মেহেফিল -এ- কিসসা, সালহা উদ্দীন আহমেদ জুয়েল

চোখ

ছেলেটা আমার পাশে বসলো। হাতে ছড়ি, চোখে রোদচশমা, মুখে হাসি। আমি একটি বিয়ের নিমন্ত্রণে অতিথি। খাওয়ার টেবিলে ভিড়। বাইরে পেতে দেওয়া চেয়ারে বসে আছি। ভিড় কমুক।
আমার দিকে ফিরলো সে। মুখে হাসি। তাকানোর ভঙ্গিতে আড়ষ্টতা। বুঝে নিতে কষ্ট হলোনা, ছেলেটি অন্ধ। বছর পঁচিশেক হবে, বয়স। মার্জিত চেহারা। খুব যত্নে সিঁথি করে আঁচড়ানো চুল। ঘিয়ে রঙের ফতুয়ায় সম্ভ্রান্ত দেখাচ্ছে তাকে।
বুকে সূক্ষ্ম একরকম ব্যথা অনুভব করলাম। মানুষ কতো যে অসহায়!
“আমি কি একটু কথা বলতে পারি জনাব?”- লাজুক হাসিটা একটু বিস্তৃত হলো ছেলেটার, এ-কথাগুলো উচ্চারণের সময়।
আমি ঝুঁকলাম অল্প। “জ্বী? প্লিজ! বলুন প্লিজ?”- বয়সে আমার বড়ো সন্তানের বয়সী, তবু ‘আপনি’ বলতে বাঁধলোনা। কিছুকিছু মানুষের প্রতি অবচেতনেই সম্ভ্রম চলে আসে।
“হা হা! আমি নিশ্চিত ছিলামনা জনাব, আপনি ভদ্রমহিলা নাকি ভদ্রলোক। তবে সঠিকই ধরেছি। অন্ধের ইনট্যুইশন সাধারণত ভ্রান্ত হয়না, অধিকাংশ ক্ষেত্রে।”- এটুকু বলে, হয়তো বাহুল্য কিছু বলে ফেলেছে ভেবে, একটু সঙ্কুচিত হলো সে, মনে হলো।
অল্পক্ষণের বিরতি শেষে, পুনরায় আরম্ভ করলো বলা- “আমি আজ এখানে নিমন্ত্রিত নই। আমার বাবা নিমন্ত্রিত ছিলেন। উনি গত দু’দিন ধরে অসুস্থ খুবই। বিছানায়, টানা। আমাকে তো তেমন কোথাও পাঠানো হয়না, তাই একটু অস্বস্তিতে পড়ে গেছি। ভীতও, জনাব।”
আমি সহানুভূতিশীল হলাম। বাবার অসুস্থতা, কিংবা ছেলের ভীতির সরল স্বীকারোক্তির প্রতিক্রিয়ায়। অবচেতনে এমন ভাবনাও টোকা দেয়নি তা নয়, যে, ছেলেটি কি এমন আকুলিবিকুলি করে মূলত টাকাপয়সা সাহায্য চাওয়ার দিকে এগুচ্ছে, এরকম আর দশজন ভিখিরির মতো? কান খাড়া রাখলাম, মনোযোগও।
“আসতেই হয়েছে। বিকেলে উঠেছি গাড়িতে। হাতড়ে-হাতড়ে চলেই এলাম। আমরা জনাব বটেশ্বরতলায় থাকি। চেনেন তো? ওই যে! এশহর থেকে মাইল তিরিশের দূরত্ব, ওই দক্ষিণে।”- ছেলেটি ঠিকই ঘাড় ফেরালো, দক্ষিণ দিকে। অন্ধ মানুষের ইনট্যুইশন ভালো, ভুল বলেনি সে।
“এতো দূর এলেন! নিশ্চয়ই একাধিক গাড়ি পাল্টাতে হয়েছে! কোনো সমস্যা হয়নি?”- অকৃত্রিম উদ্বেগে জানতে চাইলাম।
“উঁহু। হয়নি তো! এজগতে অন্ধকে সাহায্য করে তো মানুষ! হাত ধরে রাস্তা পার করিয়ে দেয়, এক আঁজলা জল তুলে দেয় মুখে, কানের পাশে মুখ এনে ধরা গলায় জানতে চায়- ‘ক্ষিধা লাগছে ভাই? ভাত খাইবা?’, গাড়িতে তুলে দেয়, নামতে সাহায্য করে, নিজের সীটেই বসতে দেয় অনেকেই। আমার বাবাও যদি অন্ধ হতেন!”- একটু কি শ্লেষ ছিলো শেষের বাক্যটায়? আমি তীক্ষ্ণ দৃষ্টি ফেললাম ছেলেটির মুখের উপর। মানুষের চোখ ঢাকা থাকলে, কোনো অভিব্যক্তিই সত্যিকার অর্থে বোঝা যায়না। তবু, অশ্রুর গন্ধ পেলাম কি আমি!
“আম্মা এখনো, এইযে অ্যাত্তো বড়ো হলাম, চোখের আড়াল হতে দেননা একবারও। আজ বাধ্য হলেন। জানি তো, বোকা মা’টা কাঁদছেন ফুঁপিয়ে, ঘরে। আমার প্রায়ই মনে হয়, পৃথিবীর মায়েদের আঁচলে ঘুমোবে বলেই অশ্রুরা জন্মায়। জনাব, একটু সাহায্য করতেন যদি?”
আমি নড়েচড়ে উঠলাম! চোখের কোণে জল জমেছিলো আমারও। কিন্তু, সাহায্যের কথাটি শুনেই, কেমন যেনো বিরক্তি জমা হলো বুকে। এ-ও তবে ধড়িবাজ? আবেগ বিকিয়ে পেট চালায়? ছিঃ!
“যদি সাহায্যটা করতেন, রাত গভীর না-হতেই বাড়ি ফেরা হতো। কাঁদছে মা’টা। অ্যাত্তো বড়ো ছেলে হারায় নাকি কোথাও! বলুন তো জনাব? মায়েরা কী যে বোকা হয়! আমি জনাব এবার স্নাতকোত্তর দেবো। তবু রোজ জামা পরিয়ে দিতে হবে! নখ কেটে দিতে হবে যখনতখন! চুল বাড়ুক না-বাড়ুক, কেটে দিতে হবেই তাঁকে! এই যে সিঁথিটা! তেল দিয়ে অমন যত্ন করে এত্তো বড়ো ছেলের সিঁথি করে দেয় কেউ! হা হা! আম্মা করেন, এসব। হা হা!”
হঠাৎ থেমে গেলো! মনোযোগ সরেনি আমার, এখনো। তাই, শুনেই যাচ্ছিলাম। যেভাবে থেমেছিলো, সেভাবেই, হঠাৎই, আবার বলে উঠলো- “মানুষেরা জন্মায় কেনো জানিনা। জানিনা, মায়েরা, বাবারা, কোন্ সে মরণসুখে জন্ম দেন সন্তানের জীবন! একটি কুকুরছানা, তার মাকে ছেড়ে যায়না কখনো! একটি পাখির ছানা, রাত নেই, দিন নেই, মায়ের বুকের নিচে ঘেঁষে-ঘেঁষে থাকে! আমি জানি, একটি বৃক্ষও তার বুড়ো শেকড়ের পাশে সদ্য মাথা তোলা চারাটিকে অপার মায়ায় ঢেকে রাখে রোদঝড়বৃষ্টির বেদনা থেকে। দিনের পর দিন, মুখে ডিম্বকোষের ভিতরের সন্তান নিয়ে অভুক্ত কাটিয়ে দেয় কত্তো মৎস্যপ্রজাতি! আমি জানিনা, মানুষ কেনো জীবনের সমস্তটুকু নিংড়ে দিয়ে দিনের পর দিন অপেক্ষা করে একজন সন্তানের জন্মের আকাঙ্ক্ষায়! একজন অকৃতজ্ঞ জন্ম দিতে!”
থুতনি পেরিয়ে, অশ্রুর ফোঁটাটি গড়িয়ে পড়লো তার হাঁটুর উপর। আমি তাকিয়ে আছি; একফোঁটা অশ্রু কী অবলীলায় মানুষের সমস্ত বেদনা বুকে জড়িয়ে ভূমিষ্ঠ হয়, তা দেখলাম আমি। আমি বুঝতে পারছিনা, কী চায় মূলত সে!
“বাবা এই চিঠিটা দিয়েছেন। উনি তো লিখতে জানেন না, চাষা। লিখে দিয়েছি আমি। আর, চাষার বউটা, আমার মা’টা, বোকা, দিয়েছেন এই হারখানা। তাঁদের বিবাহের একমাত্র স্মৃতি। ভালোবেসে, আমার মাকে গড়ে দেওয়া আমার বাবার একমাত্র বিলাসী উপহার। সোনার এ-হার। আমি জনাব, চাষাপুত্র।”
পকেট থেকে ছোট্ট পুঁটলিটা বের করে, আমার দিকে এগিয়ে ধরলো সে। সোনার হার। ছেলেটা কি জানেনা, এ-পৃথিবীতে একমাত্র অমর ব্যক্তিটির নাম- লোভ! ছেলেটা কি শোনেনি, এরকম একটি সোনার হার আমার মতো আটপৌরে অগণ্য মানুষ এক ঝটকায় কেড়ে নিয়ে পকেটে পুরে হাওয়া হয়ে যেতে পারি মানববাজারে! ছেলেটা কি চূড়ান্ত নির্বোধ নয়? নাকি, অপারগ? বাধ্য? পুঁটলিটার পাশে একটা চারকোণা কাগজ, ভাঁজ করা।
“চিঠিতে লিখা- ‘তোমার জন্মের সময় তোমার মা মৃত্যুপথযাত্রী ছিলেন। টানা মাস উনি হাসপাতালে পড়ে ছিলেন, চেতন-অচেতন। অথচ, সদ্যোজাত তোমাকে তাঁর পাশে শুইয়ে রাখতে হয়েছিলো বাঁহাতের বেড়ে। তুমি ছাড়া থাকবেন না তিনি জীবনপ্রাপ্তির চিকিৎসালয়ে। নারীরা নির্বোধ নয় কোনোকালে, মায়েরা নির্বোধ ঠিক! তুমি বাড়ি নেই আজ দেড় দশক। তিনি কি বেঁচে নেই? আছেন। চাষাপুত্রের ছাপ তোমাকে অমর্যাদা দিচ্ছিলো। প্রিয় পুত্র, তুমি সুখী হও। তোমার মায়ের দোয়াটুকু সাথে রইলো অনন্তকাল। আজ, নতুন জীবনের শুরুতে তাঁর এ-ই প্রার্থনা- তুমি সুখী হও।’ জনাব, হাতজোড়ে অনুরোধ করি যদি, এই চিঠি আর পুঁটলিটা মঞ্চে বসা বরের হাতে দিবেন প্লিজ? বড়ো দয়া হয় তবে! এ-অমূল্য দান, একজন চাষাপুত্র হয়ে, ও-ভদ্রলোকের হাতে দিতে, বড়ো লজ্জা করে।”
মানুষ ঢুকছে, বেরুচ্ছে, খাবারের টেবিলমুখী। আমি বসে আছি। হাতে একটি পুঁটলি। বড়ো মায়ায় জড়ানো পুঁটলি। একজন অন্ধ বেরিয়ে যাচ্ছে, ধীরপায়ে। আমি জানিনা, আমার চোখ দু’টো কেনো অমন জ্বালা করে!
ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।