• Uncategorized
  • 0

মুড়িমুড়কিতে ইন্দিরা মুখোপাধ্যায় 

শ্রবণপুরাণ  

সুমনের দাদু কানে কম শোনেন। এ তাদের বংশগত রোগ। দাদুকে দেখে ঠাট্টা করতেও ভয় পায় বাড়ির সবাই। বিচিত্র কিছুই নয়। বংশগতি বলে কথা আছে জীববিদ্যায়। তবে সুমনের দাদু কানে কম শুনলেও পুরতত্ত্ব, কিংবদন্তী নিয়ে তাঁর অগাধ পাণ্ডিত্য। আজকাল কেউ কিছু বললেই উনি তাকে পুরাণে পর্যবাসিত করেন। এ হল তাঁর বয়সের গতি।
সুমন সেদিন কলেজ থেকে এসে বলল, জানো দাদু? এবার আমাদের কলেজ থেকে অঙ্কে অনার্সে একমাত্র ফার্স্টক্লাস পেয়েছে হিন্দোল। দাদু সেই শুনে বললেন ইল্বল? জানিস তো কে ছিল সে? কত বড় দৈত্য ছিল সে?
সুমন বলে জানি তো। বাতাপি আর ইল্বলের গল্পটা কতবার শুনেছি তোমার মুখে।
কথা না বাড়িয়ে সুমন চলে যায় নিজের কাজে। আবার একদিন সুমন বলল মা, কিঙ্কিনির দাদার বিয়েতে নেমন্তন্ন করেছে আমাকে। ওরা খুব বড়লোক। ওদের কি ফ্রিজ জানো? গোদরেজ আলমারীর মত ফ্রিজ।  মা বলল, কী ফ্রিজ রে? সুমন বলল হিতাচি। সবচেয়ে দামী ফ্রিজ নাকি। দাদু শেষ শব্দটি‌ই শুনতে পান কোনোমতে। অমনি কপচে ওঠেন নিজের মনে, ঘৃতাচী? সে তো সগ্‌গের অপ্সরা রে। সুমন হাসতে হাসতে বেরিয়ে যায় খেলতে।
কিঙ্কিনীর দাদার রিসেপশানে বন্ধুরা সবাই মিলে গিয়ে সেদিন প্রথম উন্মুক্ত বিয়েবাড়ির হ্যালোজেন ঝলমলে আকাশে ড্রোণ ওড়া দেখেছে।  আজকাল দামী বিয়েবাড়িতে ড্রোণ ভাড়া করে ফোটো তোলা হয় ওপর থেকে। বাড়ি ফিরেই দাদুর ঘরে ঢুকে সুমন বলল, জানো দাদু আজ একটা নতুন জিনিষ দেখে এলুম।  মা ছুটে এসে বলল, কী দেখলি রে? সুমন বলে চাক্ষুষ দেখলাম ড্রোণ । দাদু বললেন দ্রোণ? সেদিন তো শুনলি‌ই না ঘৃতাচীর গল্পটা। দ্রোণের মা‌ ই তো এই ঘৃতাচী। বউমা, তুমি জানতে না? মুখে আঁচল চাপা দিয়ে সুমনের মা ঘর থেকে বেরিয়ে যায়। শ্বশুরকে অমান্য করতেও পারে না সে আর কালা বলে হেয় করতেও ভয় হয়। সুমনের বাবা কিম্বা সুমন যদি এ রোগের স্বীকার হয়?
সুমন আর থাকতে না পেরে বলে, দাদু আবার তুমি ঠিক নিয়ে গিয়ে ফেললে শ্মশানে। তবে এতে নেই কোনো ক্ষতি।
অমনি বুড়ো বললেন, সতী? মনে রাখতে পারিস না তোরা? কতবার এ জীবনে বললুম শিবসতীর গল্পটা? সুমন হাসি চাপতে পারেনা।
সেদিন সুমনের বাবা আপিস থেকে ফিরে বাবার ঘরে দাঁড়িয়েই সুমনকে হাঁক দিলেন। বুঝলি? বড়সাহেবের ছেলে বিদেশ যাচ্ছে হায়ার স্টাডি করতে। সুমন বলে তোমার সেই যীষ্ণু? অমনি দাদু বললেন, বিষ্ণু?  চক্রপাণি? ব্রহ্মা স্বয়ং যার নাভিকমলের ওপর অবস্থান করেছিলেন? সে আবার কি করে বসল রে?
সুমন বলল, গ্লোবাল ওয়ার্মিং এর ফলে যা দুর্বিসহ অবস্থা মানুষের তোমার বিষ্ণু বিদেশ গিয়ে এবার ঠান্ডা আনতে পারবে তো নিদারুণ গ্রীষ্মে? ব্যাস! অমনি দাদুর মনে পড়ে গেল পিতামহ ভীষ্মের কথা।  ভীষ্মের নামেই তো তোর দাদুর নাম দেবব্রত রেখেছিলেন আমার বাবা। তবু দেখ আমার বিয়েশাদী করে সে প্রতিজ্ঞা আর রাখা হলনা। সুমন বলে ভালোই হয়েছে তার ফলে। নয়ত পেতাম আমার দাদুকে?  মা এসে বললেন, বাবা স্নান করে ফেলুন এবার। এই নিন আপনার তেলের শিশি। জানো বৌমা ঊর্বশীর রূপের কথা? তোমাদের এখনকার সব মেয়েদের মত সে পাউডার পমেটম মাখত না। মা একগাল হেসে মুখটা চাপা দিয়ে “হত ইতি গজ”র মত করে বললেন, আমাদের মত এত জামাকাপড়‌ও অঙ্গে উঠত না তার। তারা ছিল বিকিনি সুন্দরী। দেবতাদের পটানোই ছিল তাদের বদভ্যাস। তাঁর শ্বশুরমশাই বৌমার মুখ থেকে কথাটা ছোঁ মেরে কেড়ে নিয়ে বললেন, বেদব্যাস‌ই তো ব্যাসদেব গো। মহাভারতের রচয়িতা। আদি পুরুষ।
সুমনের বাবা বললেন, বাবা তুমি পারো বটে। ধন্য তোমার স্মৃতিশক্তি। কানে যদি শুনতে পেতে শুধু! সারাজীবন ধরে শুধুই কুড়িয়ে বাড়িয়ে তোমার পুরাণের সঞ্চয়। সুমনের দাদু বললেন, সঞ্জয় তো ধৃতরাষ্ট্রের অন্যতম সংবাদদাতা ছিলেন। আজকের দিনে তোরা যাকে বলিস চিফ নিউজ করেস্পন্ডেন্ট। যুদ্ধক্ষেত্রে উপস্থিত না-থেকেও দিব্য চোখে সব দর্শন করতে পারতেন।
মা বললেন, এই বয়সেও তোর দাদুর ঐ শ্রবণেন্দ্রিয়ের গোলোযোগ ছাড়া বাকী চারটি ইন্দ্রিয় সদাজাগ্রত।
সুমন বলল, তার কারণ প্রত্যহ বাসি মুখে ব্রাহ্মি-তুলসী-নিম। বুড়ো আর যায় কোথায়? মাথায় উঠল স্নান। অমনি বলে উঠলেন আরে মধ্য পান্ডব ভীম হল আমার সবচেয়ে প্রিয় চরিত্র। মনে আছে তোর ঠাকুমা ভৈমী একাদশী পালন করতেন?  মা বললেন, মনে আর নেই বাবা? মায়ের বারোমাসের পুজোআচ্চার ঠেলায় নিয়মিত মাজাতে হত পুজোর বাসন। দাদু গায়ে তেল মাখতে মাখতে বললেন, মহাপাজি ছিল ঐ দুঃশাসন। ব্যাটার কুমতলব ছিল সব সময়। সুমনদের এ এক নিত্য অভ্যাসে দাঁড়িয়ে গেছে। দাদুর সামনে কোনো কথা বলে ফেললেই তিনি তা মহাকাব্য কিম্বা পুরাণে নিয়ে গিয়েই ফেলবেন। এ এক বাতিকের মত। অবসেসিভ ডিস অর্ডার। অনেক কিছু রোগের চেয়ে হাজারগুণে ভালো এমন বাতিক। বাড়িতে অনাবিল হাসির ফোয়ারা তাই চলতেই থাকে সর্বক্ষণ।  বৌমা বললেন, বাবা স্নান সেরে নিন, এখনো বালতির জলটা কিন্তু কবোষ্ণ। দাদু স্নানে যেতে যেতে বললেন, কৃষ্ণ? তাকে নিয়ে অনেক কথা আছে। তাঁর জন্ম নিয়ে মৃত্যু অবধি। আবারো বলব একদিন। না বলা কথাগুলো আর বলা হয়ে ওঠেনা দাদুর কিন্তু পৌরাণিক চরিত্রের স্মৃতিতে সর্বদা ভারাতুর মন । শুধু  কানের মধ্যে দিয়ে মাথায় সিগন্যাল পশিলেই হল।
সুমনের দাদু স্নানে গেলেন। কিছুক্ষণ বাদে বেরুতেই সুমন বলে দাদু স্নান করতে খুব কষ্ট? না রে, ধৃতরাষ্ট্র লোকটা বোকা ছিল জানিস? অবিশ্যি চালাক আর বোকা লোকজন এ দুয়ের সমন্বয়েই তো মহাভারত।
সুমন বলল, মা, কলেজে আজ খাওয়া আছে। ফ্রেশার্স ওয়েলকাম। আমি কিন্তু আজ দাদুর মত ঘি দিয়ে আলু সেদ্ধ ভাত খাব শুদ্ধু। দাদু নিজের ঘরে ঢুকতে ঢুকতে বলে উঠলেন, যুদ্ধ কোথায় হয়নি বলতে পারিস? কালেকালে, দেশে দেশে সর্বত্র যুদ্ধের ইতিহাস।
সুমনের বাবা বলেন, সুমন, কোথাও পাবেনা। দাদু আছে তাই জ্ঞান পাচ্ছ এমন সহজলভ্য। দাদু মুচকি হেসে বললেন, এই আরেকটা ছেলে ছিল একলব্য। বুঝলি? শিক্ষা, একাগ্রতা, গুরুভক্তি দেখবার মত।
সুমনের বাবা চেঁচিয়ে বললেন, কারেন্ট যে কখন আসবে? দাও দিখিনি একটা হাতপাখা। দাদু বললেন, কি বজ্জাত ছিল ঐ মেয়েছেলে শূর্পনখা। ও না থাকলে রামায়ণই হতনা।
বাবার দিকে হাতপাখাটি বাড়িয়ে দিয়ে সুমন বলে। ওহ্! দাদু! তুমি না সত্যি! আজ বিকেলে বাড়ি এসে আরো গল্প শুনব আর খাব চা-বিস্কুট।
হ্যাঁ, রে শুনেছি মধ্যপ্রদেশের বড় সুন্দর জায়গা চিত্রকূট। একবার বেড়িয়ে আসিস পারলে।
হ্যাঁ গো, বাবার ডাব টা কেটে দেব যে। কোথায় রেখেছ কাঠারি? সুমনের বাবা শুধালেন। সেই শুনে মায়ের আগেই দাদু বললেন, গান্ধারী তো? ঐ একটা মেয়েমানুষ সন্তান বি‌ইয়ে আর সারাজীবন লোক দেখিয়ে ভালোমানুষি করেই খালাস। সব দেখেশুনে চোখ বেঁধে বসে ভবের খেলা দেখলেন। যেন কিচ্ছুটি দেখেন নি ।
সুমন বলল, মা, দেরী হয়ে যাচ্ছে আমার। এবার তবে কলেজ চলি। দাদু বললেন, খুব দানশীল ছিলেন রাজা বলি। সুমন চলে যায়। মাঝেমাঝে দাদুর ওপর খুব রাগ হয় আবার পরমুহূর্তেই মায়া হয় তার। মা পিছু ডাকেন সুমনকে, ফেরার পথে দুটো কাঁচা আম আনিস মনে করে। কাল পুজো আছে, আমবারুণি। ব্যাস্! শ্বশুরমশাই বলে ওঠেন, জানো বৌমা ধৌম্য ঋষির সবচেয়ে অনুগত শিষ্য ছিল আরুণি। প্রবল বৃষ্টিতে নিজে আলে সারারাত ধরে শুয়ে থেকে বাঁধ দিয়ে ঋষির ধানজমি রক্ষে করে বন্যা আটকেছিল । ভাবতে পারো? বৌমা গজগজ করতে করতে চলে যান।
আর পারিনা বাপু, তোমার এই বুড়ো বাবা কে নিয়ে। ছেলেটা বেরুনোর সময়তেও ছাড় নেই ওনার পুরাণকথা থেকে। এবার একটা কানযন্ত্র কিনে দাও তো বাপু। উনি জেদ করে বসে আছেন কানের মেশিন পরবেন না। আগের সস্তার মেশিনটা জব্বর ঠকিয়ে দিয়ে গেছে বলে জীবনে কি আর ভালো মেশিন পাওয়া যাবেনা? সারাটাদিন ধরে চলে ওনার এই রাইমিং ওয়ার্ডস নিয়ে খেলা। কাজের কথা ভুলে যাই। সুমনের বাবা মুখে কুলুপ এঁটে থাকেন। বাবার নিন্দা স‌ইতে পারেন না তিনি। বলেন আর ক’টা দিন সহ্য কর। বাবার হয়ে আসছে। তখন দেখবে এই হাসির দিনগুলোই মিস করব আমরা।
সুমনের মা বলে, ঐ দেখ, ভুলেই গেছি বলতে রান্নাঘরে খুব ইঁদুর হয়েছে। একটা ওষুধ এনে দেবে? ঘরের বাইরে আসতেই সুমনের দাদু বলে উঠলেন, কী হয়েছে বৌমা? এত কোলাহল কিসের? সুমনের মা রেগে গিয়ে বলল, জানিনা। ঐ দেখুন আবার একটা ইঁদুর। বুড়োমানুষটি বলে ওঠে  এবার। আরে বিদুর তো দাসীপুত্র। সম্পত্তির ভাগ দিতে হবে বলে অমন কোণঠাসা করে রেখে দিল তাকে।
উফফ্‌! আর পারিনা বাপু। নিকুচি করেছে আপনার পুরাণের গল্প। যত্তসব গোঁজামিল। সুমনের মা কথা শেষ করতে না করতেই তাঁর শ্বশুর মাটিতে পড়ে গেছেন।
এই রে! বাবা, কী করে পড়ে গেলেন? বুড়ো পড়ে গিয়েই কেমন যেন চেতনা হারিয়েছেন বলে মনে হল সুমনের মায়ের। এইদিকে এস, বাবা পড়ে গেছেন বলে চিৎকার করে পাশের ঘর থেকে স্বামীকে ডাকলেন। শ্বশুরকে দুজনে মিলে ধরে তোলার চেষ্টা করলেন। বুড়ো ভদ্রলোক সংজ্ঞা হারিয়েও পুরাণে অব্যাহতি দিলেন না। বৌমার মুখ নিঃসৃত গোঁজামিলের সঙ্গে মিলিয়ে বলে চললেন, অজামিল, অজামিল। কান্যকুব্জের এক সত্যবাদী, পিতৃভক্ত  বামুন ছিল। ঠিক আমার ছেলেটার মত। ঐ দ্যাখ, আমার রথ প্রস্তুত। সুমনের বাবা তাঁর মুখে শেষ জলটুকুনি দিলেন।
ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।