গারো পাহাড়ের গদ্যে রবীন জাকারিয়া

পড়ন্ত বিকেল

পড়ন্ত বিকেল ৷ ব্রহ্মপুত্র নদ ৷ রিজার্ভ নৌকো ৷
যাত্রী আমরা দু’জন বন্ধু ৷ চারিদিকে পানির ছলাৎ-ছলাৎ শব্দ ৷ আর পাড় ভাঙ্গার আওয়াজ ধপ, ধপ, ধপাস ৷ পেড়িয়ে যাওয়া চরগুলোতে শুনতে পাই ৷ হাঁক-ডাক, ছুটোছুটি নবজীবনেব উদ্যোম ৷ নারী-পুরুষ, শিশু-প্রবীন সম্মিলিতভাবে আবারও গড়ে তোলে ভাঙ্গা স্বপ্নের নয়া রাজ প্রাসাদ ৷ জীবন নাটকের একই দৃশ্য বারংবার দেখতে হয় তাদের ৷ বন্যা, নদী ভাঙ্গন, ভেঙ্গে যাওয়া ঘরের অবশিষ্টাংশ, গবাদী পশু, সন্তান-পরিবার নিয়ে এক চর থেকে অন্য চরে আবাস খোঁজা ৷ অনেকে ভীন কোন স্থানে চলে যায় ৷ পড়ে থাকে বেদনাতুর স্মৃতি ৷ পরিচিত বাড়ি, সেই মক্তব, হাজারো বন্ধু ৷ বড় গাছটি ৷ যার তলে বসে গাছ চুন্নি, গোল্লাছুট কিংবা বৌছি খেলা হতো সন্ধ্যে অবদি, মা রাগ করার আগ পর্যন্ত ৷ সবই এখন সর্বগ্রাসি ঐ নদীর বুকে ৷ ওদের বুকে রয়ে যায় বুক ফাটা কান্না ৷
সময় এখানে থমকে আছে যেন শতাব্দী থেকে শতাব্দী পেছনে ৷ বিদ্যূত নেই, চিকিৎসা, শিক্ষা, যোগাযোগ কিছুই নেই ৷
অথচ কী নিরাহংকার আর প্রাঞ্জল জীবন-জীবিকা
ভীষণ ঈর্ষে হয় ৷ তাই নৌকোটাকে দাঁড় করাই, পরিচিত হই, ভাল লাগে ৷ ওরাও আপন করে নেয়৷
আবার বৃষ্টি পড়তে লাগলো ৷
ফিরে আসি দাঁড়ানো নৌকোর কাছে ৷
তাড়াতাড়ি ফিরতে হবে যে ৷
পেছন থেকে কে একজন ডেকে উঠলো ৷
ফিরে তাকালাম ৷ এক মধ্য বয়সী নারী তার কিশোরী কণ্যার হাত ধরে এদিকেই আসছে ৷ আমি বললাম, “কিছু বলবেন কি?”
কিছুটা ইতস্তত বোধ করে বললেন, “বাবা আমার মেয়েটাতো পড়াশুনা করে তাই পাশের চরে ও ওর খালার বাড়ীতে থাকে ৷ তোমরা কি যাওয়ার পথে ওকে ওখানে নামিয়ে দেবে?”
আমি মেয়েটার তাকাই ৷ অভিভূত হই ৷ এত রোদ, বৃষ্টি, ঝড়-ঝঞ্জা, এত কষ্ট, কোন প্রসাধন নেই ৷ তবুও এত সুন্দর হয় কী করে মানুষ? এটাকেই কি বলে ন্যাচারাল বিউটি?
মনটা কেমন জানি করতে থাকে ৷ আচ্ছা আমি কি ঘামছি? না আর যাই হোক একে সাথে নিয়ে যাওয়া যাবে না ৷ ভেতরের মানুষটা বলছে “তুই পালিয়ে যা” ৷ আনমোনা হলাম ৷
বাবা তুমি কি কিছু ভাবছো? মধ্য বয়সী নারীর প্রশ্নে সম্বিত ফিরে পেলাম ৷ বললাম ঠিক আছে, ওকে পৌঁছে দেবো ৷
মেয়েটিসহ তিনজন উঠে বসলাম নৌকায় ৷ যাত্রা শুরু হলো ৷ পরিবেশটা গুমট লাগলো তাই মেয়েটির নাম জিজ্ঞাসা করলাম ৷ নাম বললো বিউটি ৷ যথার্থই নাম ৷ অদ্ভুত বিষয় হলো এই প্রথম কোন সুন্দর মেয়ের নাম শুনলাম বিউটি ৷ ইতিপূর্বে যত বিউটি দেখেছি সবই ছিল আগলি ৷ যেমন, লাকীকে দেখেছি ভাগ্যহীনা, কটা চোখ অথচ নাম সুনয়না, ভিক্ষুক অথচ নাম রাজা ইত্যাদি ৷ যাহোক পরিবেশটা হালকা করার জন্য ব্যাগে রাখা বিস্কুট, চানাচুর ও অন্যান্য শুকনো খাবার খেলাম একসাথে ৷
শ্যালো ইঞ্জিন চালিত নৌকোর প্রচন্ড শব্দ আর বাতাশের শোঁ শোঁ শব্দে ভাল করে একে অপরের কথা শুনতে কষ্ট হয় ৷ আমার বন্ধুটি সিগারেট খাবে বলে ছাদে চলে গেল ৷ কী জানি কেন মেয়েটি আরও কথা বলবে বলে গা ঘেঁষে বসলো ৷ বাদাম খাচ্ছি, কথা বলছি ৷ ও হালকা রসিকতায় হেসে উঠছে খিলখিলিয়ে ৷ আমি রোমাঞ্চিত হই কিন্ত প্রকাশ করতে পারিনা কিছুই৷ হঠাৎ করে কেন যে মেয়েটি আমার হাত ধরলো ৷ বোঝার জন্য ওর চোখের দিকে তাকালাম ৷ অবাক হলাম ৷ আচ্ছা চোখ দু,টৌ এমন লাগছে কেন? কেমন ঘোলা ঘোলা ৷ আবেদনে ভরপুর ৷ এড়িয়ে যাওয়া সম্ভব নয় ৷ কোন পুরুষই তা পারেনা ৷
পড়ন্ত বিকেল ৷ ব্রহ্মপুত্র নদ ৷ রিজার্ভ নৌকো ৷
সিগারেট খেতে যাওয়া বন্ধুকে বাদ দিলে ভেতরে যাত্রী আমরা দু’জন ৷ চারিদিকে পানির ছলাৎ-ছলাৎ শব্দ ৷ আর পাড় ভাঙ্গার আওয়াজ ধপ, ধপ, ধপাস ৷ এত আওয়াজের মধ্য থেকে অস্ফুষ্ট গোঙ্গানীর শব্দ কেউই শুনতে পারেনা ৷ এমনকি নৌকোর ছাদে ধুমপানরত বন্ধুটিও না
ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।