে থাকবে কখন আমি এটা-ওটা-সেটা ছবি কেটে-সেঁটে নিয়ে পাতায় পাতায় নিজের শৈল্পিক নমুনা নথিভুক্ত করবো।
অ্যালবাম কখনো হারায়না। অঙ্কের খাতার পাশে বাবা মায়ের বিয়ের অ্যালবাম কোলে নিয়ে বসে পেন্সিল চিবোতে চিবোতে ভাবতাম, আমাকেও বেনারসি পরলে অভাবনীয় সুন্দরী দেখতে লাগবে (precocious মানে ইঁচড়ে-পাকা সেটা মা কয়েক ঘা মেরে শিখিয়েছিলো!)| ঠিক যেভাবে হাত মুঠো করে সূর্য্য ধরতাম ছোটবেলায়, রুমাল চোর খেলে এসে মায়ের কাছে চাউমিন খাওয়ার বায়না ধরতাম, বোনের কাছ থেকে কেড়ে নিয়ে নিয়ে ‘ওটাকে ট্রান্সিস্টর বলেনা ছাগল, ওটাকে বলে ওয়াকম্যান’ বলে ওর মাথায় গাঁট্টা দিতাম, আর ট্রামের পা-দানিতে দাঁড়িয়ে কখন সব্বার আগে লাফিয়ে নামবো সেটা মনে মনে অঙ্ক কষে নিতাম, ঠিক সেইভাবেই ছোটবেলার অ্যালবাম কক্ষনো বিবর্ণ হয়না, বরং তাতে রোজ রোজ প্রলেপ পরে আবার বেশ কিছু রঙের, ঠিক যেমন হাঁ করে, জিভ বের করে টপাস টপাস করে শিলাবৃষ্টির সময় শিল খেতাম, ভাবতাম ওগুলো বেশ রঙিন।হ্যাঁ মানে ছোটবেলার অ্যালবামগুলো এতটাই প্রাণবন্ত, রেলকম, ঝমাঝম টাইপের।
আমরা সাহিত্য হৈচৈ-এ প্রত্যেক শনিবার নিয়ে আসছি সেই মন-ভালো করার অ্যালবাম, ছোট্ট বন্ধুদের জন্যে তো অবশ্যই, আর সব্বাই যারা যারা ছোট্টবেলাগুলোকে আবার ফিরে পেতে চাও। তোমাদের গল্প, বায়না, কবিতা, আঁকা, ভালোলাগা, মন্দলাগা, দুষ্টুমি সবকিছুর জন্যে আছি আমরা টীম টেকটাচটক শনিবারের ‘হৈচৈ’ নিয়ে।