• Uncategorized
  • 0

“পুরুষ” নিয়ে বিশেষ সংখ্যায় নিবেদিতা ঘোষ মার্জিত

কাঁধ

কাগজে একবার একটা লেখা বার হয়, ‘ছেলেদের তো বাপের বাড়ি থাকে না।’ আমার খুব রাগ হয়ে ছিল। সদ্য বিয়ে হয়েছে। বাপের বাড়ি থেকে তাড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। ছেলেদের তো তাড়িয়ে দ্যায় না। দিব্যি নিজের বন্ধুবান্ধবদের সাথে আড্ডা, নিজের বাথরুম,নিজের রুটিন সব দিব্য এক থেকে গেছে। নতুন কিছু শিখতেও হচ্ছে না।ভালো না লাগলে হাসি মুখে থাকতে হচ্ছে না। ন্যাকামো… ‘বাপের বাড়ি থাকে না’। আসলে মেয়েদের যে মাখো মাখো চড়া দাগে ‘না থাকাটা’ দেখা যায় সেটা ছেলেদের ও থাকে না বুঝতে পারা যায় বেশ কিছুদিন পরে। ততদিনে আমি কন্যা,বধু এইরূপ পার হয়ে ধীরে ধীরে মানুষ হয়ে গেছি।বুঝতে শিখে গেছি ছেলেরা সাধারণ সংসারে থাকে একটা ‘কাঁধ’ হয়ে।
আগে বাংলা সিনেমায় একটা দাদা থাকতো। শুধু সিনেমাতে নয় সাধারণ জীবনেও।সে প্রায় সব ত্যাগ করে মায়ের পাশে দাঁড়িয়ে ভাইবোনদের জীবন তৈরি করত।কাঁধে নেওয়াটা সব সময় বয়সে ‘বড়’ সেই নিত তা নয়। এই ‘দাদা’ কোন দিন নিজের জন্যে ভালো জামা কাপড় কিনত না। খুব ছোট থেকে রোজগার করত। চায়ের দোকানের কাজ থেকে, টিউসান নানান কাজ করে ভাইবোন মা (কখনো বাবা ) দের জীবন চালাত। মোদ্দা কথা তার নিজের স্বপ্ন, প্রেম, আরও ঝাঁ চকচকে হবার সুযোগের আগে বিরাট দায়িত্ব সে নিয়ে নিত। তার কাঁধ যত ছোট হোক… দায়িত্ব নেওয়া টা কিন্তু … বড় হত। এতো দায়িত্বের পরিবর্তে বহু কাল পরে কোন ভাই বোন ‘উজ্বল’ পরিমণ্ডলে হয়ত বলবে- ‘দাদা’ ছিল বলে আজ আমরা এই জায়গায়।না বলার চান্স ছিল অনেক বেশী।এই ত্যাগ ভুলে যাওয়া আরও বেশী ছিল।কিন্তু এই ‘দাদা’ বলে মানুষটির কাছে সকলে আশ্রয় পেত। সিনেমা তৈরি হত,গল্প তৈরি হত… আদতে এই একা একজন ‘বড়দাদা’ ‘খোকামামা’ ‘নিতাইজেঠা’ ‘রাঙা কাকা’ ‘ছোট ফুল দা’ বাহুবলীর মতো টেনে টেনে নিয়ে যেত সংসার… নাকি অনেকগুলো মানুষের ছোট থেকে বড় হওয়া, বিয়ে, মারা যাওয়া…সব টেনে নিয়ে চলে যেত।এটা নিয়ে এতো বলার কি আছে ! নেই? এর বদলে এরা কি পেত? পেয়েছে কিছু? সমাজ এদের দিকে তাকিয়েছে? এদের জন্যে প্রাইজ আছে? কেন নেই বলুন তো! থাকা উচিৎ। রাখা উচিৎ ছিল।
যে ছেলের কাঁধে মাথা রেখে কেউ কাঁদেনি… তার কাঁধ শক্ত হয় না।আর সেই কাঁধের ওপরের মাথাটাতে প্রেম জমাট হয়ে থেকে যেত। প্রকাশ করতে জানতো না। কিছু মেয়েরা এটা বুঝতে পারতো ।কিছুজন সেই পাথর কঠিন দায়িত্ববানের জমাট প্রেম বুঝতে পারত না। এই অটল এবং অতল ‘প্রেম’ খুঁজে পেতে শুধু হৃদয় নয়,মস্তিস্ক লাগে। ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতাতে এই ‘দাদা’দের দুই রকম বউদের কাছ থেকে দেখা পেয়েছি। একজন চিরকাল সেই দাদার জন্যে একটু নিভৃতি খুঁজে পায়নি।দাদার পাশে থেকে অনেক মানুষের সংসারে সকল কর্তব্য পালনের শেষে অপেক্ষা করে থেকে শেষ হয়ে গেছে। এখন ছবিতে ফুলের মালা দেয়। তখন কেউ পাশে থাকে না। অন্যজন সেই দাদাকে সব রকম ভাবে সাহায্য করে বহুদিন পরে খুঁজে পায় তার ও একটা প্রেমপূর্ণ সংসার হতে পারতো। সেটা তিনি পাননি।তাঁর মানসিক অসুবিধা হয়।
অনেকের কাঁধ আবার উত্তরাধিকার সুত্রে পরিবার পার করে ‘অন্যদের’ জন্যে প্রসারিত হয়। অন্য প্রতিষ্ঠান, পাড়ার মাসিমার ডাক্তার,গ্রাম থেকে আসা দূর সম্পর্কের আত্মীয়ের চাকরীর পরীক্ষা…মধ্যে রাতে রক্ত দিতে চলে যাওয়া … ছেলে থেকে স্বামী… স্বামী থেকে বাবা… কাঁধ চওড়া হয়… বুকের ছাতি প্রসারিত হয়। মানিব্যাগ যেন সর্বদা গর্ভবতী থাকে। কারণ কাউকে তো ফেরানো যাবে না।কারোর কষ্ট তো হওয়া তো চলবে না। কোথাও কোন কিছু অপূর্ণ থাকলে চলবে না।পিতা মস্তিষ্কে সন্তান নিয়ে ঘুরে বেড়ায়।সেই কবে থেকে! যেদিন থেকে মা তাঁকে গর্ভে নিয়ে ঘুরে বেড়াতে শুরু করে।
এরকম এক পাথুরে লোক ফুলের মালা খোঁপায় দিয়ে দিয়ে ঘুরে বেড়ানো বউ কে বলে, “এগুলো মাথায় কেন দিয়েছো । বিচ্ছিরি লাগছে।” ন্যাকা বউ রাগ করার চেয়ে অবাক হয় বেশী। সেই লোক পাথুরে চোখ নিয়ে বলে, “ যারা বাড়ির দেওয়ালে শিকার করা পশুর মুন্ডু ঝুলিয়ে রাখে তাদের তোমার ভালো লাগে। গাছের ফুল গাছে থাকবে। মাথায় দেবার কি আছে!” পাথর ধারণ করে। কারুকাজ… সভ্যতা… দেশ … পরিবার… সন্তান… সম্মান… স্বপ্ন।
ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।