• Uncategorized
  • 0

“পুরুষ” নিয়ে বিশেষ সংখ্যায় মহুয়া চৌধুরী

কাকুমণি

বির মধ্যে প্রায়ই আসল মানুষের ছায়া পড়ে না। কিন্তু লিভিং রুমে টাঙানো কাকুমণির এই বড় ছবিটা ভারী আশ্চর্য। বিজন রত্নাকে বলে, “জান, তিনি ঠিক যা ছিলেন, এ ছবি যেন সেই কথাই বলে দিচ্ছে !”
রত্না প্রথম দিন এই ছবি দেখে মুখ দিয়ে কেমন একটা শিউরে ওঠার মতো অর্ধব্যক্ত শব্দ করেছিল। আর বলেছিল,-“কি জীবন্ত! যেন সত্যি সত্যিই তাকিয়ে আছেন!”
বিজনের মনে হয়েছিল রত্নার মুখে যেন আতঙ্ক। অবাক হয়েছিল বিজন।
এখন ওদের বিয়ের তিন মাস হয়ে গেছে।
রত্না ভেবেছিল ও বুঝি, বিজনকে পুরোপুরি পড়ে ফেলতে পেরেছে। বিজন সাংসারিক বিষয়ে মাথা ঘামানোর মতো মানুষ নয়। দুজন ঠিকে কাজের মেয়ে আগে নিজেদের ইচ্ছেমতো যা করার করত। তখন এ বাড়িতে যে এলোমেলো ছন্নছাড়া ব্যাপার চলত, তা বিজন স্বাভাবিক বলেই মেনে নিয়েছিল। তাই কখনও বিরক্ত হয়নি।
কিন্তু এখন রত্না সংসারের হাল ধরেছে। কাজেই বিজন আজকাল সুস্বাদু খাবার পাচ্ছে। দরকারের সময়ে হাতের কাছে, সব কিছু গুছানো থাকছে। বাড়ি পরিচ্ছন্ন তক্‌তক্‌ করে। কিন্তু রত্না ধরেই নিয়েছিল সে নিশ্চয় এই তফাৎটা ধরতে পেরে খুশি হয়েছে। সকলে মুখে সব কিছু প্রকাশ করতে পারে না।
বিজন কলেজের পড়ানো আর নানা ধরনের বই পড়া নিয়েই বেশী সময়টা ব্যস্ত থাকে। নির্বিবাদী ।খুব নিরীহ। নরম স্বভাবের। কারোর সাতে পাঁচে থাকে না। সেই সঙ্গে স্বচ্ছল অবস্থা। প্রত্যাশা কম। ঠিক এমনই একজন মানুষকেই সঙ্গী হিসেবে রত্নার প্রয়োজন ছিল।
রত্না আসলে বেশ স্বাধীনচেতা। নিজের মতো থাকতে ভালই বাসে। নিজেকে ঠিকঠাক রাখতে জিম আর পারলারে যাচ্ছে সে আজকাল নিয়মিত। কম্পিউটারের অ্যাডভান্সড কোর্সে জয়েন করেছে। এই সূত্রে ওর এক নতুন বন্ধুগোষ্ঠী গড়ে উঠেছে। তাদের সঙ্গে আড্ডা,মলে যাওয়া, টুকটাক শপিঙে ওর দিব্যি সময় কেটে যায়। তবে আপাতত ওর চাকরি করার ইচ্ছে নেই।
একান্নবর্তী নিম্ন মধ্যবিত্ত পরিবারে ওর বড় হয়ে ওঠা। মাথার একটা বাহারি ক্লিপ কিনলেও, কৈফিয়ৎ দিতে হয়েছে মায়ের কাছে। অটো ভাড়া বাঁচাতে ভ্যাপসা গরমের দিনে অনেক রাস্তা হেঁটেছে ।
সেই দিনগুলো প্রায় দুঃস্বপ্নের মতো মনে হয় এখন। কাজেই রত্না ঠিক করেছে এখন কিছুদিন নিজের ইচ্ছে মতো সময় কাটাবে ও।
বিজন রত্নার সুবিধেজনক ভাবে উদোমাদা টাইপের। টাকাকড়ির ব্যাপারে খিটমিট করে না কখনও। রত্নাও অবশ্য মাত্রা ছাড়ায় না। কাজেই ওদের দাম্পত্য সম্পর্ক খুবই মসৃণ ভাবে চলার কথা ছিল। বিজনের সঙ্গে বিয়ে হওয়াটা রত্নার কাছে স্বপ্নপূরণের মতো আশ্চর্য ছিল গোড়া থেকে। এই সংসারে ওকে চালনা করার মতো কেউ নেই, কাউকে কৈফিয়ৎ দিতে হয় না কোনো কিছুতে। স্বচ্ছলতার সঙ্গে এ এক ফুরফুরে স্বস্তি।
কিন্তু রত্নার ভিতরে অদ্ভুত একটা খচ্‌খচানি। যতবার সে বসার ঘরে ঐ ছবিটা দেখে, মনে হয়, ছবির মানুষটা ওকে দেখছেন, ওর প্রতিটা পদক্ষেপের মূল্যায়ন করছেন। মারা যাবার পরেও কি আশ্চর্য ভাবে এ বাড়ি জুড়ে মানুষটা থেকে গেছেন যেন! এ কথা কাকেই বা বলা যায়! এ তো হাওয়ার সঙ্গে যুদ্ধ।
শুধু মনে মনে ক্রমশ ও বিজনের উপর বিরক্ত হয়ে উঠতে থাকে। একটা মানুষ তো ভুঁইফোঁড় হতে পারে না। তার মধ্যে তার ছেলেবেলার পরিজনের স্বভাব, অভ্যেস, ভাবনা সবেরই কিছু ছাপ পড়তে বাধ্য। কিন্তু রত্নার মনে হয়, ঐ মানুষটা আজ পর্যন্ত বিজনকে যেন একেবারে সম্মোহিত করে রেখেছেন।
রত্নার সঙ্গে ওর কথাবার্তার এক বড় অংশ জুড়ে থাকেন ‘কাকুমণি’। বিজনের পরলোকগত কাকা। খুব ছেলেবেলায় ছ মাসের ব্যবধানে বিজনের বাবা-মা দুজনেই মারা যাবার পরে, যে কাকা ওকে বড় করে তুলেছেন। যিনি ভাইপোর অযত্ন হবার ভয়ে বিয়ে করেননি। তাঁর আদরের গল্প, অন্য ধরনের শাসনের গল্প, যে শাসনে মানুষ নিজেই নিজেকে শাস্তি দিতে শেখে। কাকুমণি কোনোদিন নীতিকথা বলতেন না। কিন্তু তাঁর জীবনের অজস্র ছোট বড় ঘটনার মধ্যে দিয়ে কেমন ভাবে তিনি একটি ছোট ছেলের কাছে উদাহরণ স্বরূপ হয়ে উঠেছিলেন, তা বলতে বসলে এই বয়সেও বিজনের চোখ চিক্‌চিক্‌ করে ওঠে। গলা কেঁপে যায়।
কাকুমণির নানা গল্প শুনতে শুনতে, রত্না ইদানীং অনেক কষ্টে হাই তোলাটা আটকায়। প্রায় ভাবলেশহীন মুখে শুধু একটা ‘প্ল্যাস্টিক হাসি’ ঠোঁটে ফুটিয়ে চুপচাপ তাকিয়ে থাকে।
রত্না চটকদার মাসিক পত্রিকা ছাড়া অন্য কিছু পড়তে উৎসাহ পায় না। ওর পছন্দের বিষয়, রূপোলি জগতের তারকাদের হাঁড়ির খবর আর রান্না, ঘর সাজানো, রূপচর্চার খুঁটিনাটি। কিন্তু এসব পড়ে রত্নার অনেক কিছু জ্ঞানলাভ হয়েছে। সেই জ্ঞানকে ভিত্তি করেই ও নিজের মতটাকে প্রকাশ করে ফেলল শেষে। নিজেই দেখেশুনে একটা বড় ছবি কিনে আনল একদিন। পাহাড়ের ফাঁকে সূর্যাস্ত। খুব সুন্দর। তারপর একটু ইতস্তত করে বিজনকে বলল,-“ দেখ বসার ঘরে বাড়ির লোকের ছবি রাখাটা ঠিক রুচির পরিচয় নয়। কাকুমণির এই ছবিটা এত চমৎকার, জীবন্ত। কিন্তু একটা কথা ভাবছিলুম—“
বিজন ল্যাপটপে কাজ করছিল। ভুরু তুলে তাকিয়েছিল। রত্না বলে চলল,-“কাকুমণি, আমাদের খুব প্রিয়। কিন্তু এ তো আমাদের একেবারেই ব্যক্তিগত অনুভব। বাইরের লোকের কাছে সেটা দেখানোর দরকার কি! তাই এই ছবিটা কিনে এনেছি, এখানে টাঙাবো বলে। আর কাকুমণির ছবিটা এখান থেকে ওদিকের প্যাসেজে সরিয়ে দিলেই হবে।“
বিজন স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়েছিল। কথা বলতে বলতে অস্বস্তি হচ্ছিল রত্নার। সে থামা মাত্র বিজন বলে উঠল,-
“না না কোনো প্রশ্নই ওঠে না। ও ছবি ওখানেই থাকবে।“ – আবার নিজের কাজে ডুবে গিয়েছিল।
এটা আলোচনা নয়, কোনো তর্কের সুযোগ দেওয়া নয়। এক জোরালো সিদ্ধান্ত। রত্না সেই মুহূর্তে আর কিছু বলতে পারেনি। কিন্তু শব্দগুলো ওর মাথায় চেপে বসেছিল। তিন মাসের মধ্যে এই প্রথম ও নিজের অমতে কোনো কথা শুনলো। বিজনের স্বরে এক অনভ্যস্ত কঠোরতা ছিল। রত্না বুঝতে পারল, বিজনকে পুরোপুরি পড়ে উঠতে পারেনি সে। খুব ক্ষোভের সঙ্গে তার মনে হোল ঐ ছবির মানুষটা আসলে তার প্রতিদ্বন্দ্বী। যে দ্বন্দ্বে সে কিছুতেই জিততে পারবে না। কারণ বিজন আগে থেকেই ওর কাকুমণিকে জিতিয়ে রেখেছে। এ দুনিয়ার সবাইকার উপরে তাঁর ঠাঁই।
আরো মাসখানেক পরের এক সকালে চা ঢেলে কাপটা রত্না এগিয়ে দিল বিজনের দিকে। নিজেও নিল। আজ সে একটু অন্যমনস্ক। ভিতরে এক ভাললাগার উত্তেজনা। বিজনকে বলবে ভেবেও বলল না। পিরিয়ড মিস করেছিল এ মাসটা। বিজনের খেয়াল নেই। প্রেগ্‌নেন্সি কিট এনে টেস্ট করেছে একটু আগে। পজিটিভ। একটা মানুষ বিন্দু বিন্দু করে খুব আস্তে গড়ে উঠছে ওর মধ্যে, এই নিতান্ত সাধারণ ব্যাপারটা শিহরণ জাগাচ্ছিল ওর মনে। আর মনে হচ্ছিল এই জানাটা যতক্ষণ সম্ভব ও নিজের মধ্যে গোপনে রেখে দেবে। বিজন বেরোবার পরে, সমস্ত কাজ সেরে রত্না সোফায় বসল। টি ভি চালিয়ে দিল। যদিও সেদিকে মন নেই। নিজেকে নিয়ে ও এখন আপ্লুত হয়ে রয়েছে। তার একটা অন্য পরিচয় তৈরি হতে চলেছে। ঐন্দ্রিলার সঙ্গে মলে মুভি দেখতে যাবার কথা ছিল। কিছু অজুহাত দিয়ে কাটিয়ে দিল সেটা।
হঠাৎই তার মনে হোল বিজন শুনলে কি বলবে? নিশ্চয় নিজের সন্তানের মধ্যে ওই কাকুমণির ছায়া দেখতে চাইবে সে অবচেতনে। ভেবে দাঁত দিয়ে নিজের ঠোঁট কামড়ালো সে অস্থির ভাবে। শরীরে ক্লান্তি ছিল। কখন যেন অবেলায় ঘুমিয়ে পড়েছিল। ঘুম ভাঙতে দেখল সন্ধ্যে হয়ে গেছে। বিজনের ফিরতে এত দেরি হয় না তো কখনও। মোবাইল হাতে তুলে নিল। বেজে বেজে থেমে গেল বিজনের ফোন। একটু অপেক্ষা করল রত্না। আবার ফোন করল। আবার—আবার—উত্তর আসছে না।
যখন উদ্বেগের চরম সীমায় পৌঁছে গেছে সে, তখন বিজন বাড়ি ফিরল রাত নটারও পরে। ট্যাক্সিতে। সঙ্গে ওর দুজন সহকর্মী। বিধ্বস্ত চেহারা। শার্ট ছেঁড়া। কপালে, চিবুকে গভীর ক্ষত। বাঁ হাতটা স্লিঙে ঝোলানো। রত্নার উদ্দাম আতঙ্কিত সব প্রশ্নের সামনে একটু হাসল বিজন। সহকর্মী দুজন উত্তেজিত ভাবে ছেঁড়া ছেঁড়া কথায় ঘটনাটা বর্ণনা করতে যাচ্ছিল। ওদের থামিয়ে বিজন বলতে শুরু করল।
কয়েকটা বখাটে ছেলে একটা মেয়েকে উত্যক্ত করছিল খোলা রাস্তায় অনেকের সামনেই। পথ চলতি মানুষেরা না-দেখার ভান করে চলে যাচ্ছিল—তারপর—এই পর্যন্ত বলে একটু থামল বিজন। হাসল। কাহিনীর মধ্যিখানটা একদম বাদ দিয়ে চলে গেল শেষের অংশে।
“ভাগ্যিস এরাও এগিয়ে এসেছিল দেখে নয়তো”- নিজের সহকর্মী দুজনের দিকে ইঙ্গিতে দেখালো বিজন। “তারপর থানা পুলিস—ছেলেগুলোকে অ্যারেস্ট করেছে —একটার বাবা খুব ইনফ্লুয়েন্সিয়াল—তবু অনেক ঝামেলার পরে– যাক্‌ একটু চা কর এবার—” –
অনেক রাত। বিজনের কাটা ঘাগুলোয় মলম লাগিয়ে দিয়েছে রত্না খুব যত্ন করে। বাঁ হাতটা ফ্র্যাক্‌চার নয়। খুব জোর মচকে গেছে। হাতের নীচে বালিশ দিয়েছে রত্না । ওষুধের জেরে অঘোরে ঘুমোচ্ছে বিজন। রত্নার চোখে ঘুম নেই। আজ গোলমালে কথাটা বিজনকে জানানো হয়নি।
বিজনের পাশ থেকে উঠে বসার ঘরে এল রত্না। আলো জ্বেলে কাকুমণির ছবির সামনে দাঁড়াল। তাকিয়ে রইল কতক্ষণ। ওর চোখে জল। এত দিনে সে বুঝেছে ছবির এই মানুষটা আসলে এক আশ্চর্য উপহার দিয়ে গেছে তাকে। নিজের জীবন দিয়ে তৈরি আশ্চর্য এক উপহার। নাহ্‌ কোনো প্রতিদ্বন্দ্বিতা নয়—দুজন অসম মানুষের মধ্যে কোনো প্রতিদ্বন্দ্বিতা থাকতে পারে না। তার আনত দৃষ্টি স্থির হোল নিজের নাভিতে। হাত রাখল সেখানে। অস্ফুটে বলল কিছু। কোনো আশীর্বাদ চাইল কি নিজের অনাগত সন্তানের জন্য? গভীর রাতের সেই নির্জন ঘরে কিছুই শোনা গেল না।
ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।