সাহিত্যিক হুমায়ূন আহমেদের জনপ্রিয় ‘বল পয়েন্ট’ বইটিতে একটি লাইন আছে এরকম- “পৃথিবীতে অনেক খারাপ মানুষ আছে, কিন্তু একটাও খারাপ বাবা নেই।” ছোট্ট একটি শব্দ ‘বাবা’, অথচ তার কি বিশাল ব্যাপ্তি। পৃথিবীর যাবতীয় ভালোবাসা, নির্ভরতা, নিরাপত্তার এক অপূর্ব সহাবস্থান ঘটে চলে সমস্ত বাবাদের মধ্যে। ‘বাবা’ বলতেই আমাদের চোখের সামনে ভেসে ওঠে কঠিন, কঠোর, রাশভারী এক ব্যক্তিত্ব। কিন্তু সময়ে সময়ে ঐ কঠিন বর্ম ভেদ করেই বাবারা হয়ে ওঠেন সন্তানের অত্যন্ত কাছের মানুষ।
বাবা অথবা মা সন্তানের জীবনে কারুর ভূমিকাই কারুর চেয়ে কম নয়, এক্ষেত্রে তুল্যমূল্য বিচার হয় না। তবে প্রাচ্যের দেশগুলোতে সঙ্গত কারণেই বাবা জীবন ও জীবিকার তাগিদেই একটু বহির্মুখী হয়ে থাকেন। ফলে সন্তানের বেড়ে ওঠার প্রথম ও গুরুত্বপূর্ণ পর্বে সে পাশে পায় মাকে, তাই সন্তানের সঙ্গে মায়ের সংশ্লিষ্টতা একটু বেশিই হয়ে থাকে। কিন্তু বর্তমান সময়ে বাবা বা মার এই ভূমিকাটা ক্রমাগত বদলে বদলে যাচ্ছে। তবুও কোনো এক অজানা কারণে বাংলা উপন্যাস, ছোটোগল্প, নাটকে বাবার ভূমিকাকে পরিবারের রক্ষাকর্তা হিসেবে দেখানো হলেও তাঁদের নিয়ে গান বা কবিতা খুব একটা নেই বললেই চলে। আসলে সেখানেও ঐ বহুচর্চিত পিতৃতান্ত্রিক এক ধারণাকে আঁকড়ে বসে আছি আমরা- বাবারা হবেন সবসময় কঠিন, কঠোর; কোমলতার কোনো আভাস তাঁর চরিত্রে থাকলে চলবে না। বাবারা শত দুঃখ-কষ্ট-মনখারাপ-কান্নার উর্দ্ধে যেন এক অতিমানবীয় ভূমিকায় অবতীর্ণ হবেন বারেবারে, এটাই আমাদের প্রত্যাশা।
এবার একটু এই দিনটার ইতিহাসে চোখ বুলিয়ে নেওয়া যাক। আন্তর্জাতিক স্তরে ব্যাপ্ত এই দিনটির ইতিহাস নিয়ে বিভিন্ন মতামত থাকলেও বহুল প্রচলিত মতটি হল এইরূপ- সোলার স্মার্ট ডোড নামক এক মার্কিন নারীর হাত ধরেই এই দিনটি বিখ্যাত হয় গোটা বিশ্বে। ডোড ১৮৮২ সালের ১৮ই ফেব্রুয়ারী জন্মগ্রহণ করেন এক কৃষিজীবী পরিবারে। জন্মেই মাকে হারান চার ভাইয়ের এই একমাত্র বোন। ফলে মায়ের অবর্তমানে তাঁর বাবাই হয়ে ওঠেন একাধারে মা ও বাবা। ডোড ও তাঁর চার ভাইয়ের সাথে তাঁদের বাবার সম্পর্ক সন্তান এবং জননীর সম্পর্কের থেকে কোনো অংশে কম ছিল না। তাঁরা প্রত্যেকেই তাঁদের একলা বাবার সংগ্রাম ও কষ্টের জীবনকে দেখে বড়ো হয়ে উঠেছিলেন। ১৯০৯ সালে বাবা মারা যাওয়ার ঠিক পরের বছর, অর্থাৎ ১৯১০ সালে ডোডের মাথায় আসে এক অদ্ভুত ভাবনা। একটা গোটা দিনকে যদি তাঁর মতো আরও বহু হতভাগ্য সন্তানদের কাছে বাবার জন্য উৎসর্গ করা যায়, তবে কেমন হবে ব্যাপারটা? সে বছরেই ‘মা দিবস’ পালনের দিন চার্চে প্রার্থনা অনুষ্ঠানে মায়েদের মতো বাবাদের জন্যও এমন একটা সম্মানসূচক দিনের প্রস্তাব দেন তিনি। তাঁর ঐ প্রস্তাব শেষপর্যন্ত জুন মাসের তৃতীয় রবিবার ‘বাবা দিবস’ হিসেবে স্বীকৃতি পায়। পরে দিনটিকে সরকারি ছুটি হিসেবে ঘোষণা করা হয়। এই দিনটি উপলক্ষ্যে বিভিন্ন দোকানে বিশেষ উপহার রাখা থাকত। সন্তানেরা চার্চে যেতেন লাল ও সাদা গোলাপ নিয়ে। জীবিত বাবাদের দীর্ঘায়ু কামনায় লাল গোলাপ এবং মৃত বাবাদের আত্মার শান্তি কামনায় সাদা গোলাপ নিয়ে সন্তানেরা হাজির হতেন প্রার্থনায়। এরপর ধীরে ধীরে দিনটি জনপ্রিয়তা পেতে থাকে। ১৯১০ সালের ১৯শে জুন তা ব্যাপকভাবে ওয়াশিংটনের স্পোকেন্স শহরে পালিত হয়। এর ৯ বছর বাদে ১৯১৯ সালে দিনটি গোটা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র জুড়ে পালিত হয়। ১৯৬৬ সাল নাগাদ প্রায় ৫৬ বছর পর দিনটি জাতীয় মর্যাদা পায়। ১৯৭২ সালে প্রেসিডেন্ট রিচার্ড নিক্সন এই দিনটিকে প্রতিবছর জাতীয়ভাবে পালনের সবুজ সঙ্কেত দেন। বর্তমানে বিশ্বের প্রায় ৮৪টি দেশে দিনটি সাড়ম্বরে পালিত হয়।
বাবার ভালোবাসা কোথাও গিয়ে কর্তব্য, দায়িত্ব ইত্যাদি গুরুগম্ভীর সব বিষয়ের ভারে অনেকসময় ঢাকা পড়ে যায়। তাকে আমরা সেভাবে উপলব্ধি করতে পারিনা। কিন্তু শৈশবে মা-হারা সন্তানের কাছে ঐ গুরুগম্ভীর, দায়িত্বশীল মানুষটিই স্নেহ-মায়া-মমতার এক খনি হিসেবে নিজেকে উজাড় করে দেন। সন্তানকে তার মায়ের অভাব বুঝতে না দিয়ে যাবতীয় দুঃখ-কষ্ট বুকে চেপে রেখে কর্তব্যে অবিচল থাকেন সেই ‘একলা পুরুষ’। ভাষাভেদে শব্দ বদলে যায়; বাংলাভাষার ‘বাবা’ জার্মানে হয়ে ওঠেন ‘ফ্যাটা’, ফরাসীতে ‘প্যেরেঁ’, কিম্বা গ্রীকভাষায় ‘প্যাতেরাস’; কিন্তু তাঁর ভালোবাসায় কোথাও কোনো খামতি থাকে না। তবে শেষ করতে করতে একটাই কথা শুধু বলার; জুন মাসের এই একটি বিশেষ দিনই শুধু নয়, বাবাদের জন্য সন্তানের কাছে বছরের প্রতিটি দিনই এক বিশেষ তাৎপর্য বহন করে। প্রতীকি হিসেবে এই একটি দিন বাবাদের জন্য থাকলেও প্রতিটি দিনই যেন বাবা ও সন্তানের সুসম্পর্কের দিন হয়ে ওঠে। তবেই ঐ ‘একলা পুরুষ’ কর্তব্যে যেমন অবিচল থাকতে পারবেন, তেমনই পিতৃস্নেহের পরশে উচ্ছ্বলিত হবে সন্তানের হৃদয়।